রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে ২০১১ সালে কোন বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? ‘ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড?’ ‘আরব বসন্ত?’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘তৃতীয় যুদ্ধ’, নাকি ‘অকুপাই মুভমেন্ট?’ টাইম সাময়িকী ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ বা বিশ্ব জুড়ে চলা প্রতিবাদ বিক্ষোভকে ‘বর্ষ সেরা ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই কাজটি টাইম সাময়িকী বরাবরই করে থাকে। এবারও করেছে। তবে কোনো ব্যক্তিকে এরা বর্ষসেরা করেনি, করেছে একটি আন্দোলনকে। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ার একটি ছোট্ট শহর সিদি বওজিদে তরুণ কম্পিউটার গ্রাজুয়েট ও জীবন ধারণের জন্য ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বওকুজিজির আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। তার আত্মহত্যা ‘আরব বসন্ত’-এর জন্ম দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের এই বিক্ষোভ ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে পুঁজিবাদের আখড়া হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে। ‘আরব বসন্ত’ ও ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়-আর তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততা। টাইম সাময়িকী সামগ্রিকভাবে বিক্ষোভকারীদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছে। টাইম মন্তব্য করেছে এভাবে, ‘বিক্ষোভকারীরা নিজেদের দুর্দশা ও দুর্ভোগের অভিযোগ তুলেই ক্ষান্ত হয়নি। বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। তরুণ সমাজের এই বিক্ষোভ সারা বিশ্বকে একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের জন্য তা নিঃসন্দেহে একটি শিক্ষা।’ একুশ শতকে ইন্টারনেট যে একটি সমাজকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, তার বড় প্রমাণ ‘আরব বসন্ত’, আর যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। দেশ, কাল, পাত্রের মাঝে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু সামাজিক নেটওয়ার্ক (ফেইসবুক, টুইটার) যেভাবে কায়রোর তেহরির স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষকে সমবেত হতে সাহায্য করেছিল, একইভাবে সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে জুকোটি পার্কে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার মার্কিন যুবা। যদিও নিউইয়র্কের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তেহরির স্কোয়ারের বিক্ষোভকারীদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নিউইয়র্কে বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি মার্কিন সমাজে অসমতা, বেকারত্ব দূর করা। একই সঙ্গে করপোরেট হাউসগুলোর একচ্ছত্র মুনাফা হ্রাস করা। যদিও ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় যে আন্দোলন হচ্ছে তার ধরনটা একটু ভিন্ন। তারা চাচ্ছে যুদ্ধের ব্যয় হ্রাস করে সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য) ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। আর তেহরির স্কোয়ার থেকে শুরু করে সারা আরব বিশ্বে যে আন্দোলন চলছে, এই আন্দোলনের মূল টার্গেট হচ্ছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকবর্গ, যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের উত্খাত করা। ইতোমধ্যে এই আন্দোলনের ফলে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছেন তিউনিসিয়ার জইনাল আবেদিন বেন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, আর ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহ। সঙ্গত কারণেই টাইম সাময়িকী যখন এই সব অভ্যুত্থানকে বছরের সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে, এর পেছনে যুক্তি রয়েছে বৈকি! কিন্তু শুধু ওই গণঅভ্যুত্থানকে সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার বিবেচনায় মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১১ সালের অন্যতম সেরা ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে আল কায়দার উস্কানি ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জন্ম বিশ্ব রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে জন্ম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র চ্যালেঞ্জকারী শক্তি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাবে চ্যালেঞ্জ করার কেউ থাকল না। কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারে হামলা ও তা ধ্বংস করা, পেন্টাগনের ব্যর্থ বিমান হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব জানল আল কায়দা নামের একটি সংগঠনের নাম, যারা ইসলাম ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। যদিও এটা আজও অস্পষ্ট রয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে একই সময়ে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে আত্মঘাতী হামলা চালানোর সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিরা কতটুকু জড়িত ছিল। যদিও আল কায়দা ওই হামলার সঙ্গে তার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল।
কিন্তু অনেক প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। টুইন টাওয়ার হামলাকে  কেন্দ্র করে আফগানিস্তান আক্রমণ করা ও দেশটি দখল করে নেওয়া, পাকিস্তানে লাদেনের আশ্রয় ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার তা না জানার কথা ইত্যাদি গত দশ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব এই মুহূর্তে হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইতিহাস হয়তো একদিন বলবে কী ঘটেছিল লাদেনকে ঘিরে। লাদেন অ্যাবোটাবাদে বসবাস করতেন পাঁচ বছর ধরে এবং দুই স্ত্রীসহ, কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যূহ ছাড়াই। যাকে সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তিনি কিনা একাকী বসবাস করবেন একটি বাড়িতে! পাকিস্তানের কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই তা জানবে না-এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? লাদেনকে হত্যার পর ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে অনেক ছবি ছাপা হয়েছিল অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িকে নিয়ে। একটি ছবি ছিল পাঁচ বছর আগের তোলা। সূত্র সিআইএ। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ওই বাড়িটি দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন এসে যায় পাঁচ বছর আগে যদি সিআইএ ওই বাড়িটি চিহ্নিত করে থাকে, (যেখানে লাদেন লুকিয়ে থাকতে পারেন এমন আশঙ্কা করা হয়েছিল) তাহলে সিআইএ এত সময় নিল কেন, লাদেনকে হত্যা করার? আরও একটা প্রশ্ন, মৃত লাদেনের ছবি সিআইএ ‘রিলিজ’ করল না কেন? নাকি লাদেনের নামে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, সে অন্য কেউ! এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবে লাদেনকে নিয়ে একটা ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। এই ‘মিথ’কে উস্কে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাক দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ঘটনায় গাদ্দাফিও উত্খাত হলেন। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। যুদ্ধের নামে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে মার্কিন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতিমাসে এই দুটো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে এই যুদ্ধের পেছনে? সুতরাং অবশ্যই লাদেনের মৃত্যু আমার কাছে ২০১১ সালের অন্যতম একটি ঘটনা। এর গুরুত্ব এ কারণে বেশি যে, লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? যদিও লাদেনের মৃত্যুর ৬ মাস পার হয়ে গেছে এবং আল কায়দার কোনো বড় ধরনের আক্রমণ আমরা বিশ্বের কোথাও লক্ষ করছি না। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর যে ধারণা উস্কে দিয়েছিল, তাতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেও ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। ইরাক ও আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। পাকিস্তান আজ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র যদি বদলে যায়, আমি অবাক হব না। ২০১১ সালের আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বের দাবি রাখে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সঙ্কটে পর্তুগাল, গ্রিস ও ইতালি সরকারের পতন ঘটেছে। গ্রিসের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কৃচ্ছ্র সাধন করেও অর্থনীতিকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ইউরোপের এই অর্থনৈতিক সঙ্কট দুটো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো টিকে থাকবে কি না? দুই. ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ঐক্যকে ধরে রাখতে পারবে কি না? ২৭টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মধ্যে ১৭টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। একটা প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে যে, ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইউরোপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই ধনী ও গরিব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ইউরোপের এই সঙ্কট ২০১২ সালেও অব্যাহত থাকবে, যা নতুন নতুন সঙ্কটের জন্ম দেবে।
ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ, ডারবানে ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন, ইরানের পারমাণবিক সঙ্কট ইত্যাদি বিষয়কেও হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর এখন পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যত্ একটা প্রশ্নের মুখে থাকল। খোদ জাপানের মতো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন যেখানে ঝুঁকির মুখে, সেখানে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ এরই মাঝে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে। ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসকল্পে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে একধরনের ‘ঈষরসধঃব অঢ়ধত্ঃযবরফ’ অর্থাত্ জলবায়ু বর্ণবৈষম্যের জন্ম হয়েছে। চলতি বছরও এর প্রভাব থাকবে। একই সঙ্গে সিরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১২ সালে বার বার আলোচিত হতে থাকবে। ইরাক থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চল থেকে তার হাত গুটিয়ে নিল, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। ২০১১ সাল শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১২ সালও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও অনেক নাটকীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment