রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বদলে যাচ্ছে আরব বিশ্বের দৃশ্যপট

খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে আরব বিশ্বের দৃশ্যপট। ইতোমধ্যেই ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছেন দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসকরা। জয়নুল আবেদিন বিন আলী, হোসনি মুবারক, মুয়াম্মার গাদ্দাফি এরা সবাই এখন ইতিহাসের অংশ। গণঅভ্যুত্থানে বিন আলী ও হোসনি মুবারকের পতন ঘটলেও একটি চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ গাদ্দাফিকে উৎখাত ও পরে হত্যা করেছে। জনগণের সমর্থন হয়তো লিবিয়াতে ছিল, কিন্তু যেভাবে গণঅভ্যুত্থান তিউনিসিয়া কিংবা মিশরে 'বিপ্লবের' সূচনা করেছিল লিবিয়াতে সেভাবে হয়নি। একটি গৃহযুদ্ধ সেখানে গাদ্দাফিকে উৎখাত করেছিল। অনেকটা সেই গৃহযুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে এখন সিরিয়া। সেখানে সেনাবাহিনীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর একটা অংশ সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধীদের সাথে যোগ দিয়েছে, যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছিলাম লিবিয়ায়। তবে ইয়েমেনে পরিবর্তনটা এসেছে অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবেই। দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ভাইস-প্রেসিডেন্টের হাতে ছেড়ে দিতে একটি চুক্তি করেছেন। ইতোমধ্যে সেখানে বিরোধী দলের একজন নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
আরব বিশ্বের এই যে পরিবর্তন এই পরিবর্তন নিয়েও কথা আছে। কেননা সেখানে ক্ষমতাসীনদের পতনের মধ্যদিয়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে গণতান্ত্রিক কোনো শক্তি বিজয়ী হয়নি। বিজয়ী হয়েছে ইসলামপন্থীরা। যদিও বলা হচ্ছে এই ইসলামপন্থীরা মডারেট ও আধুনিক মনস্ক। এদের সাথে আল-কায়েদার কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা আল-কায়েদার কর্মকা-ের সমালোচনাও করেছেন। প্রথমে তিউনিসিয়া, পরে মরক্কো, তারপর মিশর_ প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে বিজয়ী হয়েছে ইসলামপন্থীরা। মজার ব্যাপার মিশরে গেল ফেব্রুয়ারিতে হোসনি মুবারকের উৎখাতের পর গেল মাসে (নভেম্বর) বিশ্ববাসী আবার কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে ফিরে এসেছিল। তারা নির্বাচন পেছানোর দাবি করলেও ইসলামপন্থীরা ছিল নির্বাচনের পক্ষে। গত ২৮ নভেম্বর এই নির্বাচন শুরু হয়েছে।
নির্বাচনের ফলাফল শুধু মিশরের জন্যই নয়, বরং আরব বিশ্বের জন্যও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা নির্বাচনে ৪৯৮টি আসনের নিম্নকক্ষে ইসলামপন্থী মডারেটরা বিজয়ী হননি, বিজয়ী হয়েছে কট্টরপন্থী ইসলামপন্থীরা। তবে জানুয়ারিতে শেষ হওয়া তৃতীয় দফা নির্বাচনের পরই বোঝা যাবে মিশরের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে। প্রথম দফা নির্বাচনেই ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস অ্যান্ড পিস পার্টি পেয়েছে ৩৬ দশমিক ৬ ভাগ ভোট, আর সালফিস্ট গ্রুপ আল নূর পার্টি পেয়েছে ২৪ ভাগ ভোট। যৌথভাবে কট্টরপন্থীদের মোট ভোট ৬১ ভাগ। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা পেয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৪ ভাগ ভোট। নিঃসন্দেহে মিশরের রাজনীতিতে এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রথা হচ্ছে সমগ্র আরব বিশ্বে এই যে পরিবর্তন এই পরিবর্তন কি সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে? তিউনিসিয়ায় এন্নাহদা পার্টির উত্থান সেখানে একটি 'তুরস্ক মডেলের' জন্ম দিতে যাচ্ছে। তুরস্কের ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। তুরস্কে ইসলামপন্থীরা কট্টরপন্থী নন। এরা আল-কায়েদাকে সমর্থনও করে না। বরং আল-কায়েদার রাজনীতিকে সমালোচনাও করে। আধুনিক মনস্ক তুরস্কের নেতৃত্ব ইসলামিক বিশ্বে নতুন এক ইমেজ নিয়ে এসেছে। এন্নাহদার শীর্ষ নেতা ঘান্নুচি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের রাজনীতির অনুসারী। এ কথা তিনি স্বীকারও করেছেন। একসময় মিশরের ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন ঘান্নুচি। এখন সেখান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। 'তুরস্ক মডেল' এখন তার কাছে আদর্শ। গেল ২৮ নভেম্বর মিশরে সংসদ নির্বাচন শুরু হয়েছে। সেখানে ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস অ্যান্ড পিস পার্টির বিজয়ের পর ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সাথে তাদের সম্পর্ক কোন পর্যায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই দেখার বিষয়। সামরিক জান্তা প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এখানে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা পরিচালনা করা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ইয়েমেনের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট সালেহ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। তুলনামূলক বিচারে আল-কায়েদা অনেক শক্তিশালী ইয়েমেনে। এখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বিজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তরুণ সমাজ সেখানে সালেহ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাদের কোনো সংগঠন নেই। তরে আল-কায়েদার সাথে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে একটা ভয় থেকেই গেল। সিরিয়াতেও এদের তৎপরতা রয়েছে।
স্পষ্টতই আরব বিশ্বে ইসলামিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। ১৯৫২ সালে মিশরে জামাল আবদুন নাসেরের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যদিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রতিটি আরব রাষ্ট্রে। এখন তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রমনা একটি ইসলামিক শক্তির উত্থান, সমগ্র আবর বিশ্বে ছড়িয়ে যায় কিনা, সেটাই দেখার বিষয় এই ইসলামিক শক্তির সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। সেটাও লক্ষ্য করবে অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের সাথে কোন কোন আরব বিশ্বের সম্পর্ক ভালো ছিল। এখন মিসরে ইসলামিক শক্তির উত্থানে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সেরকমই একটি সম্ভাবনা দেখছেন। তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থী এন্নাহদার বিজয় এবং মরক্কোতে ইসলাপন্থী হিসেবে পরিচিত জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির বিজয় ইসরাইলের সাথে আরব বিশ্বের সম্পর্ক উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে এ দুটো দেশে ইসলামপন্থীরা যে বেশ নমনীয়, সেটিও লক্ষ্য করা যায়। কেননা এন্নাহদা ধর্মনিরপেক্ষ দুটি দলের সাথে তিউনিসিয়ায় একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে এন্নাহদার নেতা হামদি হানন প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস ফর দি রিপাবলিক পার্টির মুনসেফ মারজুফি হবেন প্রেসিডেন্ট, আর এত্তাকাতুল পার্টির মুস্তাফা বিন জাফর দায়িত্ব নিয়েছেন স্পিকারের। মরক্কোতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা একটি প্লাটফর্মে একত্রিত হয়ে সেখানে নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন। মরক্কোতে ইসলামপন্থী ও একক আসনে বিজয়ী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ধর্মনিরপেক্ষ ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি ও সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন অফ পপুলার ফোর্সের সাথে মিলে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে। মিসরের ব্যাপারটি এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। নির্বাচন সম্পন্ন হবে তিন পর্যায়ে, শেষ হবে জানুয়ারিতে। তবে এখানে ইসলামপন্থী বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে একটি ঐক্য হতে পারে এবং মর্ডারেটররা সেই কোয়ালিশনে যোগ নাও দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ১৯ মে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহায্য, সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিলেও, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে, তা বলা যাবে না। লিবিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ায় সেনাবাহিনীর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন, ইয়েমেনে আল-কায়েদা গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক সমুদ্র উপকূলবর্র্তী শহর জিনজিবার দখল প্রমাণ করে এ অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে পরিবর্তন আসছে। খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে আরব বিশ্বের সমাজ। ক্ষমতাসীনরাও কিছু কিছু ছাড় দিচ্ছে। নতুন সংবিধান, নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নতুন নতুন শক্তির উদ্ভব হচ্ছে। এরাই আগামী দিনের আরব বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে।
এই নতুন শক্তি ট্র্যাডিশনাল শক্তি নয়। আরব বসন্ত এর জন্ম দিয়েছিল তরুণ নেতৃত্ব। এদের অনেককেই 'প্রমোর্ট' করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যেমন বলা যেতে পারে মিসরের অঢ়ৎরষ ৬ গড়াবসবহঃ-এর কথা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসছে। এদের মাঝে হতাশাও এসে গেছে। মিসরে অতি সাম্প্রতিককালে আবারো তাহরির স্কোয়ারে জমায়েত হয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। এদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নেই। এরা বিপ্লবকে সংগঠিত করেছে সত্য। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পারেনি তিউনিসিয়াতেও। এমনকি ইয়েমেনে তরুণ সমাজ, সেখানে আন্দোলনকে সংগঠিত করলেও, সরকারের পতন ঘটেনি। তিউনিসিয়ার নির্বাচন দিয়েই প্রমাণিত হলো একটি ইসলামিক শক্তি সমগ্র আবর বিশ্বে উত্থান ঘটছে। এটা গত ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতির চতুর্থ ধারা। ১৯৫২ সালে মিসরে জামাল আবদুন নাসের ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনা করে প্রথম ধারার সূচনা করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে আরব বিশ্বে যুদ্ধ (ইসরাইলের সাথে) ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার সূচনা করেছিল। আর ২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব চতুর্থ ধারার সূচনা করল। এই চতুর্থ ধারা আরব বিশ্বে কী ধরনের পরিবর্তন আনে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

Post a Comment