রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টিপাইমুখ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল

টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। সেখানে একটি যৌথ সমীক্ষা চালানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা আর হচ্ছে না। এ কথাটা আমাদের জানিয়েছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ সংক্রান্ত একটি খবর কোনো কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ৯ মার্চ। অথচ ভারতে বিগত সরকারের সময় এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল যখন টিপাইমুখ বাঁধ দেখতে গিয়েছিল ২০১১ সালে, তখন তারা নয়াদিল্লিতে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। তখন তাদের বলা হয়েছিল, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। সংসদীয় প্রতিনিধি দলটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ২৯ জুলাই (২০১০) টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণাধীন এলাকায় যেতে পারেনি। তারা বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন, ভারত টিপাইমুখে কোনো বাঁধ নির্মাণ করছে না। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এরপর হাটে হাঁড়িটি ভেঙে দিয়েছিলেন ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমাচান্দ পংকজ। তিনি ১১ জুলাই (২০১১) আসামে স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ যথারীতি এগিয়ে নেয়া হবে। (আমার দেশ, ১২ জুলাই ২০১১)। প্রেমাচান্দের ওই বক্তব্য বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুই ভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। ভারত প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে এ বাঁধট নির্মাণ করছে। কয়েক বছরের মধ্যে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। শুধু বাংলাদেশেই নয়। খোদ আসাম ও মণিপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছেন, ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিকভাবে বিপক্ষ হয়ে পড়বে এলাকার বাসিন্দারা। ভারতের পরিবেশবাদীরা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছিলেন, বৃহৎ নদীবাঁধ যে কোনো মূল্যে হচ্ছেই। কেউ বাঁধের কাজ আটকাতে পারবে না। এখন মুখ্যমন্ত্রী গগৈ কিংবা প্রেমাচান্দের মন্তব্যের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছেই। ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। কিন্তু ভারত এমন কিছু করতে পারবে না, যা পার্শ্ববর্তী দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক আইনে এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের সীমান্তের খুব কাছে। ফলে এর থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব, যেমন নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতি বন্যা ইত্যাদির প্রভাব সম্পূর্ণটুকুই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল, ঝিল, বাঁওড়, নদীনালা বালুতে ভরে যাবে। হাওর অঞ্চলের অত্যন্ত উর্বরা ধানের জমি পুরো বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য, তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাবে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাছ, গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এদেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। দেশের অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে ওই বাঁধটি নির্মিত হলে আমাদের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এজন্যই প্রয়োজন ছিল যৌথ সমীক্ষার। এখন ভারত রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশকে দায়িত্বটি নিতে হবে। সরকার স্বউদ্যোগে একটি সমীক্ষা চালাতে পারে। ওই সমীক্ষায় বেরিয়ে আসবে পরিবেশগত কী কী সমস্যা হতে পারে বাঁধ নির্মাণ করার ফলে। বাংলাদেশ দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতাও নিতে পারে সমীক্ষা পরিচালনার জন্য। সমীক্ষার ওই ফল নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসির বৈঠকের কথাও বলা হচ্ছে। এজন্য অতীতের কোনো বাংলাদেশ সরকারকেই দায়ী করা যাবে না। ভারত জেআরসির বৈঠকগুলো ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। জেআরসির বৈঠকের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকলেও ভারতের আগ্রহ ছিল কম। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সে সঙ্গে বিশ্ব আসরে এ সমস্যাটা তুলে ধরাও প্রয়োজন। কেননা পরিবেশগত সমস্যার ব্যাপারে সারা বিশ্ব আজ অত্যন্ত সচেতন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেটা বলা কোনো অপরাধ নয়। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা, ১৯৯২ সালে প্রণীত ডাবলিন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন (জলাভূমিবিষয়ক), জীববৈচিত্র্য কনভেনশন, প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশের অধিকার রক্ষিত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওই আইনে বর্ণিত অধিকার বলেই দেশটির সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। অতীতে ভারত যখন একতরফাভাবে গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক আসরে তার সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। ফলে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত COP-20 সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ ক'টি এনজিও বেসরকারি প্রতিনিধি দল হিসেবে ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। তারাও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারেনি। সারা বিশ্বই আজ বড় বড় বাঁধের ব্যাপারে সোচ্চার। বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়, স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে অনত্র আশ্রয় নেয়- এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই ঘৃণিত একটি কাজ হিসেবে গণ্য হয়। মণিপুরে টিপাইমুখে বাঁধটি নির্মিত হলে ওই এলাকার বেশ কিছু গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাবে। শত শত স্থানীয় আদিবাসী নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবে। আন্তর্জাতিক আইন এটা অনুমোদন করে না। ভারত আরও একটি বিষয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিচ্ছে। টিপাইমুখের আরও উজানে আসামের কাছার জেলার ফুলেরতাল নামক স্থানে (সেচের জন্য) ভারত একটি ব্যারাজ তৈরি করছে। ফলে বরাক নদী থেকে ভারত কিছু পানি প্রত্যাহার করে নেবে। এ বিষয়টি ভারত খোলাসা করছে না। টিপাইমুখ নিয়ে চুক্তির কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও ফুলেরতাল ব্যারাজ নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। টিপাইমুখ নিয়ে মানুষের যে উৎকণ্ঠা তা শুধু বাংলাদেশেই নয়। বরং ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যের মধ্যে তিনটি রাজ্য মণিপুর, আসাম ও মিজোরামেও ওই উৎকণ্ঠা আমরা লক্ষ্য করেছি। এরই মধ্যেই ভারতের ওই রাজ্যগুলোর ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে 'কমিটি অন পিপলস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' (কোপে)। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলে যে ক্ষতি হবে, তার প্রতিবাদ করতেই তারা ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা এখন 'কোপের' সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারেন। কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যৌথভাবেও বিষয়টি উত্থাপন করা যায়। মনে রাখতে হবে, ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা গেছে ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতে ২২৬টি বড় বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করছে, আর লক্ষ্য হবে ৫০ বছরের মধ্যে ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। মুখে মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা যতো আশ্বাসই দেন না কেন, ভারত অত্যন্ত কৌশলে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমরা জেনেছি, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রেও ভারত কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করতে পারে। ভারত অতীতের মতো কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করে আবারও বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে পারে 'তারা এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।' টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এ ধরনের আশ্বাসও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী (মহাজোট সরকার) বেশ ক'বছর আগে একটি সেমিনারে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।' সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মাঝে 'রাজনীতি' কতটুকু কিংবা 'বাস্তবতা' কতটুকু তা ভিন্ন প্রশ্ন। এ মুহূর্তে যা দরকার তা হচ্ছে, ভারতকে ওসব প্রকল্প বাতিল করতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া ও সে সঙ্গে এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে হিমালয় অঞ্চলভুক্ত দেশ ও চীনের সমন্বয়ে একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। আর অভ্যন্তরীণভাবে যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। কেননা টিপাইমুখ বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এখানে সব দলের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। এখন পানিসম্পদমন্ত্রী বললেন, যৌথ সমীক্ষা হচ্ছে না, এখন মন্ত্রী এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ আইনবিদ তথা পরিবেশবাদীদের সঙ্গে বৈঠক করে একটি করণীয় নির্ধারণ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আগামীতে এটা একটা নির্বাচনী ইস্যুও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের সমর্থন পেতে হলে সরকারকে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে বাস্তবমুখী কর্মসূচি নিতে হবে। না হলে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবে। পানিসম্পদমন্ত্রী শুধু 'সমীক্ষা হবে না' বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। আমরা আশা করব, তিনি এখন করণীয় নির্ধারণ করবেন। Daily ALOKITO BANGLADESH 15.03.15

0 comments:

Post a Comment