রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টিপাইমুখ বাঁধ ও আমাদের জাতীয় স্বার্থ

ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর একটি মণিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে একটি বাঁধ নির্মাণ করছে, যা খোদ মণিপুর ও আসাম রাজ্যসহ বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে তা রাজনীতিতে কিছুটা হলেও 'ঝড়' তুলেছে। বিরোধী দল নেত্রী বেগম জিয়া এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। এর জবাব তিনি ইতিমধ্যে পেলেও মনমোহনের চিঠির বিষয়বস্তু এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সিলেটে গত ১ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে যে হাল্কাভাবে নিয়েছেন, তাও নয়। তিনি সংসদকে জানিয়েছিলেন একটি প্রতিনিধিদলকে তিনি নয়াদিলি্ল পাঠাচ্ছেন টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে ভারতীয় বক্তব্য জানার জন্য। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা নয়াদিলি্ল গেছেন। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, ভারত তাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে ভারত আবারো আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছে যে বাংলাদেশের ক্ষতি হোক, এমন কিছু তারা চায় না। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন, তখনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তথা ভারতের 'সাত বোন রাজ্যের' পরিবেশবাদীরা মনে করেন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মিত হলে ক্ষতি শুধু মণিপুর রাজ্যেরই হবে না, বরং তা বৃহত্তর সিলেট জেলাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কেননা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সেখানে কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করে পানি আটকে রাখা হবে। ফলে এই এলাকায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে চলে যাবে। উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে কয়েক শত পরিবার, যারা বছরের পর বছর পারিবারিকভাবে ওই অঞ্চলে বসবাস করে আসছিলেন। বাঁধটির উচ্চতা হবে প্রায় ১৬৩ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩৯০ মিটার। বাঁধটি দ্বারা বরাক ও তার উপনদীগুলোর মিলিত প্রবাহের গতিরোধ করে ২৮৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার তৈরি করা হবে। টিপাইমুখ বাঁধের ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে ফুলেরতল নামক স্থানে একটি বড় ব্যারাজও ভারত তৈরি করছে। এ ব্যারাজের সাহায্যে বরাক নদীর পানি সরিয়ে নিয়ে আসামের বিভিন্ন এলাকায় সেচের কাজে সরবরাহ করবে। এমনকি জলাধার থেকে টানেলের সাহায্যেও পানি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। ফলে বাংলাদেশ নির্দিষ্ট সময়ে পানি পাবে না। এর ফলে মেঘনা নদীর মোহনায় নদীর গভীরতা কমে যাবে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। পানির অভাবে হাওর, বিল, নিচু জলাভূমি শুকিয়ে যাবে।
ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাদপুর জেলার তুই ভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এসজেভিএনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫টি ইউনিট থাকবে, যার প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট। এতে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর এটি শেষ হবে ৮৭ মাসে। বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে, বাংলাদেশ বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। বরাক নদী পাহাড় থেকে নেমেই সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে এর স্রোতের গতি, বালু বহনের পরিমাণ পদ্মার চেয়ে অনেক বেশি। টিপাইমুখ হাই ড্যাম নির্মিত হলে নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতি বন্যা ইত্যাদির সবটুকুই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল-ঝিল, বাঁওড়, নদী-নালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। উর্বরা ধানের জমি পুরু বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেট ও সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, দেশের অর্থনীতিতে। ইতিমধ্যে বরাক নদীর দুই তীরে ভারত কর্তৃক অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বর্তমানে বরাক নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ ৫ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুরমার ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে। ভারত যে শুধু টিপাইমুখ বাঁধই নির্মাণ করছে, তা নয়। বরং উজানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২২৬টি বাঁধ নির্মাণ করছে ভারত। উদ্দেশ্য, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর ওপর ভারত ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে এবং ৮টি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন রয়েছে। আরো ৬৪টি নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হল এমন একটি সময়ে যখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যার্নাজির সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে এসে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হবেই। অথচ খোদ মনমোহন সিংই আমাদের জানান দিয়েছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে যে চুক্তি হতে আরো সময় লাগবে। গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের ন্যায় ক্ষমতায় এসেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি, তা সংবাদপত্রগুলোই সাক্ষী। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরে একটি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কথাও আমরা শুনছি। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। মোট ৩৭টি নদীকে ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনামতো পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিরোধী দল নেত্রী টিপাইমুখ প্রশ্নে সরকারকে সহযোগিতার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংসদে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ওই কমিটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, তা নিরূপণ করতে পারে। সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে পারে প্রকল্পটি বন্ধ রাখার জন্য। সেই সঙ্গে হিমালয় অঞ্চলের পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠন করা প্রয়োজন, যেখানে নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের পাশাপাশি চীনকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। উদ্যোগটা নিতে হবে বাংলাদেশকেই। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এখন শুধু পানি বণ্টনের বিষয়টি প্রধান্য পাওয়া উচিত। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টির পাশাপাশি টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অন্যতম একটি নির্ধারক হয়ে গেল। সরকারের আগামী দুই বছরের সময়সীমায় এ দুটো প্রশ্নে সরকার যদি কোনো সাফল্য দেখাতে না পারে, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা তাতে করে আরো হ্রাস পাবে। সুতরাং সরকার যদি শক্ত হাতে এ দুটো ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে দেন-দরবার করে এবং একটি সমাধান খুঁজে পায়, তা সরকারের জন্যই মঙ্গল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment