রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চার দশকের বৈদেশিক নীতি : একটি মূল্যায়ন

গত চল্লিশ বছরের বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে
মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ্য করবো। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট
পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা
অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায়
আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এই তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য
অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে
তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, ক. সংসদীয় গণতন্ত্র, খ.
সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, গ. সমাজতান্ত্রিক সমাজ
কাঠামো, ঘ. নিরপেক্ষ রাজনীতি। কোন কোন বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে,
এটা ছিল অনেকটা ‘ভারতীয় মডেল।' ওই সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি
বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন- ক. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের
সাথে বাংলাদেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন, খ. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে
আদর্শ হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, গ. অর্থনৈতিক সাহায্যের
প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ঘ. চীনের সঙ্গে
সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস।
ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত যৌথ নিরাপত্তা
চুক্তির প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরোধী সরকারের ৭ দফা দাবির
প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন
ইত্যাদি কারণে বহি:বিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশ সোভিয়েত
ইউনিয়নের সাথে একটা এ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত
ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহিঃবিশ্বে  চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার
কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করছিল এবং সোভিয়েত-ভারত
সম্পর্কের কারণে এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা ‘চাপ'ও
ছিল, যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে
‘সমাজতন্ত্র' নির্মাণ করা যাবে না। ওই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত
মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে
আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও, ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
চীনের সাথে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল
হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে
পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা
হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মত
স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পরবর্তী ঘটনার মধ্যে দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া
রাষ্ট্র ক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ¡ী শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে
বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সাথে
সম্পর্ক বৃদ্ধির উপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে ইসলামের ব্রিজ স্বরূপ। জিয়ার
শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ
করে। আল কুদ্স কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের
মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের
নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯
সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত ঘচঞ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬
সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ও একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের
সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৭  সালে বাংলাদেশ
ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সাথে
সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সাথে শুধু
সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে
প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের
(১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, বেগম
জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক
নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের
সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের মাঝে
তেমন কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের উপর থেকে
‘সামরিক নির্ভরতা' কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি
উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়।

এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন
সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি
সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আÍপ্রকাশ করে, যদিও এর
উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌ-বাহিনী
দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও  তিনি ভারতের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ
করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য
দিক ছিল, ক. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া, খ. যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের
আরো উন্নতকরণ, গ. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরো কার্যকরী করা, ঘ.
সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, ঙ. ভারতের সাথে দ্বি-পাক্ষিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হবার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় বিচারক
কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ
নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ
করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী বৈদেশিক
নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন ‘কুনমিং
উদ্যোগ'-এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মায়ানমার, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের
রাজ্যগুলোও থাইল্যান্ডের সমন¦য়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা)। কিন্তু ভারতের
আগ্রহ ছিল ‘গঙ্গা মেকং সহযোগিতার' উপর, যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ' এর আর
জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ান এর সদস্য হতে চায়। যে কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ'
 এ যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। বেগম
জিয়ার সময় মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মায়ানমার
আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে মিয়ানমার
আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে।

শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো
ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব
দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী
একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর
নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ী শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে
এসেছিলেন। তার আমলে সার্ক এর ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত
(ঝঅএছ) গৃহিত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে
ভারতীয় পণ্য আমদানি সাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি
পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা
প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে
আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সাথে ‘হানা'
চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্টটেন্ট নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব
ক্ষুদ্র ঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে
বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের উপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর
উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা
হয়েছিল। বাংলাদেশ ঐ সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়
করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও
বাংলাদেশ ঐ বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ
দু'টি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমস্টেক এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ
সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামি বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের
সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও
দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী
হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছেন।

মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সাথে সম্পর্ক
সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে
বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরীও হয়েছে, যদিও
ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি বহু পাক্ষিকতার
আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান
বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার
কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই।
এমনকি ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে
সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি
রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই
হিমশিম খাবে। এক্ষেত্রে ‘সাতবোন' রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি
করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে
আমরা বাধ্য। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। উক্ত চুক্তিতে যে ‘ভাষা' ব্যবহার
করা হয়েছে তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের
স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত ৩ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের
দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার
পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও
(৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং
সেখানে কোন অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে তা জানানো হবে, এ
ধরনের প্রতিশ্র“তি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ
নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এ
ব্যাপারে তার কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ
কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়বে ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া
শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি
সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য
ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাবার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে
পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর পরই বেরুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনবিঘা আমরা পাইনি।
সমুদ্রসীমানা নিয়ে ভারতের সাথে বিবাদ (ভারত বাংলাদেশের সীমানার ৮ নং ব্লকে
৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪ নং ব্লকেরও দাবি ভারতের)
দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্র“তি
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে
বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন করা, কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি।
পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও
আমরা লক্ষ্য করি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট
প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য
রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও
বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বদর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক
নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়ক পথেই যে শুধু চীনে
যেতে পারবো তা নয়, বরং চীন তার ইডনান প্রদেশে পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্র
বন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সাথে
সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের
পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতোমধ্যে চীনকে
সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি সমর্থন
করতে পারে। সেক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের
পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে।
উক্ত সম্মলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে ‘গঙ্গা নদী অববাহিকা
সংস্থা' ও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন
নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও
মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চল বিপুল জ্বালানি সম্পদের
(জলবিদুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোকে এর সমাধান করছে। আর
বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব
করেছে, তা কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকাণ্ড
তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন¦য়ে ২০০১ সালে
‘কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলেছিলো। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে
“মেকং-গাঁদা সহযোগিতা”, যা ‘কুনমিং উদ্যোগ এর বিকল্প।

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের উত্থান-পতন হচ্ছে। এর ঢেউ এসে বাংলাদেশেও
লাগবে। ইউরোপ আমাদের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার। কিন্তু ইউরোপে
অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের পোশাক শিল্পে আঘাত হেনেছে। রফতানিতে ধস নেমেছে। এই
বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে এবং সেই
আলোকে পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আসিয়ান একটি বড় বাজার।
ভারত চেষ্টা করছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ ‘ডায়লগ পার্টনার' (বাংলাদেশ আসিয়ান
আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য)। বাংলাদেশকে তখন আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে উদ্যোগী
হতে হবে। সেই সাথে সার্ক ও আসিয়ানের মাঝে সম্পর্ক কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে
প্রচেষ্টাও চালাতে হবে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
সনাতন দেশগুলোতেই রফতানির বাজার আমরা খুঁজছি। গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য
কোনো নতুন বাজার আমরা খুঁজে পাইনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টির উপর
এখন গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকির মুখে যে ক'টি দেশ রয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ক্লাইমেট ভলনারেবেল ফোরাম' (সিভিএফ)-এর
তৃতীয় সম্মেলন। সম্মেলন শেষে ১৪ নবেম্বর ১৪ দফা ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয়। উক্ত ১৪
দফায় বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে
অর্থপ্রাপ্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, বিশেষ করে ‘আইলা' ও ‘সিডর'
পরবর্তী মানুষগুলোর দুরবস্থা বিষয়ক আসরে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কতটুকু সফল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু
পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো প্রধান। এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত
হয়েছে, তা বলা যাবে না। মহাজোট সরকারের সময় গত তিন বছরে জাতীয় রক্ষা
কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন,
সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানি, বিদেশে কর্মসংস্থান ইত্যাদি। ‘অপ্রচলিত ধারণা' তখন
বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক
মন্দা। তাই ২০২১ সালকে সামনে রেখে যেমন বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০
বছর) বাংলাদেশকে তার সনাতন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আর
শুরুটা করতে হবে এখন থেকেই। কিন্তু গত তিন বছর পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালিত
হয়েছে, তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা এক বড়ো প্রশ্ন
এখন। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী নীতি
বহন করা জরুরী। পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা,
ইউরোপ ‘ইউরোর' অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে
সাজানো প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক
আলোচনায় আমরা বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এ কারণে ‘বিশেষজ্ঞদের'
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কিত করা যায় এবং তাদের দ্বারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
পরিচালনা সম্ভব। মোটকথা পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে একদিকে যেমনি
প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, অন্যদিকে প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন। ভারতের উপর অতি
নির্ভরতা কমাতে হবে। সেই সাথে নিকট প্রতিবেশী চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিও
জরুরী। এ দিকটির দিকে লক্ষ্য রেখে আগামী দু' বছর সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতি
প্রণয়ন করে, তাহলে দেশটির জন্য তা মঙ্গলই বয়ে আনবে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment