ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রসচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের ঢাকা সফর শেষ
হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। 'সার্কযাত্রা'র অংশ হিসেবে তাঁর এই ঢাকা সফর।
ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে জয়শঙ্কর তাঁর 'সার্কযাত্রা' শুরু করেন। ঢাকা
হয়ে তিনি গেছেন ইসলামাবাদে। তারপর কাবুল। নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণ করার
পর তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার অংশ হিসেবেই
জয়শঙ্করকে তিনি ঢাকা পাঠিয়েছিলেন। জয়শঙ্করের ২৪ ঘণ্টার ঢাকা সফরে তিনি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদির একটি চিঠি হস্তান্তর করেন।
চিঠিতে নরেন্দ্র মোদি ঢাকা আসার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। একই
সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে নয়াদিল্লি সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে এটা
ঠিক, নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর চূড়ান্ত হয়নি এখনো। তারিখ নির্ধারিত হয়নি।
তবে ২৬ মার্চ তাঁর ঢাকা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা করছি, আগামী ৯ মার্চ
নয়াদিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর মোদি তাঁর ঢাকা
সফর চূড়ান্ত করতে পারেন। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতা কোনো 'মেসেজ' দেবেন,
এটাই সবাই ধারণা করছেন। হয়তো মোদির ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির
ব্যাপারে একটা সুখবর তিনি দিতে পারেন। এ জন্যই মোদি-মমতা বৈঠকটি বেশ
গুরুত্বপূর্ণ। জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের সময় তিস্তাসহ অন্যান্য বিষয় আলোচনা
হয়েছে। তবে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। তিনি কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করে বিভিন্ন
প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তার কিছুটা আভাস আমরা
পেয়েছিলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময়। তাঁকে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে তাঁর সফরের গুরুত্ব আমরা
বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। জাপান সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ হলেও জাপানি
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এই সংবর্ধনা পাননি। তার পরও সুষমা স্বরাজের
ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে কোনো
ইতিবাচক মনোভাব আমরা লক্ষ করিনি। তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে যে সমস্যা
ছিল, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরের পরও রয়ে গেছে। কৌশলী মমতা
'আস্থা' রাখার কথা বলে গেলেও এটা বলতে ভোলেননি যে 'দুই দেশের স্বার্থ
বিবেচনা করে পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান' হবে। এ ক্ষেত্রে মেসেজটা স্পষ্ট-
পশ্চিম বাংলার স্বার্থ উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো
চুক্তি করতে পারবে না। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। সুতরাং
কৌশলী মমতা 'তিস্তা কার্ড'টি কখনোই বিজেপির হাতে তুলে দেবেন না। তবে
স্থলসীমানা চুক্তিটি ভারতীয় লোকসভায় চলতি বাজেট অধিবেশনেই পাস হবে। কেননা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আপত্তি তুলে নিয়েছেন। আসাম বিজেপির আপত্তিও নেই।
ফলে এই একটি ক্ষেত্রে আমরা সমাধানটা পেয়ে যাচ্ছি। নরেন্দ্র মোদি আন্তনদী
সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের জন্য এটা নিঃসন্দেহে
একটি চিন্তার কারণ। তিস্তায় যেমন পানি নেই, তেমনি চুক্তি করার পরও পদ্মায়
পানি হ্রাস পেয়েছে। এখন ভারত যদি শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পরিবেশবাদীদের
বিরোধিতা করে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের
নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে যাবে।
ভারত গেল ছয় বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করিডর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল
থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। চলতি বছরই বহুল
বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে
ভারতের স্বার্থ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ
সমস্যা সমাধানের যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তা থেকে
যাচ্ছে উপেক্ষিত। ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব
মুখার্জি ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলারের অনুদান দিয়েছিলেন। প্রায় ১৪টি প্রকল্পে
এই অর্থ ব্যয় করার কথা। কিন্তু প্রকল্পের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। ভারতের
সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ
ছিল ২.৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩.৫০ বিলিয়ন ডলারে।
সর্বশেষ তথ্য নিলে দেখা যাবে, ঘাটতির পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলারকেও (অর্থাৎ
৪০০০ মিলিয়ন) ছাড়িয়ে গেছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি এখন ভারত ব্যবহার করছে তার
স্বার্থে। অথচ ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বিশাল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শুল্ক ও
অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে
ভারতের পক্ষ থেকে কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়ের কথা বলা হয় বটে, কিন্তু অনেক
ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বাংলাদেশ ওসব পণ্য উৎপাদন করে না। ভারত আমাদের জমি
ব্যবহার করছে তথাকথিত 'কানেকটিভিটি'র নামে। কিন্তু কোনো 'ফি' প্রদান করছে
না। উপরন্তু নেপাল ও ভুটান এ সুবিধা পাচ্ছে না। ভারত এখন অব্দি এ দুটো
দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়নি।
নরেন্দ্র মোদি তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তবে দুটো দেশে, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায়, ভারতের 'একটি' ভূমিকা এই অঞ্চলে
ভারতের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উভয় দেশেই ভারতের ভূমিকা চীনের
স্বার্থকে আঘাত করেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয়ের
পেছনে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল বলে সংবাদপত্রে খবর হয়েছে। সিরিসেনা
চীনের প্রভাব থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। সাবেক
প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ছিলেন অতিমাত্রায় চীননির্ভর। প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে
সিরিসেনার নয়াদিল্লি সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠ করেছে। নরেন্দ্র
মোদি তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভুটানে গিয়েছিলেন। অতীতে ভারতের কোনো
সরকারপ্রধানই ভুটানকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। ভুটান-ভারত বাণিজ্যিক
সম্পর্কও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে ভুটানের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব
রয়েছে। আর এটা বিবেচনায় নিয়েই মোদি ভুটানে গিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ভুটান
সফরের পর যেসব সিদ্ধান্তের কথা জানা গিয়েছিল, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
যেমন- ভুটানে মোদির সফরের পরপরই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোগবে এক
বিবৃতিতে বলেছিলেন, ভুটানে দূতাবাস খুলতে চীনকে অনুমতি দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি খুব
তোড়জোড় শুরু করেছে চীন। চীনের এই উদ্যোগে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ভারত।
শুধু তা-ই নয়, সফর শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, 'জাতীয় স্বার্থে দুই দেশ
(ভারত ও ভুটান) একে অপরকে সাহায্য করবে।' মোদির ভুটান সফর ও যৌথ বিবৃতি
প্রকাশিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভুটান ও ভারতের নিরাপত্তাজনিত
উদ্বেগ একই। ভারতের সীমান্তে চীনের 'আগ্রাসন' আর ভুটানের উত্তরেও চীনের
'আগ্রাসন' একই রকমের উদ্বেগের কারণ। চীনের সম্ভাব্য 'আগ্রাসন' রোধে ভারত ও
ভুটান একে অপরকে সাহায্য করবে বলেও যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। শুধু
তা-ই নয়, ভারতের জি নিউজ আমাদের জানাচ্ছে যে ভারত চীন সীমান্তে দ্বিগুণ
সেনা মোতায়েন করছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চীন
শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং চীনা হামলা বাড়ছে। বলা ভালো, ভারত-চীন সীমান্তে
ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশের ৪০টি ঘাঁটি রয়েছে। মোতায়েন রয়েছে ১৫ হাজার
সেনা। এখন দ্বিগুণ সেনা মোতায়েনের বিষয়টি ও ভুটানে চীনা দূতাবাস না খোলার
সিদ্ধান্ত ভারত-চীন সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। অথচ বলা হয়েছিল, মোদির
জমানায় চীন-ভারত সম্পর্কে উন্নতি হবে। এমনকি মোদির শপথ নেওয়ার পরপরই চীনা
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর এই আভাসই দিয়েছিল যে এই দুই দেশের মধ্যে
সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এখন মনে হচ্ছে চীনের ব্যাপারে মোদির মনোভাবে
পরিবর্তন এসেছে। চীনকে ভারত এখন এ অঞ্চলে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে
মনে করছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে চীন নাক গলাক, তা ভারত কোনোভাবেই চাইবে না।
আমরা মোদির শাসনামলে 'ইন্ডিয়া ডকট্রিনের' নতুন এক রূপ দেখতে পাব। মোদির
ভুটান সফরের সময় চীন প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আলোচিত হলেও বাংলাদেশে সুষমা
স্বরাজের সফরের সময় এ প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে আসেনি। তবে একটা খবর এসেছে যে
চীনা অর্থায়নে সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল, তা
ভারত তার নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে। ভারত মনে করে, এটি নির্মিত হলে
এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়বে। একই সঙ্গে চীনা পণ্যে এ অঞ্চল সয়লাব হয়ে
যাবে এবং প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্য মার খাবে। এখন গভীর সমুদ্রবন্দরটি
নির্মিত হচ্ছে পায়রাবন্দরে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএম
(বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার)-এর ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল।
ভারতের নয়া পররাষ্ট্রসচিব ঢাকা ঘুরে গেলেন। বাংলাদেশ সুযোগ পেয়েছে
বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরের ফলও জেনেছেন
জয়শঙ্কর। এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের ব্যাপারেও আলোচনা
করেছেন তিনি। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। ভারত আমাদের উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে
পারে। আমরা সেটা চাইও। কিন্তু ভারতের আমলাতন্ত্র যদি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার
দৃষ্টিতে না দেখে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি তা
থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। আমরা চাইব, ভারতের মোদি সরকার বাংলাদেশের
সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আন্তরিক হবে এবং সমাধানের উদ্যোগ নেবে। জয়শঙ্করের
ঢাকা সফরের পর এই সমস্যাগুলো বোঝার একটা ক্ষেত্র এখন তৈরি হয়েছে।
Daily Kaler Kontho
04.03.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment