শেষ
পর্যন্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ২৮ এপ্রিল এ
নির্বাচন। এ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দলই প্রার্থী
ঠিক করে। তবে এটা সত্য, দলীয় মার্কা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যবহার করা
যায় না। দলীয় প্রার্থীরাই নির্বাচন করেন। দল তাদের ঠিক করে। দলীয় পতাকাতলেই
দলীয় প্রার্থীরাই নির্বাচন করেন। আমরা বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময় দেখেছি,
সেখানে দলীয় প্রার্থীরাই অংশ নিয়েছিলেন এবং অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ওই
নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। গেল বছরের
মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু
হয়েছে, এটা বলা না গেলেও, পরিসংখ্যান বলে ৪৮৭টি উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি
সমর্থিত প্রার্থীরা ব্যাপক সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছিলেন। বিশেষ করে, প্রথম ও
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা তুলনামূলক বিচারে বেশি
সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা
দক্ষিণের এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া
যাবে না। এ তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
এরই
মধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থীর নাম
ঘোষণা করেছেন এবং আমরা যারা ঢাকা শহরে বাস করি, এ দুই প্রার্থীর, একদিকে
আনিসুল হক ও অন্যদিকে সাঈদ খোকনের ব্যানার, বিলবোর্ডে তাদের দুজনের
উপস্থিতি লক্ষ্য করি। এর বাইরে হাজী সেলিমের বিলবোর্ডেও ছেয়ে গেছে ঢাকা
শহর। হাজী সেলিম কিংবা কামাল মজুমদার দুজনই প্রার্থী হতে আগ্রহী এবং
প্রকাশ্যে তারা প্রার্থী হওয়ার খায়েশও প্রকাশ করেছেন। চূড়ান্ত বিচারে
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে তারা প্রার্থী হবেন, এটা আমার
মনে হয় না। তবে এটা তো সত্য, হাজী সেলিম ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও তিনি আওয়ামী
লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। মজার
ব্যাপার, আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামে তিনি বক্তব্য না রাখলেও নৌকা সমর্থক
গোষ্ঠীর ব্যানারে তিনি প্রায়ই সেমিনার করেন এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা
সেই সভায় বক্তব্যও রাখেন। সংসদে তার অবস্থান একজন স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে
এবং দলীয় সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সংসদ নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে
বহিষ্কারও করা হয়নি। এখন যে প্রশ্নটি অনেকেই করেন তা হচ্ছে, বিএনপি কি এ
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে? খালেদা জিয়া কি মেয়র পদে তিনজন প্রার্থী
বাছাই করবেন? নাকি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছাড়াই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন
সম্পন্ন হবে?
আমি এটা বিশ্বাস করতেই পারি যে, খালেদা জিয়া ১৩
মার্চ সংবাদ সম্মেলনে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেই প্রস্তাবের ব্যাপারে
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা তিনি বিবেচনায় নিতে পারেন। যদিও তিনি কোনো শর্ত যোগ
করেননি, তবে একটা 'বরফ গলা' পরিস্থিতি প্রত্যাশা করছেন এদেশের মানুষ। যদিও
সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায়, সরকার
খালেদা জিয়ার কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই আদৌ আগ্রহী নয়। ফলে প্রার্থী
নির্বাচনের ব্যাপারে খালেদা জিয়া বা বিএনপির হাইকমান্ড কোনো মন্তব্য করবেন
না। একইসঙ্গে খালেদা জিয়া একটু কৌশলী হতে পারেন। কেউ যদি নির্বাচন করতে
চায়, যারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাতে খালেদা জিয়ার আপত্তি থাকবে
না। খালেদা জিয়া একটি 'রাজনীতির বল' প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ সরকারের দিকে ঠেলে
দিয়েছেন।
সরকার এখন 'বল'টি কীভাবে খেলে, সেটাই আমাদের দেখার
পালা। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সরকার এরই মধ্যে এ
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২০১৯ সালের আগে আর
সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা আমরা
সংবিধানের বাইরে যেতে পারব না। আর সংবিধানই আমাদের বলছে ৫ বছর পর পর
নির্বাচনের কথা।
এখন সংলাপ হচ্ছে না। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে দেশ?
আল জাজিরাতে যে প্রতিবেদনটি দেখলাম, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
গত অর্থবছরের চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। আর গত জানুয়ারি থেকে এ
পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। সেইসঙ্গে এটাও সত্য, জিডিপি
প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে-এটা প্রায় সবাই বলছেন। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশে
প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কট পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক
ব্যবস্থাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে, এত হরতাল-অবরোধের পরও
প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। এর অর্থ কলকারখানায় প্রায়
'স্বাভাবিক অবস্থা' বিরাজ করছে। রফতানি খাতে কিছুটা শ্লথ গতি এলেও খুব বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরকারের সার্থকতা এখানেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এ
'অস্থিরতার' একটা সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ 'সমাধান'টা করতে হবে দুটো বড়
দলকেই। বুদ্ধিজীবীরা কিংবা বিদেশি দূতরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না।
সে সঙ্গে এ 'পেট্রলবোমা'র সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে যে
বিভেদ ও বিদ্বেষ, তা কাটিয়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন ও জরুরি। না হলে অসাংবিধানিক
শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিভিন্ন ধরনের 'ষড়যন্ত্র'র কথা আমরা শুনেছি,
দেশে ও দেশের বাইরে। সেনাবাহিনীকে জড়িত করানোর একটা 'নগ্ন ষড়যন্ত্র'
সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁস করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে
মন্তব্য করেছেন। একটা ভয় আছে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে। রাজনীতিবিদরা যখন
ব্যর্থ হন, তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এটা ইতিহাসের কথা। তত্ত্বের
কথা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলি, আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের ঘটনাবলি এর বড়
প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশকে এ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই না। আল কায়দা না আইএসের
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশে যে নেই, তা বলা যাবে না।
এরা সুযোগ পেলেই ফণা তুলবে। সব শেষ তথ্যেও জানা গেছে বাংলাদেশের দুজন জঙ্গি
সিরিয়ায় গেছে আল নূসরা ফ্রন্টের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য।
খালেদা
জিয়ার বক্তব্যকে অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমি স্বাগত জানাই। তিনি কঠোর কোনো
কর্মসূচি দেননি। তিনি ভালো করে বোঝেন ও জানেন নেতা এবং কর্মীবিহীন রাজপথে
হরতাল ডেকে সেই হরতাল সফল করা যায় না। হরতাল হোক আর না হোক হরতাল ডাকা
হচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ যখন
ঘোষিত হলো, তখন সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি খালেদা জিয়ার দিকে
থাকবে- তিনি কি ঘোষণা দেবেন এখন? পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে। ঢাকা শহরের
নেতারা জেলে অথবা ফেরারি। মহানগরী কমিটি গঠিত হলেও তাদের কোনো কর্মকা- চোখে
পড়ে না। কর্মীরা রাস্তায় নামতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
ভয়ে। সরকারি দলের সমর্থক এবং প্রার্থীরা যেখানে সরব, সেখানে বিএনপি নীরব।
বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে একটা বড় হতাশা। এক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থকদের
কেউ যে প্রার্থী হবেন না, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। প্রার্থী হতে
পারেন কেউ কেউ। আর খালেদা জিয়ার 'নীরব' সমর্থন তাতে থাকতেও পারে।
স্পষ্টতই
বিএনপি নেতারা একটি বড় ধরনের ডায়ালেমা 'ফেস' করছেন। একদিকে নির্বাচনে
প্রার্থী হয়ে জনসমর্থন আদায় করা, অন্যদিকে নির্বাচনকে 'প্রতিহত' করা- দুই
'সম্ভাবনাই' 'উজ্জ্বল'। কোনটি করবে এখন বিএনপি? জনপ্রিয়তা যাচাই করার জন্য
বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে? নাকি বয়কটের ডাক দেবে? বয়কটের
ডাক দিলেও কি মানুষ তাতে কর্ণপাত করবে? খোদ ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগের হাজার
হাজার কর্মী রয়েছেন। তাদের তো 'আটকানো' যাবে না। তারা তো ভোট কেন্দ্রে
যাবেই। এক্ষেত্রে 'খালি মাঠ' পেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা একাই
'গোল' দিতে পারেন!
সরকার যদি বড় বড় দলের প্রার্থীদের নির্বাচনে
নিয়ে আসতে না পারে, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনিতেই ৫
জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার বেকায়দায় আছে। আর এখন আবার ২৮ এপ্রিলের
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন? এদিকে এ নির্বাচনে সিপিবি তাদের প্রার্থী দিলেও
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ১৮ মার্চ বলেছেন, '৫ জানুয়ারির
প্রহসনের নির্বাচনের পথ অনুসরণ করে আবারও ছলচাতুরী ও তামাশার নির্বাচনের
আয়োজন করেছে সরকার।' (বাংলা নিউজ২৪, ১৯ মার্চ)। ফলে নির্বাচন নিয়ে একটা
শঙ্কা থাকলই। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও মেয়র প্রার্থী কিংবা কাউন্সিলর
প্রার্থী নিয়ে বিবাদ আছে। ফলে সিটি করপোরেশন নিয়ে প্রত্যাশিত যে নির্বাচন
সেটি হচ্ছে, এটা আশা করতে পারছি না। তারপরও এ নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল। সেটি
এখন হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না-ই করে,
সেটা সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও কোনো সুখের কিছু হবে না।
Daily ALOKITO BANGLADESH
22.03.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment