রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভুবনেশ্বর সম্মেলন আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ২০-২২ মার্চ। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোর (মোট ২০টি দেশ) একটি সংস্থা হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ বা সংক্ষেপে আইওআর। আর আইওআরের শীর্ষ সম্মেলন ছিল এটি। শীর্ষ সম্মেলন শেষে ‘ভুবনেশ্বর ঘোষণাপত্র’ও স্বাক্ষরিত হয়। এখন আমাদের মতো ছোট দেশগুলোর জন্য এই ভুবনেশ্বর ঘোষণার গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভুবনেশ্বর সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। শীর্ষ সম্মেলনের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভারত ও ভারত মহাসাগর সম্মেলন।’ এ থেকেই বোঝা যায়, সম্মেলন আয়োজন করার পেছনে ভারতের উদ্দেশ্য কী। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আর এন রবি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে আমাদের কাছে। সম্মেলনে সুষমা স্বরাজ সুস্পষ্ট করেই বলেছেন, ভারত মহাসাগরে চিনের প্রবেশ ভারতের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। আর শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তা আর এন রবি বলেছেন, ভারত মহাসাগরকে কোনোভাবেই শক্তিশালী দেশগুলোর দাবার বোর্ড বানাতে দেওয়া যাবে না। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের কর্তৃত্ব থাকলে এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকবে (আনন্দবাজার, ২১ মার্চ)। বার্তাটি স্পষ্টÑ এ অঞ্চলে ভারত কাউকে প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছিলেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার ভারত ভারতীয় মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং এ জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। ফলে ভারত মহাসাগরে আগামী দিনে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এই দুটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষণীয়। দক্ষিণ চিন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চিনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মাল্লাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চিন। কারণ এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চিনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ স্টান ফিট’-এ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চিন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয় চিন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চিনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর।’ স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্নÑ এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এই দুটো বড় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এটাকেই কাজে লাগাতে চয় যুক্তরাষ্ট্র।এক সময় মার্কিনি গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চিন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত একটি প্রবন্ধে ঈযরহফরধ (অর্থাৎ চিন-ভারত) এর ধারণা দিয়েছিলেন। নয়া চিনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হচ্ছিল যে, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, ওবামার ভারত সফর এবং চিনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চিন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য) এর যে ধারণা ছিল, শ্রীলঙ্কায় সিরসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চিনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চিন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিসিএম’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারতের ওই কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে এখানে মার্কিনি স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থের অপর একটি কারণ হচ্ছে চিন। চিনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত সম্পর্কে নিজেদের জড়িত করেছে। এই দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুদেশের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষকের লেখনীতে এটা মন্তব্য করা হচ্ছে যে, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তিÑ চিন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এই অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চিনের সঙ্গে যে বিপদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা ‘অন্য চোখে’ দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চিনা কর্তৃক, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগ চিনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সিল্ক রোডের মাধ্যমে চিনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চিনের প্রভাব বেড়েছিল। চিনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চিনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথাও আমরা জানি, যা কি না চিনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ বছর আগের। এ মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চিনা এডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল- এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চিনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। চিন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েকশ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চিন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্পষ্ট নয়, ভারত-চিন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চিন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থ যদি পরস্পরবিরোধী হয়, তাহলে সংঘর্ষ অনিবার্য। মোদির মে মাসে চিন সফরের আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাসের যাত্রা সহজ করতে চায় ভারত। চিন এ ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন কৈলাসে যেতে হয় উত্তরাখ-ের কাঠগোদাম থেকে হেঁটে। এটা কষ্টদায়ক ও পথটি দুর্গম। পথটিও দীর্ঘ। অথচ কৈলাসে গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব। গ্যাংটকের পাশেই নাথুলা। রাস্তাও ভালো চিনের দিকে। চিন অনুমতি দিলে গাড়িতে করেই তীর্থযাত্রীরা কৈলাসে যেতে পারবেন। মোদি নিজেও এ পথে কৈলাস যেতে চান। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় চিনা প্রভাব কমাতে মোদির উদ্যোগ আদৌ কোনো ফল দেবে কি না, এটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে মোদি চিনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুন না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’-এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। তাই এই সমুদ্র পথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে। ভুবনেশ্বর সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করল। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, ভারত এ অঞ্চলের অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। চিনা নেতারা ভারতীয় এই ভূমিকাকে যে খুব সহজভাবে নেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Amader Somoy 29.03.15

0 comments:

Post a Comment