রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যৌক্তিক পরিণতিটা আসলে কী

বেগম জিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে। দীর্ঘ ৫৩ দিন পর গণমাধ্যমের সম্মুখে তিনি হাজির হলেন। ওই দিন টানা অবরোধ-হরতাল যখন ৬৬ দিন পার করেছে, তখন বেগম জিয়া হাজির হয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মুখে। সব মিডিয়ার দৃষ্টি ছিল বেগম জিয়ার দিকে- কী কথা বলেন তিনি? তিনি বললেন, 'যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।' অর্থাৎ চলমান আন্দোলনকে একটি 'যৌক্তিক পরিণতির' দিকে তিনি নিয়ে যেতে চান! নিঃসন্দেহে এই বক্তব্যটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে কিছু 'প্রশ্ন' ও 'প্রস্তাব' রেখেছেন, যার সঙ্গে এই 'যৌক্তিক পরিণতির' একটা মিল আমরা খুঁজে নিতে পারি। তিনি বলেছেন, ১. চলমান সংকটের চরিত্র রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক, ২. ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি (৪৫তম) আমরা পালন করতে পারি, ৩. আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি, ৪. বর্তমান সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন, ৫. পেট্রলবোমা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়, ৬. নেতা-কর্মীদের মুক্তি, গুপ্তহত্যা বন্ধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ৭. সভা-সমিতি আয়োজন করার ওপর যে বিধিনিষেধ, তা প্রত্যাহার, ৮. সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের জন্য একটি সংলাপ। মোটা দাগে এগুলোই হচ্ছে মোদ্দাকথা। তিনি বললেন না যে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে একটি আভাস আছে, সংলাপ হলে এই কর্মসূচি তিনি আর দেবেন না। আভাস আছে আরো একটি- বর্তমান সংসদকে তিনি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন! এবং দাবি করেছেন সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে। যেহেতু বর্তমান সংকটকে তিনি মনে করছেন, 'রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক', সেহেতু ওই সংকটের সমাধানের পথ একটাই আর তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন! স্পষ্টতই 'রাজনীতির বল'টি তিনি ঠেলে দিয়েছেন সরকারের পায়ে। সরকার এখন 'বল'টি কিভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার ইতিমধ্যেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের কথা। এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? আল-জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে- এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে এত হরতাল-অবরোধের পরও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কল-কারখানায় প্রায় 'স্বাভাবিক অবস্থা' বিরাজ করছে। রপ্তানি খাতে কিছুটা শ্লথগতি এলেও এই খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই 'অস্থিরতার' একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই 'সমাধান'টা করতে হবে দুটো বড় দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে এই 'পেট্রলবোমা'র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। এই অসহিষ্ণুতা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারবে না। বর্তমান যে সংকট, সেই সংকট রাজনীতিবিদদেরই কাটিয়ে উঠতে হবে। কোনো 'তৃতীয় শক্তি' এর সমাধান করত পারবে না। যাঁরা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দিকে হাত বাড়ান, তাঁরাও ভুল করছেন। এটা সমাধানের পথ নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন আমরা পার করছি। আর প্রতিদিনই পেট্রলবোমা আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটগুলোতে অগ্নিদগ্ধ মানুষের করুণ কাহিনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। ছোট্ট শিশুরা অগ্নিদগ্ধ বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রশ্ন রাখছে সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে তাকে মানুষ পোড়াল কেন? এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছেই নেই। সাধারণ মানুষ জানেও না এ পরিস্থিতির অবসান হবে কিভাবে? বা কখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে দেশ? এমনিতেই অবরোধের মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে খুব বেশি যানবাহন না এলেও খোদ রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে ক্লাস হচ্ছে। ভয়ের মধ্যেও মানুষ তার নিত্যদিনের কাজ করে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে অসন্তোষ আর রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ। আর হতাশা। এ পরিস্থিতিতেও দোষারোপের রাজনীতি আমরা লক্ষ করছি। সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করছে। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। তাদের দাবি ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতির জন্ম হতো না। পরস্পর দোষারোপের মধ্য দিয়ে এক অসহিষ্ণু রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে। এ বড় দল দুটোর বাইরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সরকারের 'বিশেষ দূত' এইচ এম এরশাদ পাঁচ ঘণ্টা অনশন পর্যন্ত করেছেন গত ৩০ জানুয়ারি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এখনো অবস্থান ধর্মঘট করছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে আরো দুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। একটি নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেপ্তার হয়েছেন। দ্বিতীয়টি একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান অভিজিৎ রায় জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। দুটো ঘটনাই চলমান রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে অভিযোগে মান্না গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ সংগঠিত করা (?) একটি বড় ধরনের অপরাধ। এ জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলে সরকারকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। সাধারণ মানুষ একটা সমাধান চায়। নিরাপদে কর্মক্ষেত্রে ও বাড়িতে যেতে চায়। অভিভাবকরা চান তাঁর সন্তান পরীক্ষা দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসুক। কোনোমতে এসএসসি পরীক্ষা হলেও এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ পরীক্ষা নিয়েও রয়ে গেছে প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেল বছর এইচএসসি পাস করে যারা ভর্তি হয়েছে, তারা এখনো ক্লাস শুরু করতে পারেনি। আবার নতুন আরেক গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমরা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কেউ ভাবছি না। এর শেষ কোথায় আমরা জানি না। খেটে খাওয়া মানুষ এটা বোঝে না। বোঝে এটা কাম্য নয়। এখন সংকট কাটিয়ে উঠব কিভাবে? নয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, গণতন্ত্র বিকাশে ভিন্নমত ও সংলাপ প্রয়োজন। মার্কিন কংগ্রেসের ১১ জন সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন কেরিকে লিখিত এক চিঠিতে 'বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার' জন্য অনুরোধ করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাহলে কেরি 'ভূমিকা রাখবেন' কিভাবে? এদিকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও, তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হলে সরকারের শেষ 'অস্ত্র'টিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে! সরকার বোধ করি এটি চাচ্ছে না এবং তারা আইনি পথেই এগোতে চায়। ৫ এপ্রিল আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। বোঝাই যায়, সরকার মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বেগম জিয়াকে 'চাপে' রাখতে চায়। তাতে কতটুকু ফল হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। রাজনীতিবিদরাই দেশ চালাবেন। এটাই কাম্য। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এটাই। তাই আমার বিবেচনায় উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। এখন বেগম জিয়া 'যৌক্তিক পরিণতির' কথা বলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, আমার কাছে তা স্পষ্ট নয়। এখন বেগম জিয়াকে 'আন্দোলনের' নতুন 'কৌশল' নির্ধারণ করতে হবে। সহিংসতা পরিহার করতে হবে। একটি 'আস্থার সম্পর্ক' গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাও হতে হবে নমনীয়। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে ওঠে, তাহলে সংকট উত্তরণ সম্ভব। Daily KALERKONTHO 22.03.15

0 comments:

Post a Comment