রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি




এটা মোটামুটিভাবে এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, ভ্যাকসিন ছাড়া করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আসবে না। কিন্তু এই ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই তা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গেল সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, রাশিয়া কোভিড-১৯ এর একটি ভ্যাকসিন স্পুটনিক ৫-এর অনুমোদন দিয়েছে। রাশিয়া মহাশূন্যে প্রথম একটি নভোযান পাঠিয়েছিল ১৯৫৭ সালে, যার নাম ছিল ‘স্পুটনিক’। আর ওই নামকে সামনে রেখেই রাশিয়া করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনটি আনল।


তবে রাশিয়ার ওই ভ্যাকসিনটি নিয়ে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন, তারা বলেছেন রাশিয়া ব্যাপক ‘পাবলিক ট্রায়াল’ ছাড়াই ‘স্পুটনিক ৫’-এর অনুমোদন দিয়েছে। যদিও পুতিন প্রকাশ্যেই বলেছেন, তার দুই কিশোরী মেয়ে ‘স্পুটনিক ৫’-এর ট্রায়ালে অংশ নিয়েছে। তবে মজার বিষয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও (চীনা ভ্যাকসিনকে তিনি অবজ্ঞা করে বলেছি Kung Flu ) রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ব্যাপারে তার মন্তব্য অনেকটা ইতিবাচক।


গত ১৪ আগস্ট হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, তিনি আশা করছেন এই ভ্যাকসিনটি কাজ করবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্যাকসিনটির ব্যাপক ব্যবহারের পরও কোভিড-১৯ এর সঙ্গেই মানবগোষ্ঠীকে বসবাস করতে হবে। অনেকটা স্মলপক্সের মতো। ১৯৮০ সালে স্মলপক্স নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। বহুল আলোচিত স্পেনিস ফ্লুর কথাও আমরা বলতে পারি। ১৯১৮-১৯২০ সালে স্পেনিস ফ্লু মহামারী আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ কোটি মানুষ। এটা ছিল এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত ভাইরাস, যা পরে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কোভিড-১৯ ওই গোত্রীয় একটি ভাইরাস।


এযাবৎকালের যতগুলো মহামারীর কথা জানা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক সময় তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তাই করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই আমার ধারণা। তবে এই ভাইরাসটি আর কতদিন দাপিয়ে বেড়াবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। এই করোনা ভাইরাস ও এর প্রতিষেধক ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্টনার Astra-Zeneca এবং ফাইজার- BioN Tech SE সম্মিলিতভাবে করোনা প্রতিরোধে একটি টিকা আবিষ্কারের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একে এখনো যেতে হবে অনেক দূর- এখনো তৃতীয় ট্রায়াল সম্পন্ন হয়নি।


ব্লুমবার্গ গবেষকদের তথ্যমতে, ২০২২ সালের প্রথম কোয়ার্টারের আগে কোনোমতেই এক বিলিয়ন ডোজের এই টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না (আগস্ট ২, ২০২০)। টিকা আবিষ্কারের আগেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইইউ ও জাপান ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গেল জুন মাসেই ১৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল পরীক্ষামূলক টিকার জন্য। ২০২১ সালের জন্য তাদের বরাদ্দ ২০ মিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো কী পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই টিকা পাবে? এই টিকা সরবরাহের ব্যাপারে গঠিত হয়েছে COVAX Initiative. ৭৫টি দেশ ইতোমধ্যে ইচ্ছা পোষণ করেছে এই উদ্যোগে যোগ দিতে।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ এই উদ্যোগের সঙ্গে নেই। এরা টিকা বিপণনে অর্থায়ন করবে। তবে GAVI  বা The Global Alliance for Vaccines and  Immunization  আরও একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যারা গরিব দেশগুলোকে বিনামূল্যে টিকা সরবরাহ করবে! GAVI -এর অনেক উদ্যোগ অতীতে প্রশংসিত হয়েছিল। GAVI বিশ্বের ৭৬০ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দিয়ে তাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বাংলাদেশ GAVI প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এখন দেখার পালা, বাংলাদেশ কোন প্রক্রিয়ায় এই টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে।


বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের টিকার ট্রায়াল নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, একটি চীনা কোম্পানি Sinovac-কে সরকার বাংলাদেশে তাদের উৎপাদিত ওষুধের ট্রায়াল করার অনুমতি দেবে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল ওই অনুমোদনটি দিয়েছিল (৩১ জুলাই)। সংবাদে এটাও জানানো হয়েছিল যে, ট্রায়ালের জন্য ৪২০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকেও নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে পরে জানানো হয়, এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর কারণ কী হতে পারে?


একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি সংবাদকর্মীদের কাছে জানিয়েছেন, সিদ্ধান্তটা একটা  Geo political issue অর্থাৎ এই ট্রায়ালের সঙ্গে একটা ‘রাজনীতি’ জড়িত (ওই)! আমরা আসলেই জানি না কেন চীনের কোম্পানি (বেসরকারি) Sinovac-এর ট্রায়ালের সঙ্গে ‘কোন রাজনীতি’টা জড়িত? তবে সংবাদপত্র মাধ্যমেই আমরা জেনেছি, চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান Sinopharma  আরব আমিরাতে ১৫০০ ব্যক্তির ওপর তাদের ট্রায়াল প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আবার Sinovac  ব্রাজিলেও তাদের ট্রায়াল শুরু করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ব্রাজিলে করোনা ভাইরাসে এযাবৎ মৃত্যুর সংখ্যা ৯৪১৩০ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ২৭৩৩৬৭৭ জন।


সে তুলনায় আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যদি Sinovac -এর ট্রায়াল বাংলাদেশে সফল হয়, তা হলে বাংলাদেশ বিনামূল্যে এই ওষুধটি পাবে। এমনকি স্থানীয়ভাবে Sinovac  বাংলাদেশেও এটি উৎপাদন করবে ও বাজারজাত করবে- এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। Sinovac  তাদের উৎপাদিত ওষুধের তৃতীয় স্টেজের ট্রায়াল ইতোমধ্যে জীবজন্তুর ওপর এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর প্রয়োগ করে সফলতা পেয়েছে। আমরা এখনো জানি না চূড়ান্ত পর্যায় Sinovac  তাদের তৃতীয় স্টেজের ট্রায়াল বাংলাদেশে সম্পন্ন করবে কিনা? আর শেষ পর্যন্ত যদি ট্রায়াল না-ই হয়, তা হলে বাংলাদেশ একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। করোনা টিকা উদ্ভাবন, বিপণন কিংবা ব্যবহারের সঙ্গে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রশ্ন জড়িত।


বিশ্বের বড় বড় ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে’ এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়। তাদের স্বার্থ থাকে টাকা কামানো। করোনা ভাইরাসের টিকার সঙ্গে এ রকমটি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সুতরাং একটা মৌলিক প্রশ্ন থাকলই- যেখানে বড় বড় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, সেখানে তারা চীনা কিংবা রাশিয়ান কোম্পানিকে বিনামূল্যে উন্নয়নশীল বিশ্বে তা সরবরাহ করতে দেবে কিনা? চীন ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা বিনামূল্যে তা সরবরাহ করবে। রাশিয়া জানিয়েছে, তাদের ওষুধ তারা সৌদি আরব ও ব্রাজিলে ট্রায়াল দেবে। তারাও বিনামূল্যে তা সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে।


ইতোমধ্যে ওই ভ্যাকসিন নিয়ে এক ধরনের ‘রাজনীতি’ শুরু হয়ে গেছে। আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাই অক্টোবরেই তিনি ভ্যাকসিনটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আনতে চান। কিন্তু সেখানেও আপত্তি উঠেছে- এটা সম্ভব নয় বলে অনেকেই মনে করছেন। যেখানে করোনা ভাইরাসের ‘দ্বিতীয় স্রোত’ যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো রাজ্যে নতুন করে আঘাত করেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিনের ব্যাপক ট্রায়াল ছাড়াই অক্টোবরে ভ্যাকসিনটি বাজারে আনা, নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিগুলো এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন।


কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনেক নীতি ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যেমন বলা যেতে পারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার। নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত মহামারী নির্মূল প্রক্রিয়ায় শ্লথগতি এনে দেবে। অতীতে আমরা দেখেছি, স্নায়ুযুদ্ধকালীন পোলিও ও স্মলপক্স নির্মূলে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তার ব্যাপক ব্যবহারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন একসঙ্গে কাজ করেছিল। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সহায়তা করেছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এমনটি লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীনবিরোধী বক্তব্য ও ‘চীন থেকে এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে’- এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি চীনকে একটি ‘শত্রু শিবিরে’ ঠেলে দিয়েছেন। ফলে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিপণনের কাজটি খুব সহজ হবে না।


কোভিড-১৯ একটি মহামারী। পৃথিবীর ২১৩ দেশ ও অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২১৮২৬৪৫০ জন, আর মৃত্যুর সংখ্যা ৭৭৩০৭২ জন। নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও রিপোর্ট হচ্ছে। সংক্রমণ বাড়ছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন এক পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রায় ৮ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হলে কত বছর লাগবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন।

Daily Amader Somoy

20.8.2020

0 comments:

Post a Comment