রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাঁচ দশকের বাংলাদেশ : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য এ পাঁচ দশক একেবারে কম সময় নয়। এ পাঁচ দশকে বাংলাদেশের রয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কিসিঙ্গার যে দেশটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে, সেই দেশটি চলতি ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে সব ধারা অতিক্রম করবে। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি আসবে ২০২৪ সালে। এটা নিঃসন্দেহে একটি মর্যাদার বিষয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন সামনের কাতারে। ১৯৭৪ সালে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার (CEIC Data.com), সেখানে ফেব্রুয়ারি (২০২১) মাসে এসে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। অথচ পাকিস্তানিদের রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৫১২ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। যদিও ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি, ৫৮১ বিলিয়ন ডলার। গেল ১০ বছরে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪১ ভাগ হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে ১১ মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে জনসংখ্যা ছিল, গেল ৫০ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে যেখানে ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার, ২০১৯-২০ সালে তা বেড়েছে ২০৭৯ ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২.৭৫ ভাগ (১৯৭২-৭৩), সেখানে ২০১৮-১৯ সময়সীমায় উন্নীত হয়েছিল ৮.১৫ ভাগে। তবে করোনাকালীন সময়ে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও শ্লথ গতি আসে। এডিবির মতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫.২ ভাগ, আর ২০২১ সালে ৬.৮ ভাগ। অথচ এডিবিই বলছে ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ভারতে মাইনাস ৯ ভাগ, শ্রীলঙ্কায় মাইনাস ৫.৫ ভাগ, আফগানিস্তানে মাইনাস ৫ ভাগ, আর পাকিস্তানে মাইনাস ০.৪ ভাগ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.২ ভাগ বলে দেয় করোনাকালীন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ছিল। অর্থনীতি ক্ষেত্রে আরও কিছু পরিসংখ্যা দিয়ে আমরা বোঝাতে পারব আমাদের অর্জন গেল ৫০ বছরে অনেক দেশের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৭ ভাগ, ডলার প্রতি বিনিময় মূল্য ছিল ৭.৩০ টাকা, রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২৮.৭৩ টাকা, রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ০.৮৩ কোটি ডলার, সেখানে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ ভাগে, ৮৬ টাকা ডলার প্রতি মূল্য, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৬.০০ কোটি ডলারে, আবার আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে ৫৪০০ কোটি ডলারে। রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়েছে ৪৫০০ কোটি ডলার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই বা তিনটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল আমাদের রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পাটজাত দ্রব্য, চা ও চামড়া-চামড়াজাত পণ্যের বদলে এখন স্থান করে নিয়েছে তৈরি পোশাক ও জনশক্তি। ওষুধ শিল্পও বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্য মতে (২০১৯-২০২০) বাংলাদেশ ১১৮টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ রপ্তানি করেছে। স্বাধীনতার আগে আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কমবেশি এক কোটি টন। তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সর্বশেষ তথ্য বলছে আমাদের মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার কোটি টন। উৎপাদনের পরিমাণ গড়ে চারগুণেরও বেশি। এর মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। গত ৫০ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবাখাতে যেসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি চিত্র আমরা পাব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স- এইচডিআই (ইউএনডিপি কর্তৃক প্রণীত) এ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শিশু শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু) আমাদের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো- একথা স্বয়ং স্বীকার করেছে অমত্য সেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে এইচডিআই সূচকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেখানে ২০১৭ সালে তা উন্নীত হয় শূন্য দশমিক ৬১ এ। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ০.৬৩ এ (প্রথম অবস্থান নরওয়ের (০.৯৫৭)। ভারতের স্কোর (০.৬৪৫, ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩১, আর বাংলাদেশের ১৩৩)। প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির সংখ্যা এখন ৯৭.৯ ভাগ। মাতৃমৃত্যুর হার এখন মাত্র ১৬.৫ ভাগ। ৭০ বছরের ওপরের বয়স্ক নাগরিকদের সাক্ষরতার হার এখন শতভাগ। ২০০৬ সালে গড় আয়ুকাল যেখানে ছিল ৬৪.৪, ২০১৯ সালে তা বেড়েছে ৭২.৪ ভাগে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০.৫ এ কমে এলেও (বিবিএস রিপোর্ট), করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা অনুযায়ী সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে এখন ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশ (জিএসসিআই-২০২০) ১৭ ধাপ এগিয়ে (১৮০ দেশের মধ্যে ১১৫তম, বাংলাদেশের স্কোর ৪৩.৩, ভারতের অবস্থান ১২৭তম অর্থাৎ ভারত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে) গেলেও বৈষম্য গত ৫০ বছরে আমরা দূর করতে পারিনি। বৈষম্য মাপা হয় ‘গিনি সহগ’ দিয়ে। ২০১৬ সালের আমাদের ‘গিনি সহগ’ ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩। শূন্য দশমিক ৫ হলেই অতি উচ্চ বৈষম্যের দেশ হয়ে যায়। মাথাপিছু ঋণের বোঝা বাড়ছে- এটা আমরা কমাতে পারিনি। ২০১৫ সালের শেষ দিকে মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬০ টাকা, তখন তার পরিমাণ অর্থনীতি সমিতির মতে প্রায় ৭৯ হাজার টাকা। সাম্প্রতিককালে আমাদের অর্থনীতির জন্য দুটি খারাপ খবর- এক. বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার, আর দুই. খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। ২০২০ সালে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা (যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০)। যে কোনো বিবেচনায় আমাদের জন্য এটি খারাপ সংবাদ। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি গত ৫০ বছরে একেবারে কম নয়। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহিঃবিশ্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক বেশি আলোচিত হয়েছে। এটা ঠিক গত বারো বছরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর (২০১৬) ও প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর (২০১৪) এবং চীন কর্তৃক ৯৭ ভাগ বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (২০২০) চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যে সমুদ্রসীমানা বিরোধ ছিল, তা বাংলাদেশ (২০১২) অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সমাধান করেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধেরও সমাধান হয়েছে। তবে তিস্তার পানি বণ্টনের সমাধান না হওয়া এবং ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয়, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সব অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দেয়। এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চল ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে। বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে এখন হীরক জয়ন্তী (৬০ বছর) পালনে একধাপ এগিয়ে গেল। সামনে রয়েছে প্লাটিনাম জয়ন্তী (৭৫), তারপর শতবর্ষ জয়ন্তী। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। তবে বলতেই হবে আমাদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়। এটাই এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার। Jugsntor 12.3.2021

0 comments:

Post a Comment