রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গ্রিসের ঋণ সঙ্কট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ

গ্রিসের ঋণ সঙ্কট একটি প্রশ্নকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে আর তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে তো? গ্রিসের সাম্প্রতিক নির্বাচনে একটি বামপন্থী সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে। কিন্তু গ্রিস ঋণ সঙ্কটজনিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। গেল সপ্তাহে গ্রিসকে দেয়া আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা তহবিলের মেয়াদ আগে ৪ মাস বাড়াতে সম্মত হয়েছে ইউরোজোন। তবে এর মধ্যে কিছু শর্তও বেঁধে দেয়া হয়েছে। নতুন করে অর্থ সহায়তা না পেলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরকার দেশগুলোর আর্থিক সঙ্কট বার বার সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসছে। ইইউতে অধিভুক্ত একাধিক দেশে এই ঋণ সঙ্কটের কারণে সরকারের পতন ঘটেছে। নতুন নির্বাচন ও নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় ঋণের আর্থিক সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। গ্রিস সর্বশেষ উদাহরণ। ফলে অভিন্ন ইউরোপের ধারণা সন্দেহের মধ্যে থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসাট্রিট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চের চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালের তৎকালিন ইইউর ১৫টি দেশের মধ্যে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু হয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়া সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজী ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, গেল বছরের প্রথম দিকে ইইউর কয়েকটি দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরমে ওঠে। কিন্তু গ্রিসের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। সেখানে পরোক্ষ সরকারের পতন, বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা সর্বশেষ নির্বাচনে বামপন্থী এলেক্সিস গ্রিসের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলেও গ্রিস অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তখন গ্রিস পুনর্গঠনে একটি তালিকা চেয়েছে ইউরো গ্রুপ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সঙ্কট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা ভালো ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু করেছিল তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। ২৭টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মধ্যে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এই দুটো দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি। ইউরোপে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি। সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেকে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না? ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউর সঙ্গে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান হয়ে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যালন্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোর সাবেক সমাজতন্ত্র দেশগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' এই দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্তের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগের ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্য পদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তক, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ওইসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা কিংবা ক্রয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সঙ্কট সব সঙ্কটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার অপেক্ষা বাড়ছে। গেল বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরো মুদ্রা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তর বিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যাঞ্চেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপের কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান। এখন সত্যি সত্যিই কি ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে? 'নতুন ইউরোপ' এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসছে, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়ের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।' অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ঙ্কর কথা কেউ বলেনি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। মন্দাভাব যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামী দুই দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপকে দেখতে পাব। Daily Jai Jai Din 12.03.15

0 comments:

Post a Comment