বে গম জিয়া একটি মেসেজ দিয়েছেন। গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে তিনি কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেওয়ায় এটা বলাই যায়, বেগম জিয়া চাচ্ছেন সরকারের পক্ষ থেকে একটি ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ! আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতির কথা তিনি বলেছেন বটে, কিন্তু কোনো কঠোর কর্মসূচি দেননি! বিএনপি তথা ২০ দলের দীর্ঘ দুই মাসের ওপর চলা এই আন্দোলন তার ‘যৌক্তিক লক্ষ্যে’ পৌঁছতে পারেনি এটা সত্য, কিন্তু এই আন্দোলনের একটা বড় ‘সাফল্য’ বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচার পাওয়া। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, সমাজের সর্বক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটা যে কোনো সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব যদি প্রতিষ্ঠিত না থাকে, সেই সরকার টিকে থাকতে পারে না। দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, এভাবে সরকার পতন ঘটানো যায় না। এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার এটাও সত্যÑ ব্যাপকসংখ্যক মানুষের একটা ‘অসন্তোষ’ এখনো রয়ে গেছে। সরকারের উচিত হবে এই অসন্তোষের দিকে নজর দেওয়া। এই ‘আন্দোলন’ প্রমাণ করেছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে ‘আস্থার সম্পর্ক’ থাকে, বাংলাদেশে এই আস্থার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। অতীতে এই আস্থার সম্পর্ক ছিল। আস্থার সম্পর্ক ছিল বিধায় আমরা দেশে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পেরেছিলাম পঞ্চম সংসদে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও ছিল এই আস্থার সম্পর্কের ফলশ্রুতি।বিএনপি ১৩ দিনের ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস না করালে হয়তো আমরা ভিন্ন এক পরিস্থিতি দেখতে পেতাম ১৯৯৬-৯৭ সালে। আজ সেই আস্থার সম্পর্কটা একেবারেই নেই। বেগম জিয়া আন্দোলনে আছেন। অনেকটা কর্মীবিচ্ছিন্ন, নেতাবিচ্ছিন্ন গুলশান কার্যালয়ে ‘গৃহবন্দিত্ব’ জীবন তার। এক ছেলেকে হারিয়েছেন। বড় ছেলে তাও বিদেশে। এই আন্দোলনে একাকী ‘সৈনিক’ তিনি। ‘যৌক্তিক লক্ষ্যে’ তিনি আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থাকবেই। একরকম ‘বিছিন্ন’ এক জীবন, মাথার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর আদালতের হুকুমনামা, দুর্নীতির অভিযোগ একের পর এক উত্থাপন, সব মিলিয়ে এক ভিন্নরূপে আমরা দেখছি বেগম জিয়াকে। এ ‘পরিস্থিতি’ থেকে তিনি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, সেটা একটা ‘মিলিয়ন ডলার’ প্রশ্ন। এমনকি দলটি ভেঙে যাওয়ার মুখেও দাঁড়িয়ে আছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এক কঠিন ‘সত্য’-এর মুখোমুখি তিনি। শত শত কর্মীর আশার একমাত্র ‘স্থান’ বেগম জিয়া স্বয়ং দলের অন্য কেউ নন। দলের ভেতরে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েও আছে নানা শঙ্কা। দলের একটা অংশ এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দলের ঐক্যকে টিকিয়ে রাখা হবে কঠিন এক কাজ। সব মিলিয়ে তার সংবাদ সম্মেলনের উত্থাপিত বক্তব্যগুলো ছিল আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে কিছু ‘প্রশ্ন’ ও ‘প্রস্তাব’ রেখেছেন, যার সঙ্গে এই ‘যৌক্তিক পরিণতি’র একটা মিল আমরা খুঁজে নিতে পারি। তিনি অনেকগুলো কথা বলেছেন চলমান সংকটের চরিত্র রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি (৪৫) আমরা পালন করতে পারি। আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। বর্তমান সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন। পেট্রলবোমা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়। নেতাকর্মীদের মুক্তি, গুপ্তহত্যা বন্ধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সভা-সমিতি আয়োজন করার ওপর যে বিধিনিষেধ, তা প্রত্যাহার করা, সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচনের জন্য একটি সংলাপ ইত্যাদি। মোটা দাগে এগুলোই হচ্ছে মোদ্দা কথা। তিনি বললেন না হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে একটি আভাস আছেÑ সংলাপ হলে এই কর্মসূচি তিনি আর দেবেন না। আভাস আছে আরও একটিÑ বর্তমান সংসদকে তিনি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন! এবং দাবি করেছেন সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে। যেহেতু বর্তমান সংকটকে তিনি মনে করছেন ‘রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক’, সেহেতু এই সংকটের সমাধানের পথ একটাইÑ আর তা হচ্ছে সংবিধান সংশোধন! স্পষ্টতই ‘রাজনীতির বল’টি তিনি ঠেলে দিয়েছেন সরকারের দিকে। সরকার এখন ‘বল’টি কীভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার ইতোমধ্যেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে ৫ বছর পরপর নির্বাচনের কথা। এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? আল জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেই সঙ্গে এটাও সত্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবেÑ এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে, এত হরতাল-অবরোধের পরও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কলকারখানায় প্রায় ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বিরাজ করছে। রপ্তানি খাতে কিছুটা শ্লথগতি এলেও, এই খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই ‘অস্থিরতার’ একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ‘সমাধান’টা করতে হবে দুটি বড় দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে এই ‘পেট্রলবোমা’র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে বিভেদ ও বিদ্বেষ তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। না হলে অসাংবিধানিক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বিভিন্ন ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’-এর কথা আমরা শুনেছি, দেশে ও দেশের বাইরে। সেনাবাহিনীকে জড়িত করানোর একটা ‘নগ্ন ষড়যন্ত্র’ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁস করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। একটা ভয় আছে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে। রাজনীতিবিদরা যখন ব্যর্থ হন, তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এটা ইতিহাসের কথা। তত্ত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের ঘটনাবলি এর বড় প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই না। আল কায়েদা বা আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশে যে নেই, তা বলা যাবে না। এরা সুযোগ পেলেই কথা তুলবে! সব শেষ তথ্যেও জানা গেছে, বাংলাদেশের দুজন জঙ্গি সিরিয়ায় গেছে আল নুসরা ফ্রন্টের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। বেগম জিয়ার বক্তব্যকে অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি স্বাগত জানাই। তিনি কঠোর কোনো কর্মসূচি দেননি। তিনি ভালো করে বোঝেন ও জানেন নেতা ও কর্মীবিহীন রাজপথে হরতাল ডেকে সেই হরতাল সফল করা যায় না। একজন রিজভী আহমেদ পারেননি। জেলে এখন নিঃসঙ্গ জীবন তার। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী এখনো ফুটপাতে শুয়ে আছেনÑ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। কামাল হোসেনের আহ্বান ওই বেইলি রোডেই সীমাবদ্ধ। ২০ দলের ‘একদল এক নেতা’দের কাউকে আমি দেখি না রাজপথে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে। হরতাল-অবরোধে তাদের কাউকে কাউকে দেখি টক শোতে রাতের বেলায় ‘বয়ান’ দিতে। হরতালের সময় যখন ঢাকায় যানজট সৃষ্টি হয়, তখন তারা ড্রইংরুমে বসে ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট’ দেখেন। ‘নিঃসঙ্গ’ বেগম জিয়া যে ৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টতই একটি মেসেজ আছে। প্রথম দুটি শর্ত খুব সহজেই মেনে নেওয়া যায়। তাতে ক্ষতির কোনো কারণ নেই। বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিলে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে বাধ্য। আমরা বারবার বলছি, সংবিধানকে সামনে রেখেই আরেকটি নির্বাচন হতে পারে এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে। সরকার হচ্ছে অভিভাবক। তাই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই।
Daily Amader SOMOY
21.03.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment