রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে সেরা ব্যক্তিত্ব

টাইম ম্যাগাজিন ২০১১ সালের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রতিবাদকারীদের। নির্দিষ্ট করে কোন একটি এলাকার প্রতিবাদকারীদের চিহ্নিত করেনি টাইম, তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের বিক্ষোভকারী সবাইকেই টাইম ম্যাগাজিন ২০১১ সালের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গেল বছরের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার সিদি বওজিদ শহরের ফল বিক্রেতা মুহাম্মদ বওকুজিজি (২৬) নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তার মৃত্যু সারা আরব বিশ্বে একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। একে একে পতন ঘটেছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা শাসকদের। ১৯৬৮ সালে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল (প্রাগ বসন্ত), তার সঙ্গে মিল রেখেই সমাজবিজ্ঞানীরা আরব বিশ্বের পরিবর্তনকে নামকরণ করলেন ‘আরব বসন্ত’। আরব বসন্ত হচ্ছে এক ধরনের প্রতিবাদ, অন্যায়-অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। ঠিক একই ধরনের প্রতিবাদ আমরা লক্ষ্য করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নিউইয়র্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন গড়ে তুলেছে সাধারণ মানুষ। ১৯ ডিসেম্বর এই অকুপাই আন্দোলন পার করেছে ৯১ দিন। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় সমবেত হওয়া বিক্ষোভকারীরা পার করেছে ৭৫ দিন। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে দীর্ঘ ১৮ দিন অবস্থান করে বিক্ষোভকারীরা হোসনি মোবারককে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। আরব বসন্ত আর অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায় আর তা হচ্ছে অসমতা, দরিদ্রতা, কিছু ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া ইত্যাদি। মিল আছে আরও এক জায়গায়- তরুণ সমাজ সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই আন্দোলন গড়ে তুলছে। তবে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর টার্গেট হচ্ছে পুঁজিবাদ। কিন্তু আরব বসন্তের মূল টার্গেট পুঁজিবাদ নয়। এই অকুপাই মুভমেন্ট আর শেষ পর্যন্ত আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে গেছে ইউরোপের সর্বত্র। সেখানে অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে পতন ঘটেছে গ্রিস ও ইতালির সরকারের। এর আগে পতন ঘটেছিল পর্তুগালের সরকারের। আরব বিশ্বে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ক্ষমতাসীন সরকারের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব অনেকাংশে কাজ করেছে সত্য, সেইসঙ্গে বেকারত্ব, অসমতা, অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্বায়ন প্রভৃতিও অনেকাংশে দায়ী।

এ সংকট মূলত পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদ, সমাজের মাঝে যে অসমতা তা দূর করতে পারেনি। পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটেছে, তাকে বলা হচ্ছে সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে, যারা কর্পোরেট হাউস গঠন করে সব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। ধনীরাই কংগ্রেস সদস্য হচ্ছেন। সিনেটর হচ্ছেন। আর ধনীদের স্বার্থেই তারা আইন প্রণয়ন করছেন। যে কারণে দেখা যায় ধনীদের ট্যাক্স কমানো হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের ‘নিরাপত্তাবলয়’ (শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) সংকুচিত করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে অকুপাই মুভমেন্ট হচ্ছে, তার পেছনে কাজ করছে এই চিন্তাধারা। এটা এক ধরনের প্রতিবাদ। ‘বিপ্লব’-এর মূল স্পিরিটের সঙ্গে এর মিল আছে। দিনের পর দিন অবস্থান ধর্মঘট করে যে প্রতিবাদ, এই প্রতিবাদ তো এক ধরনের বিপ্লবই! এই বিপ্লব সারা ইউরোপে ছড়িয়ে গেছে। এই বিপ্লব পুঁজিবাদের সংকটকেই উসকে দিল। যদি পরিসংখ্যান নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের সঙ্গে (যেখানে এক ভাগ ধনী নিয়ন্ত্রণ করে মোট সম্পদের ৪০ ভাগ) জার্মানি, ইতালি কিংবা ব্রিটেনের সমাজের কোন পার্থক্য নেই। পুঁজিবাদ মুষ্টিমেয় লোককে আরও ধনী হতে সাহায্য করছে। ধনীদের ক্লাব হিসেবে পরিচিত জি-২০ এর দেশগুলো এখন বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। মাঝেমধ্যে জি-২০ এর দেশগুলো একত্রিত হয়ে গল্প-গুজব করে ‘ফটোসেশন’ করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতনে তাদের কোন সুস্পষ্ট নীতি নেই। তারা কোন সমাধানও দিতে পারেনি। গ্রিস যখন গেল নভেম্বরে বড় ধরনের সংকটের মাঝে পড়েছিল এবং রাষ্ট্রটির এক রকম দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন জি-২০ নেতারা ফ্রান্সের কান শহরে (৪ নভেম্বর) ফটোসেশনের জন্য মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। যারা নিউইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নওরিল রউবিনির ** লেখনীর সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী এই জি-২০ এর তিনি প্রচণ্ড বিরোধী। তিনি বলছেন ** এর কথা। তার মতে, জি-২০ পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ। তিনি লিখেছেন, **. এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। জি-২০ কোন সমাধান দিতে পারছে না, হাল ধরতে পারছে না বিশ্ব অর্থনীতির। ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্র এখন দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। আরও ঋণ দিয়েও সংকট মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। গ্রিস ও ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও, সাধারণ মানুষ এটা মেনে নেয়নি। তারা এখনও দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্রিসকে ‘উদ্ধার’-এর জন্য যে ঋণ দিয়েছে, তা ছিল শর্তযুক্ত। ওই শর্ত মেনেই আবাসন করের ওপর একটি বিল পাস করেছে গ্রিসের সংসদ। পাশাপাশি কমানো হয়েছে পেনশন। কমানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা। গ্রিসের রাস্তায় বিক্ষোভ ছিল তাই নিত্যদিনের চিত্র। এ চিত্র ইতালিতেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইতালি ও গ্রিসের বাইরে আয়ারল্যান্ড এবং পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গ্রিসে ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৩ ভাগ। আর দেশটির ঋণ পরিস্থিতি জিডিপির ১০০ ভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রিসের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিল না সরকার। এমনি এক পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও ইউরো জোনের দেশগুলো তিন বছরের জন্য ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শর্ত হিসেবে ঘাটতি কমানোর কথা বলা হলে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১১ ভাগ, ২০১০ সালে তা উন্নীত হয় ৩১ ভাগে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ৮৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি ‘উদ্ধার কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্তুগালের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০০৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭৬ ভাগ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ ভাগে। ফলে ২০১১ সালের মার্চে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং পর্তুগালকে ঋণ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ৭৮ বিলিয়ন ইউরো ঋণ গ্রহণে বাধ্য করা হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত জার্মানি কিংবা ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। এ কারণেই একক মুদ্রা হিসেবে চালু হওয়া ইউরোর ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় মুদ্রায় পুনরায় ফিরে যাওয়ার। বলা হচ্ছে, জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সমাধান হবে। ইউরোপের স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশগুলোর ধারণা ইউরো চালু হওয়ার পর ইউরোপের শক্তিশালী (অর্থনৈতিক দিক থেকে) ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইউরো তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না।

ফলে নিজ মুদ্রায় ফিরে যাওয়ার দাবি কোন কোন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।
‘ইউরো জোন’-এর এই অর্থনৈতিক সংকট, ইউরোপের ঐক্যকে বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। অথচ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হতো। এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ‘দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের কথা শুনেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ‘ইউরো জোন’-এর সংকটের ফলে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বব্যাপীই চলছে আন্দোলন। চিলিতে (সান্টিয়াগো শহরে) আন্দোলনকারীরা স্কুলগুলো দখল করে বিনাবেতনে শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে। ইসরাইলে আন্দোলন হচ্ছে জীবনযাত্রার মানের ঊর্ধ্বগতি আর অতিরিক্ত বাড়িভাড়ার প্রতিবাদে। স্পেনে যেখানে শতকরা ৫০ জন যুবক বেকার, সেখানে আন্দোলন হচ্ছে বেকারত্বের বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে লন্ডন শহরে আন্দোলন হচ্ছে শিক্ষায় বাজেট কমানোর প্রতিবাদে। জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে আন্দোলন হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিবাদে। অকল্যান্ড, তাইপে আর সিউলের বিক্ষোভের ধরনও অনেকটা তেমনই। মূল সুরটা এক জায়গায় বাঁধা- তা হচ্ছে বৈষম্য আর অসমতা।

এই বৈষম্য আর অসমতা হচ্ছে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা খারাপ দিক। বিশ্বায়ন নতুন ধরনের এক উপনিবেশবাদ তৈরি করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বেই আজ গড়ে উঠছে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন। আজ দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠছে, সেই আন্দোলনের ধরন ও চরিত্রের মাঝে পার্থক্য রয়েছে সত্য; কিন্তু বৈষম্য আর অসমতার প্রশ্নে মিল আছে সর্বত্র। আর মিল আছে বিধায়ই টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে এবার প্রতিবাদকারীরা ‘সেরা ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এর গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট। টাইমের মূল্যায়নকে হালকাভাবে দেখার তাই কোন সুযোগ নেই।
দৈনিক যুগান্তর ১৯ ডিসেম্বর,২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment