ছোট্ট মাইসার অপহরণ ও তার মায়ের কোলে ফিরে আসার কাহিনী একটি ‘বড় সংবাদ’-এ পরিণত হয়েছিল গত ২৩ এপ্রিল সংবাদপত্রগুলোতে। মাত্র আট মাসের শিশু মাইসাকে এই ঢাকা শহর থেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল ডাকাতরা। তারপর ওকে ডাকাতরা আটকে রেখেছিল প্রায় ১৮ ঘণ্টা। পুলিশ মাইসাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ডাকাতরাই ওকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই ১৮ ঘণ্টা মাইসার কেমন কেটেছে মাছাড়া, আমরা তা কোনো দিনই জানতে পারব না। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর ছবি যখন সকালের খবর-এ দেখলাম গত ২৩ এপ্রিল, আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। একটা অবুঝ বাচ্চা, যে কোনো পাপ করেনি, অন্যায় করেনি, তাকে কিনা টাকার লোভে এই ঢাকা শহরেই কিডন্যাপ করল ডাকাতরা! আমরা কোন শহরে বসবাস করছি এখন? ছিনতাই, রাহাজানি এসবে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। এখন কিনা বাচ্চা শিশু অপহরণ? মুক্তিপণ দাবি? ভাগ্য ভালো মাইসার বাবাকে মুক্তিপণ দিতে হয়নি। ডাকাতরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল তারা মাইসাকে ধরে রাখতে পারবে না। তাই ফেলে রেখে গিয়েছিল। তবুও ভালো মাইসার বাবার ফোন নম্বরটি রেখে গিয়েছিল।
এই ঘটনাটি আমাকে খুব বিচলিত করেছে। আমি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে খুবই উদ্বিগ্ন। একটি ছোট্ট বাচ্চা, যে কথা বলতে পারে না, সে যদি ‘কিডন্যাপ’ হয়, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা স্বীকার করি বাড়ি বাড়ি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের নয়। কিন্তু শহরে ডাকাতি কেন হবে? পুলিশের সোর্স কি কাজ করছে না? ওই সোর্সদের পেছনে তো লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ১৮ ঘণ্টা চলে গেল। পুলিশ মাইসাকে খুঁজে পেল না! এটা কি পুলিশ প্রশাসন তথা গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা নয়? তবুও আশা রাখছি যারা মাইসাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই ডাকাতদের আমি চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ যেন কোনো শৈথিল্য না-দেখায়। পুলিশ এটুকু ‘প্রমাণ’ করুক-আমি তাতেই খুশি। আমি পুলিশের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের দু’মাস পেরিয়ে গেছে। খুনিরা ধরা তো পড়েইনি, এমনকি এর মোটিভও বের করতে পারেনি পুলিশ। উচ্চ আদালত যখন পুলিশের ব্যর্থতা উল্লেখ করে র্যাবকে তা তদন্তের নির্দেশ দেন, তখন পুলিশের ওপর আমাদের আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমি বিস্মিত নই, র্যাব এই ঘটনার প্রকৃত কারণ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে পারবে কি না। যদি না পারে, তাহলে তা র্যাবের সব অর্জনকে ধূলিসাত্ করে দেবে। র্যাবের অনেক ভালো ভালো অর্জন আছে। দুষ্কৃতকারীদের মোকাবেলার জন্য র্যাবের মতো একটি সংগঠনের প্রয়োজনও রয়েছে-এটা নিশ্চয়ই অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনায় র্যাবের সব অর্জন ধূলিসাত্ হয়ে যাবে-এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
ইলিয়াস আলীর ‘ঘটনা’ নিয়ে আমরাও বিভ্রান্ত। তিনি কি অপহূত? নাকি নিজে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন? যদি ‘অপহূত’ হয়ে থাকেন, তাহলে এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। কেননা সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বা র্যাব তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আর যদি তিনি ‘নিজে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন’, তাহলেও এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব র্যাব ও পুলিশের। মনে রাখতে হবে এই একটি ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিদেশি মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় নেমেছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল। তারা এসেছিল সৌদি কূটনীতিক খালাফ আল আলির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে। ওই হত্যাকাণ্ডেরও কোনো কূল-কিনারা হয়নি। একটি সৌদি সংবাদপত্র এ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছিল, তা যেকোনো বিবেচনায় উদ্বেগের কারণ। সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি আগামীতে একটি হুমকির মুখে থাকবেন, এ ধরনের মন্তব্য কোনো আশার কথা বলে না। আমি বুঝতে অক্ষম কেন খালাফ আল আলির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হল না। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে-তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘একের পর এক’ যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে এবং তাতে সংবাদপত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য সত্যিই দুঃখজনক। আমি নিজেও এ ঘটনায় বেশ বিব্রত। কেননা আমার অনেক ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরা সবাই আমার প্রিয়জন। এমনকি অনেক জেলার পুলিশ সুপার আমার লেখার নিয়মিত পাঠক। আমার একটা গর্বের জায়গা এদেরকে নিয়ে। স্বয়ং ডিএমপির পুলিশ কমিশনার আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তিনি বিদেশে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতিসংঘের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গে একদিনের আলাপচারিতায় তার ওপর আস্থাটা আমার বেড়ে গিয়েছিল। তার ‘চায়ের দাওয়াত’ আমি রাখতে পারিনি বটে। কিন্তু তাকে সেদিন বলেছিলাম (একটি পত্রিকার অনুষ্ঠানে) ঢাকা শহরকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখবেন। ঢাকা শহরে থানার সংখ্যা বেড়েছে। সম্ভবত থানার সংখ্যা এখন ৪৭টি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও অনেক। কিন্তু সবাই কি যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন? খিলগাঁও থানার ওসিকে শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। আমি যে এলাকায় থাকি (আদাবর), সেই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। সব বিষয় উচ্চ আদালতের নজরে আসে না। ডিএমপির কমিশনারের নজরেও আসে না। একজন সাধারণ নাগরিক যেতে পারেন না ডিএমপি কমিশনারের কাছে। কিন্তু একজন ওসি যখন অন্যায় করেন, তার দায়-দায়িত্ব আপনার কাঁধেও পড়ে ডিএমপি কমিশনার সাহেব। আদাবর থানার ওসি যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, এটা দেখার দায়িত্বটি কার? ৪৭টি থানার সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব ডিএমপির কমিশনারকেই নিতে হবে সঙ্গত কারণেই। একজন খিলগাঁও থানার ওসি যদি তার যোগ্যতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাকে সরিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। আজ মাইসার ঘটনায় প্রমাণিত হল খিলগাঁও থানার ওসি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। আর যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তিনি ওই পদের জন্য উপযুক্ত নন বলেই বিবেচিত হবেন। আদাবর থানার ওসির ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ছোট্ট বাবু মাইসা তার মার কাছে ফিরে এসেছে, এটা আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া। ও হয়তো বড় হয়ে ওই স্মৃতি মনে রাখতে পারবে না। কিন্তু ওর বাবা-মা ঠিকই মনে রাখবে। এই দেশটিকে আমরা ‘ডাকাত’দের দেশে পরিণত করতে পারি না। ক্রাইমের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। অপহরণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু শিশু অপহরণের ঘটনা এই ঢাকা শহরে সম্ভবত প্রথম। প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস এই ঢাকা শহরে। এখানে ক্রিমিনালদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ক্রাইমের ধরনও। তাই ‘কমিউনিটি পুলিশ’-এর কর্মকাণ্ডকে আরও বাড়াতে হবে। শুধু পুলিশ দিয়ে ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মাইসাকে ফেরত পাওয়া যেমনি আনন্দের, ঠিক তেমনই একটি ‘সতর্ক বার্তা’ও বটে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র : দৈনিক সকালের খবর
৩০ এপ্রিল ২০১২