রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গণতন্ত্রের নয়ামাত্রা : শ্রীলংকা ও দিল্লির অভিজ্ঞতা

সম্প্রতি শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের হেরে যাওয়া এবং এর পর পরই ভারতের দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির বিজয় গণতন্ত্রের নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও যে হেরে যেতে পারেন, শ্রীলংকায় রাজপক্ষের পরাজয় সেটিই প্রমাণ করল আবার। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দলের সমন্বয়েও যে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করা যায়, এটাও সেখানে প্রমাণ করেছেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল কথাটাই হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দলগুলোর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। তা গণতান্ত্রিক তত্ত্বে বলা হয়, কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস বা সিবিএম। এই সিবিএমেরই আমরা প্রকাশ দেখলাম দিল্লির বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির অভাবনীয় বিজয়ের পর রামলীলা ময়দানে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভাষণের মধ্য দিয়ে। একতরফাভাবে তার এই বিজয় নিয়ে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। এমনকি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী কিরণ বেদি সম্পর্কেও তিনি কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। বরং বলেছেন, কিরণ বেদিকে আমি সম্মান করি। নির্বাচনী লড়াইয়ে হারজিত থাকবেই। তিনি আমার বড় দিদির মতো। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার পরামর্শ মতো চলব। এটা তিনি না বললেও পারতেন। কেননা আগামী পাঁচ বছর দিল্লির রাজ্য শাসনে তাকে বিজেপির মতামত বা পরামর্শ না নিলেও চলবে। কেননা বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপির আসন মাত্র ৩টি। আবার ওই তিনটি আসনের মধ্যে আবার কিরণ বেদির আসনটিও নেই। অর্থাৎ দিল্লির বিধানসভায় বিজেপি আছে বটে কিন্তু সাংবিধানিকভাবে দিল্লি বিধানসভায় কোনো বিরোধী দল থাকবে না। অরবিন্দ কেজরিওয়াল শুধু কিরণ বেদির কথাই বলেননি, বলেছেন অজয় মাকেনের কথাও। মাকেন ছিলেন কংগ্রেসের নেতা। আর কংগ্রেস একটি আসনও পায়নি দিল্লি বিধানসভায়।
গণতন্ত্র নিয়ে যারা ভাবেন, বলেনÑ তাদের কাছে এ দুটি দেশের ঘটনার গুরুত্ব অনেক। গণতান্ত্রিক সমাজে পরস্পরের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকতে হয়। না হলে সমাজ অহিংস হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক ভাবধারা ভেঙে পড়ে। সমাজ একদলীয় হয়ে পড়ে। সিরিসেনার অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তো মাত্র দুই বছরের। দুবছরের একটি দল নিয়ে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আসলে শ্রীলংকা বলি ও নয়াদিল্লির বিধানসভার নির্বাচন বলি, বিজয় হয়েছে গণতন্ত্রের। ব্যক্তি এখানে মুখ্য নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষাÑ যেখানে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জনরায়ে হেরে যান। হেরে যাওয়ার আগেই রাজাপক্ষে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কোনো আপত্তির কথা তার সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। কোনো সূক্ষ্ম কারচুপির কথাও আমরা শুনিনি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আবার জনসমর্থন না থাকলে জোর করে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করেও ক্ষমতায় থাকা যায়। রাজাপক্ষের বিদায় এটাই প্রমাণ করেছিল আবার। অথচ রাজপক্ষে এক সময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শ্রীলংকাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকা সেনাবাহিনীর বিজয় নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও এটা প্রমাণিত হয়েছিল, রাজাপক্ষে যদি ওই সময় টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা না করতেনÑ তাহলে সম্ভবত শ্রীলংকা এর রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারত না। এখানে বলা ভালো, রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেখানে গণতন্ত্রের পরিপন্থী এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করে তিনি শ্রীংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিককরণের। তার দুভাই, ছেলেÑ তারা সবাই সরকারের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটাতেন। এই পারিবারিককরণ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ খুব ভালোভাবে নেয়নি। তামিল টাইগারদের পরাজিত করে তার জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার কথা আরও দুবছর পর। তৃতীয় টার্মে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না। এক্ষেত্রে সংবিধান অন্যতম বাধা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাপক্ষে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজের জন্য তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ধারণা ছিল, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিবতা করার মতো কোনো উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাবে না বিরোধী দল। কিন্তু তার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিথ্রিপাল সিরিসেনা যে স্বয়ং তাকেই চ্যালেঞ্জ করবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। এক সময় সিরিসেনা তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সিরিসেনা গত অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাজাপক্ষেকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। আস্থার প্রতীক হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি কোনো প্রার্থী দেয়নি। বরং তারা একত্র হয়ে সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নির্বাচনে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন করেন। নির্বাচনের আগে সিরিসেনার সঙ্গে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির যে সমঝোতা হয়েছিল, এর আলোকেই বিরোধী দল নেতা রবিল বিক্রমাসিংহেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন।
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয় ছিল গণতন্ত্রের বিজয়। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন রাজাপক্ষে হেরে গেলেনÑ এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। আসলে রাজাপক্ষে জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতা মানুষকে যে অন্ধ করে দেয়, রাজাপক্ষে ছিলেন এর বড় প্রমাণ। তিনি শ্রীলংকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার কথাই ছিল আইন। শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলংকার মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। ওই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মানুষ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তা শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ সমর্থন করেনি। এমনকি তিনি পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন। এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। যদিও শ্রীলংকায় এক ধরনের পরিবারতন্ত্র আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা তার মা প্রয়াত শ্রীমাভো বন্দেরনায়েকে পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। বন্দেরনায়েকে ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী (১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হয়) শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে মেয়ে চন্দ্রিকাও প্রেসিডেন্ট হন। মেয়ে চন্দ্রিকা যখন প্রেসিডেন্ট, তখন মা শ্রীমাভোও দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সে দেশে।
নিঃসন্দেহে সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ঘিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে নির্বাচনে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন করে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে শ্রীলংকায়। নয়াদিল্লির বিধানসভার নির্বাচন কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের বক্তব্য ওই স্পিরিটই প্রতিনিধিত্ব করে। কেজরিওয়াল বলেছেন, সবাইকে নিয়েই তিনি প্রশাসন পরিচালনা করবেন। তিনি একাই সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু চাচ্ছেন সবাইকে নিয়ে প্রশাসন চালাতে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই বলে। মানুষটা ছোট। কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন অনেক ‘বড় মানুষ’। বলেছেন নয়াদিল্লিতে কোনো ‘ভিআইপি কালচার’ থাকবে না। মন্ত্রীরা গাড়ির ওপর লালবাতি জ্বালিয়ে চলাচলে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেবেন না।
ভারতে এক ধরনের ‘পপুলিজম’-এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বলা হচ্ছে, এটা একটা ‘মোদিওয়েভ’ বা ‘মোদি ঢেউ’। তা সারা ভারত ছুঁয়ে গেছে। দিল্লিতেও ওই একই ধরনের ‘পপুলিজম’ কেজরিওয়ালকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটা হচ্ছে, ওবামার সঙ্গে বৈঠকে মোদি ১০ লাখ টাকা দামের স্যুট পরে প্রমাণ করলেনÑ তিনি মূলত ধনী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন্যদিকে রামলীলা ময়দানে সাধারণ একটা প্যান্ট ও নীল সোয়েটার পরে কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি আসলে সাধারণ মানুষেরই মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদপত্র থেকে নিশ্চয়ই অনেকে জেনেছেন, শপথগ্রহণের দিন দিল্লির ট্যাক্সিচালকরা রামলীলা ময়দানে যেসব যাত্রী কেজরিওয়ালের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গেছেন, তাদের কারও কাছ থেকেই ভাড়া নেননি। কেননা ট্যাক্সিচালকদের ভাষায়Ñ কেজরিওয়াল তো তাদেরই লোক! কেজরিওয়াল কোনো জেড গ্রেডের (ভিআইপিদের জন্য) নিরাপত্তাও নিচ্ছেন না। তিনি কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেনÑ যা তার শাসনামলে বাস্তবায়ন করবেন। যেমনÑ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা, বিনামূল্যে গরিবদের জন্য ৭০০ লিটার পানি প্রতি মাসে (আগে ছিল ২০ হাজার লিটার), স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, হাসপাতালে ফ্রি বেড ইত্যাদি। তার ওই প্রতিশ্রুতি সুশাসনের কথাই বলে। আর সুশাসনই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল কথা।
গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কিংবা গণতন্ত্রের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে শ্রীলংকা ও দিল্লিতে আম আদমি পার্টির উত্থান থেকে আমরা শিখতে পারি। তাদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। সাম্প্রতিক কালে সিরিসেনা কিংবা অরবিন্দ কেজরিওয়াল আমাদের কাছে দুটি দৃষ্টান্ত। সিরিসেনা সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। অন্যদিকে এক সময়ের আয়কর বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ও এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা। দু’জনই বলেছেন সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা। এখন আগামী দিনগুলোই বলবে তারা কতটুকু সফল হবেন। 

0 comments:

Post a Comment