রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভাবমূর্তি সংকটের মুখে বাংলাদেশ

 


 

সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে। গত ১০ জুলাই এর খবর ছিল এ রকম : নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইতালি, জাপান ও কোরিয়া। অর্থাৎ এসব দেশে বাংলাদেশিরা আপাতত আর যেতে পারছেন না। কারণ ওইসব দেশে যেসব বাংলাদেশি অবস্থান করছিলেন তারা যখন ফিরে যান, তখন তাদের শরীরে কভিড-১৯ 'পজিটিভ' ধরা পড়ে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইতালির নাগরিকরা করোনাভাইরাস 'নেগেটিভ' সার্টিফিকেট নিয়ে রোম বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তাদের শরীরে করোনাভাইরাস 'পজিটিভ' ধরা পড়ে। ফলে তাদেরকে আর ইতালি ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাদের সবাইকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এই ঘটনায় আকাশপথ বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ইতালি আগামী এক সপ্তাহ বাংলাদেশ থেকে আসা সব ফ্লাইটে নিষেধজ্ঞা আরোপ করেছে। ইতালির পর তুরস্কও ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশও বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীনের চায়না সাউদার্নও ঢাকায় ফ্লাইট চালাতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে যা জানা যাচ্ছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছে ভুয়া করোনা 'নেগেটিভ' সনদ। এদের অনেকেরই করোনা 'পজিটিভ' ছিল। কিন্তু তারা ভুয়া করোনা 'নেগেটিভ' সনদ সংগ্রহ করে। সম্প্রতি ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে দেখতে পায় যে, সেখান থেকে কোনো পরীক্ষা না করেই করোনাভাইরাস 'নেগেটিভ' রিপোর্ট দিয়েছে, শুধু টাকার বিনিময়ে। প্রায় কয়েক কোটি টাকা এভাবেই 'আয়' করেছে রিজেন্ট হাসপাতাল, যে প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইতালিতে ঢুকতে না দেওয়া বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ইতালিয়ান নাগরিকদের অনেকেই এই হাসপাতাল থেকেই ভুয়া রিপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। রিজেন্ট হাসপাতালের পাশাপাশি আরও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে, যারা ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিল টাকার বিনিময়ে। 


এই প্রতিষ্ঠানটির নাম জেকেজি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই জেকেজি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছিল। ওইসব টেস্টে জনপ্রতি নেওয়া হতো সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশিদের কাছ থেকে একশ' ডলার। আর এভাবেই তারা হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ তাদের কোনো ল্যাব বা পরীক্ষাগার ছিল না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত জেকেজি হেলথের চেয়ারম্যান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী। সংবাদপত্রে তাদের সম্পর্কে প্রতিবেদন এলেও, ডা. সাবরিনা জানিয়েছেন জেকেজির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। ইতালি থেকে যাদের ফেরত পাঠানো হয়, তাদের মাঝে কেউ কেউ এই জেকেজির ভুয়া সনদধারী করোনা রোগীও থাকতে পারেন। একজন সাহেদ কিংবা সাবরিনা-আরিফ জুটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কোথায় নিয়ে গেছেন, তা ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পো কন্তের একটি মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ইতালির ফ্লাইট বন্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে কন্তে সম্প্রতি বলেছেন, 'বাংলাদেশ থেকে আসা বেশিরভাগ যাত্রীর মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। একেকজন বাংলাদেশি একেকটা 'ভাইরাস বোমা' (ইত্তেফাক, ১১ জুলাই)। কী সাংঘাতিক কথা! একেকজন বাংলাদেশি ভাইরাস বোমা! কন্তে একটি প্রশ্ন তুলেছেন- এসব নাগরিকরা কীভাবে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হলো যেটা অবশ্যই ভাবার বিষয়। 


আমাদের ভাবনার জায়গাটা এখানেই- ভুয়া সনদ আর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার বিষয়টি। আমরা যারা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করি, একজন বিদেশি প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য আমাদের জন্য কি কোনো শঙ্কা তৈরি করে না? লাখ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে যান, কাজ করেন, বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে অনেকে বিদেশে বসবাস করেন। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। ইতালির ঘটনাবলি যখন বিশ্বের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়, তখন আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? শত শত বাংলাদেশি এখন নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়বেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশনের কড়া নজরদারিতে এরা পড়ে যাবেন এখন। এরা বাংলাদেশের কোনো রিপোর্টকেই আর গ্রহণ করবে না। ফলে নতুন নতুন আইন, বিধিনিষেধ আর ডিপোর্টের মুখোমুখি হবেন তারা।


করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে তখন আরেকটি সংবাদ আমাদের শঙ্কার জায়গাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবারের ঘটনা ভিয়েতনাম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন আমাদের জানালেন, ২৭ জন বাংলাদেশি ভিয়েতনামে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস 'দখল' করে নিয়েছে (ডেইলি স্টার, ৭ জুলাই)। কী সাংঘাতিক কথা? দূতাবাস দখল? স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন সে কথা! জানা গেল, এসব বাংলাদেশি দালালদের খপ্পরে পড়ে ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন এবং তারা সবাই সরকারি খরচে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই তারা গিয়েছিলেন দূতাবাসে। দূতাবাস তাদের দেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা করলেও, তারা টিকিটের টাকা দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এই ঘটনাকে 'দূতাবাস দখল' ও এর সঙ্গে ডাকসুর ভিপিকে জড়িয়ে মন্তব্য করেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! আসলেই কি এরা 'দূতাবাস দখল' করতে গিয়েছিলেন? এ ধরনের মন্তব্য করা কি একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোভা পায়? 


আসল জায়গায় ফিরে আসি। একটা দালালচক্র বাংলাদেশিদের ভিয়েতনাম নিয়ে গেছে, সেখান থেকে তাদের অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করবে বলে। ভিয়েতনামে বিদেশিদের জন্য কোনো কাজের জায়গা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের মতো ভিয়েতনামে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন নেই। তাদের জনশক্তি তাদের নিজ দেশের চাহিদার জন্য যথেষ্ট। অথচ দালালচক্র তাদের ভিয়েতনাম পাঠিয়েছিল। প্রশ্নটা এখানেই- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্তব্যরত ইমিগ্রেশনের স্টাফরা ভিয়েতনামগামী বাংলাদেশিদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিলেন কীভাবে? কোন ভিসায় তারা সেখানে গিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই 'ওয়ার্ক ভিসা' তাদের ছিল না! ট্যুরিস্ট ভিসার সম্ভাবনা বেশি। ইমিগ্রেশন অফিসাররা কী এটা বুঝবেন না কারা এবং কী উদ্দেশ্যে সেখানে যাচ্ছেন? এখানে 'হিসাব'টা সহজ। দালালচক্র জানে কীভাবে, কোন উপায়ে, কোন পদ্ধতিতে এসব লোকদের বিমানবন্দর 'পার' করতে হয়! সবচেয়ে বড় কথা, ভিয়েতনামে 'লোক পাঠানোর' ঘটনা এই প্রথম নয়। পাঠকদের ২০১৯ সালের ৯ মার্চে নিউএজে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করি। এক বছর আগের সংবাদ- বলা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের প্রলুব্ধ করে দালালচক্র ভিয়েতনামে 'লোক' পাঠাচ্ছে! এভাবে দালালচক্র ভিয়েতনামে বাংলাদেশিদের পাঠিয়েছে। এদের টার্গেট ভিয়েতনাম নয়, টার্গেট অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। দালালরা নৌকায় করে তাদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠায়। প্রায় ক্ষেত্রেই সমুদ্রে এরা অস্ট্রেলিয়ার কোস্টগার্ডের নজরে আসে, তারপর তাদের স্থান হয় ক্রিসমাস কিংবা কোকোস দ্বীপপুঞ্জের 'ডিটেনশন সেন্টারে'। কিংবা পাপুয়া নিউগিনির লস নেগরোস দ্বীপে। কতজন বাংলাদেশি এসব 'ডিটেনশন সেন্টারে' এখনও আছেন, তার খবর আমরা কোনোদিনই পাব না। 


ইতালি আর ভিয়েতনামের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। প্রায় ক্ষেত্রেই এসব ঘটনায় যারা জড়িত থাকেন, তাদের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। আমরা সাহেদ, সাবরিনা-আরিফদের খবর জেনেছি। কিন্তু ভিয়েতনামের ঘটনায় কারা তাদের সেখানে পাঠিয়েছিল, আমরা তাদের পরিচয় জানি না। ঘুষ, দুর্নীতি, শৈথিল্য, অদক্ষতা, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া বাংলাদেশকে আজ কোথায় নিয়ে গেছে, এই দুটো ঘটনা তার বড় প্রমাণ।

Samakal

13.7.2020

0 comments:

Post a Comment