বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির (আপ) অসাধারণ বিজয় ও আপ ‘সুপ্রিমো’
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সব প্রতিশ্র“তি কি শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমেই থেকে যাবে?
ইতিমধ্যেই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। কীভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার
প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবেন? কেননা দিল্লির নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটা খুব বড়
নয়। তার ওপর কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে ‘আপ’-এর সম্পর্ক নিয়েও
প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন, তার
মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করে দেয়া, প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি
বিনামূল্যে ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা, ১৫ লাখ সিসিটিভি স্থাপন, ফ্রি
ওয়াইফাই, ৫০০ ফ্রি স্কুল, ২০ ফ্রি কলেজ, হাসপাতালে ৩০ হাজার বেড বাড়ানো, ৫৫
হাজার নতুন স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা, ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ করা ইত্যাদি।
এসব প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ‘ধাক্কা’ খাবেন
দিল্লির বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা ৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ‘আপ’ নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র
স্থাপনের কথা বলছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কারণে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র
কিংবা অতিরিক্ত গ্যাসের কারণে গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে
না। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা দিল্লিতে বেসরকারি খাতে। এরা শতকরা ৫২ ভাগ বেশি
আয় করে। এদের আয়-ব্যয় হিসাব করার হুমকি দিয়েছে ‘আপ’। এখন যদি মুখ্যমন্ত্রী
বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করার নির্দেশ দেন, তাতে রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। আয়
কমে গেলে কোন খাত থেকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়নের অর্থ জোগাবেন? প্রতি
মাসে ২০ হাজার লিটার পানি বিনামূল্যে দেয়ার প্রতিশ্র“তি তিনি দিয়েছেন। অথচ
দিল্লির ভূগর্ভে পানির স্তর এ সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে তাকে
পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা রাজ্যের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু সেখানে রয়েছে বিজেপি
সরকার। বিজেপির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটা
একটা বড় প্রশ্ন এখন। পুরো দিল্লি শহরে ১৫ লাখ সিসিটিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি
পূরণে খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা, যা কিনা দিল্লির বার্ষিক আয়ের ৪
গুণ। সিসিটিভির নজরদারির জন্য দরকার হবে আরও ৪ লাখ পুলিশ। এতেও খরচ বাড়বে।
এত বিপুল খরচ ‘আপ’ মেটাবে কীভাবে? পত্রিকাগুলো লিখছে, যেখানে বেইজিং ও
লন্ডনের মতো শহরে সিসিটিভির সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার ও ৪ লাখ ২০ হাজার,
সেখানে দিল্লিতে ১৫ লাখ সিসিটিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমেই থেকে
যাবে। বর্তমানে দিল্লিতে ১ লাখ পুলিশ রয়েছে। নজরদারির জন্য অতিরিক্ত পুলিশ
নিয়োগে খরচ বাড়বে ৫ হাজার কোটি টাকা। হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বেড বসাতে
খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ৫৫ হাজার অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগে আরও
খরচ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। দিল্লির বার্ষিক বাজেট ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এ বাজেট বাড়বে। অথচ রাজস্ব আসে মাত্র ২২
হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেজরিওয়াল।
তাহলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে নয়া মুখ্যমন্ত্রী?সূক্ষ্মভাবে
দেখলে দেখা যাবে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তি এবার কমেছে। অর্থাৎ বিজেপির যে
নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক ছিল তাতে ধস নেমেছে। যদিও তাদের নির্দিষ্ট ভোটার আছে।
একই সঙ্গে ধস নেমেছে কংগ্রেস ভোটেও। যারা এতদিন কংগ্রেসকে ভোট দিত, তারা
এখন কংগ্রেসের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। গরিব, মধ্যবিত্ত, দলিত
মুসলমানরা এতদিন কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে। এরাই কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। এরা
এবার আর কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি। এরা এখন ‘আপ’ বা এএপিতে তাদের আস্থা খুঁজে
পেয়েছে। ফলে এএপির ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে, যা কেজরিওয়ালের সরকার গঠনে সহায়ক
হচ্ছে।একটা প্রশ্ন অনেক রাজনৈতিক
বিশ্লেষকই করবেন- যেখানে লোকসভায় সবক’টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেখানে মাত্র
কয়েক মাসের ব্যবধানে বিজেপি সমর্থন হারাল কেন? এর অনেক কারণ আছে। লোকসভা আর
বিধানসভার নির্বাচন এক নয়। দুই নির্বাচনের মেজাজ ভিন্ন ধরনের। লোকসভায়
জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পায় আর বিধানসভায় প্রাধান্য পায় স্থানীয় ইস্যু। ২০১৪
সালে ভারতব্যাপী একটি পরিবর্তনের ঢেউ ছিল। সেই পরিবর্তনে ক্ষমতাচ্যুত হয়
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। মোদি নতুন একটা ইমেজ নিয়ে এসেছিলেন।
সাধারণ মানুষ তাতে আস্থা রেখেছিল আর কংগ্রেসের ব্যর্থতা ছিল কংগ্রেস ২০১৪
সালে কোনো নতুন রাজনীতি উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু দিল্লির বিধানসভার
নির্বাচন একটি ভিন্ন বিষয়। এখানে দুর্নীতি, ধর্ষণ ইত্যাদি ইস্যু প্রাধান্য
পেয়েছে। কিরণ মোদিকে বিজেপি সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেছিল। এতে
সমস্যা হয়েছে একাধিক। দলের ভেতরে, যারা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা
খুশি হননি। তাদের নীরবতা এএপির অনুকূলে গেছে। উপরন্তু কিরণ বেদী দিল্লির
বাসিন্দা নন। তিনি বহিরাগত। রাজনীতিতেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। দক্ষ পুলিশ
অফিসার হিসেবে তার নামডাক আছে। মানুষ তাকে চেনে দক্ষ ও যোগ্য অফিসার
হিসেবে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে নিজেকে
সুবিধাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়ান। তুলনামূলক বিচারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আরও
বেশি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। দিল্লির ১ কোটি ৩০ লাখ ভোটারের একটা বড় অংশ
নিু-মধ্যবিত্ত, দলিত ও মুসলমান। বিজেপি এদের কাছে যেতে পারেনি। কিরণ বেদীর
ব্যর্থতা ছিল এখানেই যে, তিনি এ শ্রেণীর সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি।
তারা কংগ্রেসের পরিবর্তে এএপিকেই ভোট দিয়েছে।বিজেপির
নীতি এবং নরেন্দ্র মোদির নীতি উচ্চবিত্ত তথা ব্যবসায়ী শ্রেণীকে টার্গেট
করে পরিচালিত হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসার কথা বলেন মোদি। তার আশপাশে নব্য
ব্যবসায়ী শ্রেণীর ভিড় বেড়েছে। এতে করে উপেক্ষিত থাকছে মধ্যবিত্ত ও গরিব
শ্রেণী। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ওবামার অনুষ্ঠানে মোদি যে স্যুটটি
পরেছিলেন তার দাম প্রায় ১০ লাখ টাকা। লন্ডনের এক ফ্যাশন হাউস থেকে এটি তৈরি
করা হয়। মোদি ‘গরিবের বন্ধু’ নন, এমন একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। ফলে
মধ্যবিত্ত ও দলিত শ্রেণী যে তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিরণ বেদী নিজেও কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। খুব স্বাভাবিকভাবেই
দলিত শ্রেণী ধরে নিয়েছে তিনিও মোদির মতো ‘ধনীদের বন্ধু’। শুধু তাই নয়,
বিজেপির সমর্থন নিয়ে সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে ভারতজুড়ে ‘ঘর ওয়াপসি’ বা
ধর্মান্তকরণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ধর্মান্তকরণের (অথবা মূল ধর্মে
প্রত্যাবর্তন) নামে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের হিন্দু বা সনাতন ধর্মে দীক্ষিত
করার কর্মসূচি ভারতজুড়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খোদ ওবামা ভারত সফরের
সময় পরোক্ষভাবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। দিল্লির ভোটারদের একটা অংশ
শিক্ষিত। তারা বিজেপির এ পরোক্ষ সমর্থনকে সহজভাবে নিতে পারেনি। ভোটের
হিসাব-নিকাশে এর প্রভাব পড়েছে।অতীতে
কেজরিওয়ালের অনেক কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছিল। যেমন আগেরবার
ক্ষমতায় গিয়ে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে
দিয়েছিলেন। এতে বস্তিবাসী গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এখনও মনে
করেন, তিনি এ ধরনের কর্মসূচি আরও দেবেন। তাতে উপকৃত হবে মধ্যবিত্ত। ধনীরা
তার কাছ থেকে সুবিধা পাবে না। ফলে ভোট পড়েছে বেশি। তার দুর্নীতিবিরোধী
কর্মসূচিতেও মানুষের আস্থা রয়েছে। ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করে, ভারতে
দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যার কারণেই উন্নয়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। আর
রাজনীতিকদের একটা বড় অংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে এএপি ব্যতিক্রম।দিল্লির
বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল, গেলবারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে
রাজ্যটি মুক্তি পেয়েছে। এবার তারা একটি স্থায়ী রাজ্য সরকার পাবে।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই
বলতে পারবে। তবে এটা ভারতব্যাপী কোনো মডেল হবে না। অনেক রাজ্য আছে, যেখানে
স্থানীয় দলগুলো রাজ্য সরকার পরিচালনা করে। মাত্র দু’বছর আগে এএপির আবির্ভাব
ভারতব্যাপী তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন জাতীয় নেতা
হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি। গত লোকসভায় তার দল কোনো আসন পায়নি। দুর্নীতিবিরোধী
আন্দোলন তাকে পরিচিত করেছিল। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী থেকে তিনি
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তার এ অর্জন একেবারে কম নয়।
তবে দিল্লির রাজ্য সরকার পরিচালনা করা তার জন্য একটা সমস্যা হতে পারে।
কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পান, তাহলে কোনো
কর্মসূচিই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। প্রতিশ্রুতি দেয়া যায়; কিন্তু
বাস্তবায়ন করা কঠিন। যদিও মোদি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে সে
প্রতিশ্রুতির পেছনে কতটুকু আন্তরিকতা আছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে
পারবে। তবে এটা সত্য, কেজরিওয়াল একটা ‘ইমেজ’ ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন। একটি
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তিনি চান। কাজটি যে খুব সহজ, তা নয়। ভারতে দুর্নীতি
প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়,
জেনেভায় বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয়দের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কর ফাঁকি
আর দুর্নীতির মাধ্যমে এ টাকা পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ জনের
একটি তালিকা তৈরি করেছে বলেও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং যে
রাজ্যের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন কেজরিওয়াল, সেখানে কর ফাঁকিবাজ আর
দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা একমাত্র
ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।কেজরিওয়ালের মূল
স্পিরিট হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে
যাওয়া। এজন্যই তিনি প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা,
বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করা ইত্যাদির। ভয় হয়, এটা না আবার ‘সস্তা স্লোগান’
হয়ে যায়। তবে কেজরিওয়ালের একটা ভালো জিনিস লক্ষণীয়। তিনি নির্বাচনের আগে ও
পরে তার বিরোধী পক্ষ, বিশেষ করে কিরণ বেদী সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য
করেননি। ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমনটি দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মমতা
ব্যানার্জির সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই।দিল্লির
বিধানসভায় কোনো বিরোধী দল থাকবে না, এটাও একটা খারাপ দিক। ‘আপ’-এর নীতির
কোনো সমালোচনা আমরা শুনতে পাব না। এতে করে দায়বদ্ধতার একটা অভাব অনুভূত
হবে। এটা কেজরিওয়ালকে একনায়কতন্ত্রী করে তুলতে পারে। তবে স্বীকার করতেই
হবে, ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ভিন্ন চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হলেন মাত্র ৪৭
বছরের অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৫ বছর তার জন্য কম সময় নয়। তিনি কতটুকু সফল হবেন,
সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment