রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

২০১২ : বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি

বিশ্বরাজনীতিতে ২০১২ সালে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে এ বছরের শেষের দিকে। ওবামার প্রার্থিতা নিশ্চিত হলেও চলতি বছরের শেষ দিন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত হয়নি কে হবেন রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। পুতিন তার প্রার্থিতা নিশ্চিত করলেও ডিসেম্বরে (২০১১) রাশিয়ায় ডুমা নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা ওই নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে রাশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে এখন। নিউইয়র্কে যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ সারাবিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল, তার রেশ আগামী বছরও থেকে যাবে। ঠিক তেমনি ‘আরব বসন্ত’ আরববিশ্বে যে পরিবর্তনের ঢেউ সৃষ্টি করেছিল, তা নতুন বছরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে সিরিয়া, বাহরাইনে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি মডারেট ইসলামী শক্তির ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তিউনিসিয়া ও মরক্কোয় এই পরিবর্তন এরই মধ্যে সাধিত হয়েছে।অতি সাম্প্রতিককালে একটা বড় অগ্রগতি হয়েছিল ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। ২০১০ সালের এপ্রিলে বারাক ওবামা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভের সঙ্গে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু এর বৈধতার জন্য দুই দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। দীর্ঘদিন বারাক ওবামা এটা নিয়ে লবিং করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২২ ডিসেম্বর সিনেটে ৭১-২৬ ভোটে তা অনুমোদিত হয়। রিপাবলিকানরা প্রথমে বিরোধিতা করলেও পরে তা অনুমোদন করেন। পরে ডুমাও তা অনুমোদন করে। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা কমাবে এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ৫৫০টি করে পরমাণু বোমা মোতায়েন রাখতে পারবে। এর আগে ২০০২ সালে যে স্টার্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার তুলনায় এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ কম। নিঃসন্দেহে এটা ছিল বড় অগ্রগতি। এতে করে দুই পরাশক্তির মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বছরে এর রেশ থেকে যাবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে এবং কোথাও কোথাও যা রাশিয়ার স্বার্থকে আঘাত করছে, তার কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তাতে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি রয়েছে। ইউক্রেন ও জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দেবে, এখানেও আপত্তি রাশিয়ার। জর্জিয়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিলে এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে, তা রাশিয়াকে এক ধরনের øায়ু যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেবে। কৃষ্ণ সাগর এলাকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঔড়রহঃ ঞধংশ ঋড়ৎপব-ঋধংঃ। রোমানিয়ার শহর কনসটানজার কাছাকাছি মিখাইল কোগালনাইসেনু বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দফতর। কিরগিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। আফগানিস্তানে এখনও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি। যদি সূক্ষ্মভাবে খোঁজ নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ছয়টি মহাদেশের প্রায় প্রতিটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এমনকি অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও ৫৪টি ‘সামরিক মিশন’ রয়েছে তাদের। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬৮০ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সামরিক কর্তৃত্ব রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখবে। নতুন বছরটি তাই এ কারণেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীলÑ তা হচ্ছে মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডুমার নির্বাচনের পর পুতিন প্রধানমন্ত্রী পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তিনি ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০০০ ও ২০০৪ সালে পর পর দুবার তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তিনি তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। তাই ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন আবার ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে পুতিন অতটা ‘উš§ুক্ত’ নন। কখনও-সখনও সমালোচনাও করেছেন। এখন দেখতে হবে পুতিনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন কীভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে।
গেল জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন তাওয়ের ওয়াশিংটন সফরও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিশ্বরাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহূর্তে চীনের সহযোগিতা দরকার। ২০০৯ সালের নভেম্বরে বারাক ওবামা বেইজিং সফর করেছিলেন। পরে ফিরতি সফরে হু জিন তাও গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। যদিও বেশবিছু ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক ভালো নয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও চীনা মুদ্রানীতি নিয়ে যে বিরোধ ছিল তা রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন মনে করে চীনা ইউয়ানের মূল্য অনেক কম, কিন্তু চীনা নেতারা এটা মানতে রাজি নন। ইরানের প্রশ্নেও দুই দেশের অবস্থান এক নয়। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতকে চীনের অংশ মনে করলেও দালাই লামার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পক্ষে হোয়াইট হাউস প্রশাসন। দালাই লামাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এটা চীন সহজভাবে গ্রহণ করে নিতে পারেনি। উত্তর কোরিয়াকে ছয় জাতি আলোচনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চীন রাজি থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনার পাশাপাশি নয়া নেতার ভূমিকার প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুই দেশের অবস্থানও ভিন্ন ভিন্ন। তবে চীনা নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ‘অংশীদারিত্ব’-এর কথা বলেছেন। এটাই মোদ্দা কথা। আধিপত্য নয়, প্রভাব বিস্তার নয়, সামরিক আগ্রাসনও নয়, দরকার সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যদি সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয়, তাহলে তা বিশ্ব স্থিতিশীলতার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে। হু জিন তাওয়ের ওয়াশিংটন সফরের মধ্য দিয়ে এ ধরনের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ওবামা প্রশাসন চাইছে চীন নয়া বিশ্বব্যবস্থায় একটি দায়িত্বশীল আচরণ করুক। চীনকে তারা মনে করছে ‘জবংঢ়ড়হংরনষব ঝঃধশবযড়ষফবৎ’। ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট জেমস স্ট্রাইন বার্গের ভাষায় এই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘ঝঃৎধঃবমরপ জবধংংঁৎধহপব’ হিসেবে।
তিনটি বৃহৎ শক্তিÑ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্বরাজনীতিতে আলোচিত হলেও ভারতের একটি ভূমিকা ২০১২ সালে নানা কারণে আলোচিত হবে। ভারত বিশ্বসভার (স্থায়ী পরিষদ) সদস্য হতে চায়। ওবামার তাতে সমর্থন ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে দাঁড়াবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৭ ভাগ অবদান রাখবে ভারত (২০০৭ সালে মাত্র দুই ভাগ)। যদিও এর জন্য প্রয়োজন আট থেকে নয় ভাগ প্রবৃদ্ধি। এ ধরনের মন্তব্য প্রমাণ করে ভারত ধীরে ধীরে একটি অর্থনৈতিক শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্ব যদি পাশের দেশগুলোর সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ ও ‘আচরণ’ পরিবর্তন না করে, তাহলে বিশ্বসভায় তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। চীন-ভারত সম্পর্কের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে অনেকের। যদিও ২০১০ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়া বাওয়ের নয়াদিল্লি সফর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনতে পারেনি। গত ১০ বছরে এ দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ৩০ গুণ। চুক্তি হয়েছে দুই হাজার কোটি ডলারের। চীন যা ভারতে রফতানি করে, আমদানি করে কম। ওয়েন জিয়া বাওয়ের ওই সফর ‘বাণিজ্যিক সম্পর্ক’কে বৃদ্ধি করলেও ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ বৃদ্ধি করতে পারেনি। তিব্বত ও তাইওয়ানকে ভারত চীনের অংশ মনে করলেও তখন যৌথ ইশতেহারে তা উল্লেখ করা হয়নি, যেমনি উল্লেখ করা হয়নি ‘জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’Ñ এ কথাটি। ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি (‘মুক্তার মালা’ নীতি) যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও চিন্তার কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১২ সালে এ বিষয়টি সম্পর্ক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব পাবে বেশি। বলা ভালো, ভারত ইজওঈ-ভুক্ত চারটি নব্য বড় শিল্পোন্নত দেশের সদস্য, যেখানে চীন ও রাশিয়াও রয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধে এ চারটি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ভূমিকাকে বিশ্বনেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। ডিসেম্বরে (২০১১) দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে যে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয় (কপ-১৭), তাতে এই দেশগুলোর ভূমিকা ছিল বড়। কেননা তারা বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে বেশি, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। ডারবানে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়নি। তবে ২০১২ সালে বিশ্বের উষ্ণতা রোধসংক্রান্ত কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কানকুনে (২০১০) উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারেও কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইজওঈ-ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা হবে লক্ষ্য করার বিষয়। ২০১২ তাই সঙ্গত কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও সেইসঙ্গে ইজওঈ-ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা ২০১২ সালের বিশ্বরাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment