রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে ছবি কথা বলে

একটি ছবি ছাপা হয়েছে প্রতিটি সংবাদপত্রে ১ মার্চ। একটি বাচ্চার করুণ কাহিনী, মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। নাম না জানা এ শিশুর কাহিনীর জন্ম অগ্নিদগ্ধ ও ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া চালকের সহকারী মোঃ শাকিলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। ১৮ বছরের শাকিল এখন না ফেরার দেশে। আর হাসপাতালে এসে এক মায়ের আহাজারির দৃশ্য ফোকাস বাংলার মাধ্যমে পৌঁছে গেছে প্রতিটি মিডিয়ায়। শাকিলের মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে বালকটি, বোধকরি শাকিলের ভাই সে। তার করুণ ছবি, ক্যামেরায় তোলা সেই ছবি যে কোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আশিয়ান ট্রান্সপোর্টের গাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে, যখন শাকিল গাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল। মাত্র ১৮ বছরের এক যুবক। যাকে নিয়ে সংবাদপত্র লিখবে না। হয়তো আমাদের সংবাদকর্মীরা আর তার খোঁজও নেননি। খোঁজ নিলে দেখা যেত, এ শাকিলই ছিল ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। একজন বাস সহকারী, কতই বা তার আয়? হয়তো ওই আয়েই কোনো মতে সংসার চলত। হয়তো বাবা-মাকে সাহায্য করার জন্যই তার এ পেশায় আসা। সে এখন চলে গেছে না ফেরার দেশে। যে ছোট্ট বাচ্চাটার ছবি ফোকাস বাংলা তুলেছে, তার করুণ কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে 'রাজনীতির' নামে গত প্রায় ৬০ দিনে এ ধরনের অনেক শাকিলের পরিবারকে অসহায় করে দিয়ে গেছে। রাজনীতির নামে সহিংসতার শিকার হয়েছে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ। যারা আর্থিকভাবে বিত্তবান, তাদের ক্ষতি হয়েছে কম এবং যারা রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় আছেন বা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে চান, তাদের ক'জন মারা গেছেন? তাদের ক'জনইবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন? সংবাদপত্র আমাদের সাক্ষী। সংবাদপত্রগুলো খুঁজে দেখলে এ শ্রেণীর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যখন শাকিলের খবর পত্রপত্রিকায় পড়ছি, তখন তার একই সময় ছাপা হওয়া আরেকটি ছোট সংবাদে আটকে গেল আমার চোখ। তবে পার্থক্য হলো অগ্নিদগ্ধ শাকিল মারা গেলেও ছোট্ট ফারজানা বেঁচে আছে। ছোট্ট ফারজানার ওই ছবি ও সেইসঙ্গে একটি প্রশ্নও ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে ২৬ জানুয়ারি। রামেকের বার্ন ইউনিটের বেডে বসে আছে ফারজানা। ৫ বছর বয়সী এ বাচ্চাটার পেট্রলবোমার আগুনে মুখের বাম পাশ পুড়ে গেছে। আঘাতে বাম চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের নিচ থেকে থুতনি পর্যন্ত দগদগে ঘা। ফারজানার অভিযোগ, 'আমি কিছু করিনি, মানুষ আমাকে পুড়াইলো ক্যান?' ফারজানার এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সাংবিধানিকভাবে এখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি দেবেন এ প্রশ্নের জবাব? খালেদা জিয়া, যিনি সরকার পতনের ডাক দেয়ায় জন্ম হয়েছে এ সহিংস রাজনীতির, তিনি দেবেন এ প্রশ্নের জবাব? সংবাদপত্রের ভাষায় 'দুর্বৃত্তরা'ই এ পেট্রলবোমা ছোড়ে। তাদের নাম-ঠিকানা মাঝেমধ্যে ধরা পড়লে ছাপা হয় বটে, কিন্তু রাজশাহীর তানোরে বাসে যে বা যারা পেট্রলবোমা ছুড়ে ফারজানাকে আহত করল, তারা গ্রেফতার হয়নি। ধরা পড়লে ওদের কাছে জানতে চাইতাম কেন ওরা এ কাজটি করল? এ পেট্রলবোমার সংস্কৃতি যে আমাদের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বোধকরি কেউই এটা বুঝতে চাইছি না! বুঝতে না পারাটা অস্বাভাবিক। বুঝতে চাইছি না! আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুষ্ঠুভাবে বলা আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।' কিন্তু মানুষ যখন দগ্ধ হয়, তখন তার মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বৈকি! সংবিধানে চলাফেরার স্বাধীনতা (৩৬ নং অনুচ্ছেদ) নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নামে যারা বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ছে, তারা তো সংবিধানের ওই ধারাকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে! এ থেকে আমরা বের হয়ে আসব কীভাবে? কে দেবে আমাদের এ নিশ্চয়তা? রাজনীতির নামে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফারজানা কিংবা শাকিলের 'স্বপ্ন' নস্যাৎ করেছে এ 'নষ্ট রাজনীতি'। এ নষ্ট রাজনীতি থেকে যদি আমরা বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আগামী প্রজন্মের শাকিলরা আমাদের ক্ষমা করবে না। পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা কিংবা অসহিষ্ণুতা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারবে না। বর্তমান যে সঙ্কট, সেই সঙ্কট রাজনীতিবিদদেরই কাটিয়ে উঠতে হবে। কোনো 'তৃতীয় শক্তি' এর সমাধান করতে পারবে না। যারা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দিকে হাত বাড়ান, তারাও ভুল করছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন আমরা পার করছি। আর প্রতিদিনই পেট্রলবোমা আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটগুলোতে অগ্নিদগ্ধ মানুষের করুন কাহিনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। ছোট্ট শিশুরা অগ্নিদগ্ধ বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রশ্ন রাখছে- সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে তাকে মানুষ পোড়াল কেন? এ প্রশ্নের জবাব কারও কাছে নেই। সাধারণ মানুষ জানেও না এ পরিস্থিতির অবসান হবে কীভাবে? বা কখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে দেশ? এমনিতেই অবরোধের মাঝে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে খুব বেশি যানবাহন না এলেও, খোদ রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়মিতভাবে ক্লাস হচ্ছে। ভয়ের মাঝেও মানুষ তার নিত্যদিনের কাজ করে নিচ্ছে। কিন্তু তাদের মাঝে আছে অসন্তোষ আর রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ। এ পরিস্থিতিতেও দোষারোপের রাজনীতি আমরা লক্ষ্য করছি। সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরকে অভিযুক্ত করছে। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। তাদের দাবি, ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতির জন্ম হতো না। পরস্পর দোষারোপের মধ্য দিয়ে এক অসহিষ্ণু রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে। এ বড় দল দুটোর বাইরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সরকারের 'বিশেষ দূত' এইচএম এরশাদ ৫ ঘণ্টা অনশন পর্যন্ত করেছেন ৩০ জানুয়ারি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এখনও অবস্থান ধর্মঘট করছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে আরও দুইটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। একটি, নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেফতার হয়েছেন। দ্বিতীয়টি, একজন বাংলাদেশী-আমেরিকান অভিজিৎ রায় জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। দুটো ঘটনাই চলমান রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে অভিযোগে মান্না গ্রেফতার হয়েছেন, তাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ সংঘটিত করা (?) কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই-একটি লাশ ফেলে দেয়া, শুধু নিন্দনীয়ই নয়, বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধও। আমার ভাবতে অবাক লাগে, মান্নার মতো একজন রাজনীতিবিদ কী করে এ কাজটি করলেন? অভিজিতের হত্যাকা-ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, তিনি একজন আমেরিকান নাগরিক। ফলে তদন্ত করতে এফবিআই বাংলাদেশে এসেছে এবং কাজ শুরু করেছে। তাদের তদন্তে কী বেরিয়ে আসবে, আমরা জানি না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে একটা বাজে ধারণার জন্ম দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এরই মধ্যে ১৬ জন রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করেছেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী প্রায় ২ ঘণ্টা কূটনীতিকরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। কূটনীতিকরা সহিংসতা বন্ধ ও পারস্পরিক আস্থা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের জানিয়েছেন, সংলাপের উদ্যোগ নিলে কর্মসূচি তিনি প্রত্যাহার করে নেবেন। তবে সংলাপের ব্যাপারে সরকার রাজি, তা তারা স্পষ্ট করেননি। এমনকি সিনিয়র মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, কোনো সংলাপ হবে না। এরই মধ্যে ৪ মার্চ কোর্ট খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এর আগে জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রেখেছেন। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমরা আমাদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না। এভাবে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কতটুকু উন্নত করবে, এটা আমাদের রাজনীতিবিদরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন। ৩ মার্চ পর্যন্ত অবরোধের ৫৭ দিন অতিক্রম করেছে। আর হরতালের ব্যাপ্তি বেড়েছে ৬ মার্চ পর্যন্ত। ধারণা করছি, আবারও হরতালের ডাক দেয়া হবে। ঢাকা শহরের দিকে তাকালে বোঝা যায়, হরতাল সেভাবে পালিত হচ্ছে না। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মধ্যে গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলার সংখ্যা বাড়ছে। অবরোধ আর হরতালের যে পরিসংখ্যান সংবাদপত্রগুলো আমাদের দিচ্ছে, তাতে দেখা যায়, অবরোধের ৫৭ দিন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১১৫ জন, এর মাঝে আগুন-বোমায় মারা গেছেন ৬৪ জন। ক্রসফায়ারে মারা গেছেন ৩১ জন। ৭৯১টি গাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। আর ভাংচুর হয়েছে ১ হাজার ২৯টি। এ পরিসংখ্যান আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। এর শেষ কোথায়, তাও আমরা জানি না। ভয়টা হচ্ছে অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়ে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, এ সংস্কৃতি থেকে আমরা আদৌ বের হয়ে আসতে পারব কিনা? ১ মার্চ সংবাদপত্রে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, ওই বাচ্চার করুণ চাহনী আমাকে এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। এ ছবি আমরা আর দেখাতে চাই না। এ সংবাদ সংবাদপত্রেও আর দেখতে চাই না। রাজনীতির সনাতন যে চিত্র, সেটাই আমরা দেখাতে চাই। রাজনীতিবিদদের মাঝে প্রতিযোগিতা থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে, ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা থাকবে। কিন্তু 'পেট্রলবোমা'র রাজনীতি কোনো সুস্থ রাজনৈতিক ধারার কথা বলে না। আমাদের সবার মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এটাই শুধু কামনা করতে পারি আমরা। শাকিলের মৃত্যু, আর ফারজানাদের 'অসহায়ত্ব' এর ছবি দেখেও আমরা যদি কিছু না 'শিখি' সেটা হবে বড় দুঃখের এবং কষ্টের। Daily ALOKITO BANGLADESH 08.03.15

0 comments:

Post a Comment