রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনৈতিক অচলাবস্থা : কোন পথে উত্তরণ

বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়েই প্রতিদিন আমরা পার করছি। আর প্রতিদিনই পেট্রলবোমা আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটগুলোয় অগ্নিদগ্ধ মানুষের করুণ কাহিনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। ছোট শিশুরা অগ্নিদগ্ধ মা-বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রশ্ন রাখছে- সে তো কোনো অন্যায় করেনি, তাহলে তাকে মানুষ পোড়াল কেন? এ প্রশ্নের জবাব কারও কাছেই নেই। সাধারণ মানুষ জানে না, এ পরিস্থিতির অবসান হবে কীভাবে বা কখন আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে দেশে। অবরোধের মাঝে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে খুব বেশি যানবাহন আসেনি। অবশ্য রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়মিত ক্লাস হচ্ছে; ভয়ের মাঝেও মানুষ তার নিত্যদিনের কাজ করে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে অসন্তোষ আর রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরনের ক্রোধ। এ পরিস্থিতিতেও দোষারোপের রাজনীতি আমরা লক্ষ করছি। সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করছে। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। তাদের দাবি, ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতির জন্ম হতো না। পরস্পর দোষারোপের মধ্য দিয়ে এক অসহিষ্ণু রাজনীতির জন্ম হয়েছে এদেশে। এ বড় দল দুটোর বাইরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সরকারের 'বিশেষ উপদেষ্টা' এইচএম এরশাদ ৫ ঘণ্টা অনশন পর্যন্ত করেছেন ৩০ জানুয়ারি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। পরিস্থিতির আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রীর খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে যাওয়া এবং গেট বন্ধ অবস্থায় সমবেদনা না জানিয়ে ফেরত আসা- সব মিলিয়ে একটা সংলাপের এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও এক্ষেত্রে 'বরফ' গলেনি। কেন খালেদা জিয়ার অফিস খোলা হলো না- এ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। তবে কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি সরকারের নীতিনির্ধারকরা কীভাবে নিয়েছেন, আমি জানি না। তবে এটা একটা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে। কোকো রাজনীতিক পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতি করেননি। জিয়া পরিবারের প্রতি মানুষ যে সহানুভূতিশীল, এটাই প্রমাণিত হলো। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে আমি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই একটাই কারণে; তা হচ্ছে তারা নির্বিঘ্নে এ জানাজা সম্পন্ন করতে দিয়েছেন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। এরপরও সরকারের নীতিনির্ধারকদের দু-একজন ব্যক্তি 'মৃত ব্যক্তি' সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের বক্তব্য তাদের নিজেদের অবস্থানকে জনমানসে শক্তিশালী করে না। একটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে- এবার তাহলে সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ কী? এটা সত্য, সরকার সাংবিধানভাবেই ক্ষমতায় আছে। সংবিধান অনুযায়ীই একটা নির্বাচন হয়েছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলেও নির্বাচন ছিল সাংবিধানিকভাবে বৈধ; কিন্তু এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারেনি। কেননা গণতন্ত্রে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' এর যে কথা বলা হয়, তা রক্ষিত হয়নি; অর্থাৎ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হয়নি। বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন 'নিয়মরক্ষার নির্বাচন'। আমরা সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সরকার এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলবে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় সবাই বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সংবিধান আমাদের এ কথাটাই বলে, ৫ বছর পর পর নির্বাচন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল, তা স্বাভাবিক ছিল না। অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতিতে ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি আসনগুলোয় যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ভোটারদের উপস্থিতির হার ছিল কম। তারপরও নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও তেমন একটি নির্বাচন (ষষ্ঠ সংসদ) আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু এ সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই নির্বাচনের সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে তুলনা করতে চাই না। দুটো নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে গণতন্ত্রে 'সব দলের অংশগ্রহণে' যে নির্বাচনের কথা বলা হয়, ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে সেটা ছিল না এবং দশম সংসদ নির্বাচনেও (২০১৪) সব দলের অংশগ্রহণে নিশ্চিত হয়নি। এতে এক জায়গায় মিলটা আছেই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট একটি ভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বোমাবাজি আর পেট্রলবোমা এখন রাজনীতিকে 'নিয়ন্ত্রণ' করছে। অদৃশ্য বোমাবাজরা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে! যেখানে সংসদ দেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, আইন প্রণয়ন করবে, জাতিকে নেতৃত্ব দেবে, সেখানে অদৃশ্য বোমাবাজরা রাজপথে থেকে রাজনীতিকে কলুষিত করছে। বোমাবাজদের শিকারে পরিণত হয়েছে শিশুরা পর্যন্ত। এ পেট্রলবোমার সংস্কৃতি যে আমাদের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বোধকরি কেউই এটা বুঝতে চাইছি না। বুঝতে পারাটা স্বাভাবিক, কিন্তু বুঝতে চাইছি না! আমাদের সংবিধানে সুষ্ঠুভাবে বলা আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।' কিন্তু মানুষ যখন দগ্ধ হয়, তখন তার মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বৈকি! সংবিধানে চলাফেরার স্বাধীনতা (৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ) নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নামে যারা পেট্রলবোমা ছুড়ছে, তারা তো সংবিধানের ওই ধারাকে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ থেকে আমরা বের হয়ে আসব কীভাবে? কে দেবে আমাদের এ নিশ্চয়তা? রাজনীতির নামে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফারজানা কিংবা সাকিবের মতো ছোট্ট শিশুরাও বোমাবাজদের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী এ পেট্রলবোমায় আহত হয়েছেন, এমনটি কখনও দেখা যায় না। গত ক'দিনে ডিএমসির বার্ন ইউনিটের যে ছবি ও সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তা হৃদয়বিদারক। ঝলসে গেছে মুখ, ছোট শিশুটি চিনতে পারছে না তার বাবাকে। ফ্যালফ্যাল করে 'অচেনা' এক বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ছোট্ট মনে তার হাজার প্রশ্ন- এমন কেন বাবা! এর জবাব কে দেবে? মার কোলে এই ছোট্ট সোনামণির ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমি জানি না, কারা বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়েছে; তাদের ক'জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; কিন্তু সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ- ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পেট্রলবোমা ছুড়ে, বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় খালেদা জিয়াকে 'হুকুমের আসামি' করে দুটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর ডিএমপির কমিশনার আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, প্রমাণসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হবে! অর্থাৎ খালেদা জিয়াও গ্রেফতার হতে পারেন যদি 'প্রমাণ' পাওয়া যায়! খালেদা জিয়া অবরোধ-হরতালের ডাক দিয়েছেন- সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানিয়েছেন। তার বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কিন্তু যাত্রাবাড়ীতে বাসে তিনি কি বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কী জানি পুলিশি 'তদন্তে' তা বেরিয়েও আসতে পারে! যাত্রাবাড়ীতে বাসে বোমা হামলা হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি। তার মামলা হলো ২৪ তারিখ। এ হামলায় ৩১ জন দগ্ধ হয়েছিল। এটা একটা বড় ধরনের অপরাধ। এর শাস্তি হওয়া উচিত- এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না গেলে এ সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। কিন্তু খালেদা জিয়াকে 'হুকুমের আসামি' করায় (কুমিল্লায়ও তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে) এতে 'সমঝোতার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও জটিলতা সৃষ্টি হলো বৈকি! এরই মধ্যে গতকাল (শনিবার) খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এর আগে শুক্রবার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এখন এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ একটি 'জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কথা বলেছেন। কিন্তু 'জাতীয় ঐকমত্যের' সরকার তো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে এ ধরনের কোনো কথা লেখা নেই; বরং বলা আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এর গঠন কাঠামো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। বিএনপিকে কীভাবে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করেও একটা 'ফরমুলা' বের করা যায়। এর জন্যই প্রয়োজন সংলাপের। আর এ সংলাপ যত দেরি হবে, ততই সঙ্কটের গভীরতা বাড়বে। অসাংবিধানিক শক্তি এটা থেকে সুবিধা নেবে। এজন্য একটা সমঝোতা প্রয়োজন। কেননা সমঝোতা না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে আশা করছি- এ লক্ষ্যেও আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে আমরা দেশটিকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এ প্রত্যাশা পূরণ হবে না। কেননা 'সমঝোতা' না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রফতানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। 'সমঝোতা' না হলে অরাজনৈতিক কর্মকান্ড বাড়বে; সুশাসন ব্যাহত হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। 'সমঝোতা' যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না; আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি, বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে, কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকা শক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন ও 'সব দলের অংশগ্রহণে' এই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কটা ফিরে আসুক, মানুষ স্বস্তি পাক, বোমাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ হোক- এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে। Daily Alokito Bangladesh 01.02.15

0 comments:

Post a Comment