রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা

প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরের সময় একটি বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তির মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ভারত ৩১ জানুয়ারি দূরপাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নি-৫ এর সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চিরবৈরী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণের মাত্র দুদিনের মধ্যে পাকিস্তানও একই ধরনের একটি পরীক্ষা চালিয়েছে। ওবামার সাম্প্রতিক ভারত সফর ও ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদে সমর্থনের ব্যাপারে পাকিস্তান আদৌ খুশি নয়। উপরন্তু বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি যে এ অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেবে, এটা স্পষ্ট করেছেন সারতাজ আজিজ। আজিজ পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা। ২৯ জানুয়ারি ইসলামাবাদে স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এই আশঙ্কার কথা তিনি ব্যক্ত করেন। ওবামার নয়াদিল্লি ত্যাগ করার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভারত অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করল। এর আগে ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রথম ও ২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বার অগ্নি-৫ এর সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৩ সালে পাকিস্তান হাতেফ গজনবী নামের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। অগ্নির মতো হাতেফও পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য। অগ্নির পর ভারত নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ‘আকাশ’ ও পাকিস্তান হাতেফ-৯ নামে আরও দুধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশ দুটি এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এতে দেশ দুটির দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হতে বাধ্য। এর কী আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে দরিদ্রতার মাঝে রেখে দুদেশের এই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কোন দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে? পাঠকদের একটি ধারণা দিয়ে রাখি। একটা দূরপাল্লার (যেমন অগ্নি-৫) মিসাইলের মূল্য ৫ লাখ ৬৯ হাজার ডলার থেকে ৬ লাখ ডলার। অর্র্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ কোটি টাকা। একটি ক্রস মিসাইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপণযোগ্য) মূল্য ১ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে এগারো কোটি টাকা)। আর বিমান থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের (যা ভারত ইতোমধ্যে অর্জন করেছে) মূল্য ৫ লাখ ডলার। এই টাকা এ খাতে ব্যয় না করে তা হাসপাতাল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যেত। এমনকি ভারতে চরম দরিদ্রতম রাজ্য হিসেবে পরিচিত (দারিদ্র্যের কারণে যেখানে মাওবাদীদের তৎপরতা বেশি) মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ কিংবা ঝাড়খ-ে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু করতে পারত। ভারত তা করেনি। মুম্বাইয়ের চাকচিক্যময় ছবি দেখে ভারতের মানুষের জীবনযাত্রার মান বিচার করা যাবে না। ভারতে ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছেÑ এ রকম একটি সংবাদ সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান থেকে এ ধরনের সংবাদ তেমন একটা শোনা যায় না। এ কারণেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) অর্জনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ভারতের চেয়ে ভালো। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যথেষ্ট ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সিপরির (ঝওচজও) বার্ষিক গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ৮০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে। জিডিপিতে প্রতিরক্ষা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ২.৫ থেকে ৩ ভাগ। ২০০০ সালের পর প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে শতকরা ৬৪ ভাগ। এই সময়সীমায় ভারতে যে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার মাঝে রাশিয়া একাই সরবরাহ করেছে ৮২ ভাগ। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ভারত ইতোমধ্যে তার নৌবহরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হতে চায়। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, চিনের নৌবাহিনীতে যেখানে জাহাজের সংখ্যা ১৩৫টি, সেখানে ভারতের জাহাজ রয়েছে ১০৩টি। অর্থাৎ প্রায় কাছাকাছি। ভারতের উদ্দেশ্য যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রথম ভারত সফরের সময় ভারত যক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ১১ বিলিয়ন ডলার মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ১২৬টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে। যেখানে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ ন্যূনতম টয়লেট সুবিধা পায় না, ৩১ ভাগ জনগোষ্ঠীর দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা কি না জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত অতি দরিদ্রের মানদ-), সেখানে শত শত কোটি রুপি ভারত ব্যয় করছে অস্ত্র খাতে। ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে, অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণের ব্যাপারে যক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হোক। সদূরপ্রসারী এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করেছে। তার টার্গেট মূলত চিন, চিনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা। আর এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে ‘অন্যতম শত্রু’ বলে মনে করে না। ভারতের অন্যতম ‘শত্রু’ এখন চিন। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ঘুরেও গেছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি আর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনও। মিসেস কিনটনের ঝুড়িতে যে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যে মার্কিন স্ট্র্যাটেজি অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়, সেই বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভারতকে দিয়ে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-৫ ও আকাশ উৎক্ষেপণ এই স্ট্র্যাটেজিরই একটি অংশ। ভারতকে চিনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো কিংবা ভারতকে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত করার উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে বলতে পারব না। কিন্তু যে দেশ দারিদ্র্য দূরীকরণে কোনো বড় কর্মসূচি নিতে পারে না কিংবা কৃষকের আত্মহত্যা রোধ করার উদ্যোগ নিতে পারে না, সেই দেশ অগ্নি-৫ মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করে আমাদের জন্য কি কোনো ‘মডেল’ হতে পারে? আগামী দিনে ভারতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমনি বাড়বে, তেমনি বাড়বে কন্যাশিশুর ভ্রƒণ হত্যার প্রবণতাও। একটি সভ্য সমাজে যা কল্পনাও করা যায় না। অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণ ছিল একটি প্রহসন মাত্র। আর পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে ভারতের চেয়ে ভালো, তা বলা যাবে না। পাকিস্তান বাহ্যত আরেকটি ‘তালেবানি রাষ্ট্রে’ পরিণত হতে যাচ্ছে। একুশ শতকে এসেও পাকিস্তানের কোনো কোনো প্রদেশে মেয়েদের শিক্ষা সীমিত। তালেবান জঙ্গিরা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেÑ এ রকম সংবাদ আমরা একাধিকবার পাঠ করেছি। পাকিস্তানের মতো দেশে, যেখানে তারা জঙ্গি তৎপরতা দমন করতে পারছে না, সেখানে শাহীন (১৮০০ মাইল দূরপাল্লা) কিংবা হাতেফ গজনবীর (১৮০ মাইল দূরে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন) মতো মিসাইল উদ্ভাবন করে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিযোগিতাকে উসকে দিলমাত্র। পাকিস্তান বা ভারতের এ থেকে লাভবান হওয়ার কিছু নেই। এতে করে দুদেশের দরিদ্রতা আরও বাড়বে। আর লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র ব্যবসায় তাদের প্রসার বাড়বে। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৬ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৪৫টি হালকা কামান আমদানি করছে। একসময় তথাকথিত ‘নিরাপত্তা সুরক্ষার’ নাম করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিল (বিবিসি, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০)। এখানে বলা ভালো, ভারত ও পাকিস্তান এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণের ব্যাপারে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিনি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ব্যাপারে তার নীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উপমহাদেশে আগামী দিনগুলোতে এই প্রতিযোগিতা বাড়বে বলেই মনে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এই পারমাণবিক প্রতিযোগিতায় অন্য দেশগুলোও আক্রান্ত হতে পারে। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দুই ব্লকে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫৪৯ মিলিয়ন (প্রতিদিনের আয় ১ ডলার ২৫ সেন্ট হিসেবে)। ২০০৫ সালে তা দাঁড়ায় ৫৯৫ মিলিয়নে। আর বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ৬৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, ২৫০ মিলিয়ন শিশু অপুুষ্টির শিকার। ৩০ মিলিয়ন শিশু কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। মোট নারী জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের এক ভাগ রক্তশূন্যতায় ভোগে। ভারতে প্রতি ৩ জনের মাঝে ১ জন দরিদ্র। ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য টয়লেটের কোনো সুবিধা নেই। আর প্রতিদিন ভারতে মারা যায় ৫ হাজার শিশু। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কোনো আশার কথা বলে না। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে দরিদ্রতা কমেনি। অথচ দুটি বড় দেশ ভারত ও পাকিস্তান আজ কোটি কোটি ডলার খরচ করছে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবনে। দক্ষিণ এশিয়ার এই মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে দরিদ্রতা দূর করা, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও সেই সঙ্গে জেন্ডার সমতা আনা। ব্যাপক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করাও জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন। Daily AMADER Somoy 09.02.15

0 comments:

Post a Comment