রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রদীপের নিচে অন্ধকার



প্রদীপের নিচে কি সবসময় অন্ধকারই থাকে? সেই প্রচলিত বাক্যটি আবারও সত্যে পরিণত হলো যখন জনৈক প্রদীপ কুমার দাশের ‘নানা কেচ্ছা-কাহিনী’ নিত্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে।


প্রদীপ এখন কারাগারে। অভিযোগটি গুরুতর একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা। ‘ক্রসফায়ার’! এই শব্দটি সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আবার এক ধরনের ‘অ্যালার্জি’ আছে। তারা মনে করেন, এই শব্দটি এনজিওরা ব্যবহার করেন।

প্রদীপ কুমার দাশের চাকরির বয়স ২৫ বছর। ১৯৯৫ সালে সাব ইন্সপেক্টর হিসাবে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন কারাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এখন বরখাস্ত। গেল ২৫ বছরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। চট্টগ্রামের ‘মাস্তান’ তিনি। ঘুরেফিরে বারবার তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানাতেই থেকেছেন। ফলে নানা দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না। সংবাদপত্রে তার সম্পর্কে যেসব খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে, তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা আমি বলতে পারব না। তবে চট্টগ্রামে তার বাড়ি, বৃহত্তর চট্টগ্রামের ‘ক্রাইম জোন’ হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোতে তার বারবার পোস্টিং যে মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা ভেবে দেখতে পারে এভাবে নিজ জেলায় পুলিশ কর্তকর্তাদের পোস্টিং দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক?


একজন প্রদীপ, ‘ক্রাইম জোন’ হিসেবে পরিচিত টেকনাফ থানার দায়িত্বে ছিলেন ২২ মাস। টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ২২ মাসে ১৪৪টি কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন ২০৪ জন! ডিবিসি টিভি চ্যানেলটি আমাদের আরো জানাচ্ছে, 'ক্রসফায়ারে’র ভয় দেখিয়ে তিনি অবৈধ টাকা আয় করতেন। আমি জানি না অভিযোগটির পেছনে কতটুকু সত্যতা আছে! তবে প্রশ্ন তো আছে অনেকগুলোই। ডিবিসি চ্যানেলের অভিযোগটি যদি সত্য না হয়ে থাকে, যদি মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন হয়, তাহলে পুলিশ প্রশাসনের উচিত ছিল তার প্রতিবাদ করা। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন কি তা করেছে? আবার অভিযুক্ত হিসেবে বারবার প্রদীপের নাম আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কক্সবাজারের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি কি অজানা ছিল?

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর আরেকজন অভিযুক্ত আসামিকে পুলিশ সুপারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুনেছি, যা মিডিয়ায় ‘ফাঁস’ হয়ে গেছে। এতে বোঝা যায়, পুলিশ সুপার ওই অভিযুক্তকে ‘পরামর্শ’ দিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন!

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ওই কণ্ঠটি যদি পুলিশ সুপারের হয়ে থাকে, তাহলে ওই হত্যাকাণ্ডের দায় তিনিও এড়াতে পারেন না। অদক্ষতা, খুনিকে বাঁচানোর চেষ্টার অভিযোগ নিশ্চিতভাবেই তার বিরুদ্ধে উঠবে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন তদন্তে ওই সুপারের বিরুদ্ধে উল্লেখিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফিরে যাই প্রদীপ দাশের প্রসঙ্গে। তার বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ অসৎ পথে উপার্জনের অভিযোগ আছে। গত ৯ আগস্ট এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (যুগান্তর)। মজার কথা হলো, দুদক একবছর আগে তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা থেমে গিয়েছিল। ২০১৮ সালেই দুদক প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। প্রদীপ দাশের স্ত্রী চুমকি গৃহিণী হলেও, দুদকে জমা দেওয়া সম্পদ বিপরীতে দেখা যায় তার মৎস্য খামার থেকে বছরে আয় কোটি টাকা!

নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় চার শতক জমি কিনে (৮৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা) সেখানে ছয় তলা ভবন করেছেন (১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা), ২০১৫-১৬ সময়সীমায় জমি কিনেছেন অন্তত ১ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকার, রয়েছে কক্সবাজারে ১২ লাখ ৩২ হাজার টাকা দামের ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে স্ত্রীর স্থাবর সম্পদের মূল্য জানানো হয়েছে ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা। এর বাইরেও আছে একটি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, আছে ৪৫ ভরি সোনা (যুগান্তর)।

প্রদীপ দাশের নিজের সম্পদের হিসাব অবশ্য আমরা পাইনি। তবে সংবাদপত্রটি আমাদের জানিয়েছে, ভারতের আগরতলা, কলকাতার বারাসাত, গৌহাটি ও অস্ট্রেলিয়ায় তার বাড়ি আছে। এগুলো নিশ্চই প্রদীপ দাশ তার সম্পদ বিবরণীতে দাখিল করেননি। এর ফলে এ সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটন করা হবে কঠিন কাজ। প্রদীপের বাবা অত্যন্ত সৎ ছিলেন। তার বাবা হরেন্দ্র লাল দাশ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। একজন নিরাপত্তা প্রহরীর সন্তান কিভাবে এত বিপুল সম্পত্তির মালিক হন, প্রশ্ন তো সেখানেই।

এটা ঠিক, একজন প্রদীপকে দিয়ে আমি পুরো পুলিশ বাহিনীকে বিচার করব না। কিন্তু এ ঘটনায় একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে সাধারণ একজন নন-ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তা তার চাকরি জীবনে এত বিপুল সম্পদের মালিক হতে পারেন কি? তার পরিচয় যা পেয়েছি, তাতে দেখা যায় তিনি প্রদকপ্রাপ্ত এবং তা একাধিকবার। অর্থাৎ তার দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাহলে একজন দক্ষ অফিসারও যে দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারেন, প্রদীপ তো তারই প্রমাণ। একইসঙ্গে এটিও স্পষ্ট হলো— কাউকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে দক্ষতা কোনো গ্যারান্টার নয়। সরকার অনেক আগেই বেতন বাড়িয়েছে সব সরকারি কর্মকর্তার। তার ‘বেনিফিট’ প্রদীপ দাশও পেয়েছেন। তারপরও কেন দুর্নীতি?

এখন দুদকের দায়িত্ব অনেক বেশি। তারা যাচাই করে দেখুক তার নামে যে সম্পত্তি রয়েছে, তার বৈধতা কতটুকু। তার হলফনামায় তো সব তথ্য দেওয়া আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, তার স্ত্রীর পাসপোর্টে ভারতীয় মাল্টিপল ভিসার স্টিকার রয়েছে। তার আদৌ কলকাতা কিংবা গৌহাটিতে বাড়ি আছে কি না, তা যাচাই করাও কঠিন কিছু নয়। দুদক নিশ্চই তার স্ত্রীকে ডাকবে।

একজন গৃহিণী ব্যবসা করতেই পারেন। এটা বৈধ। মাছের খামার তো অবৈধ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে খামার করতে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা তিনি সংগ্রহ করলেন কোথা থেকে? একজন প্রদীপ সব পুলিশ সদস্যের ‘ইনটিগ্রিটি ও সততা’কে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। র‌্যাবের ওপর সবার আস্থা আছে। আমি বিশ্বাস রাখতে চাই, র‌্যাব সত্যটা বের করে আনবে। তবে একটা কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি দেখলাম, জাতীয় শ্রমিক লীগ টেকনাফ থানার ব্যানারে একটি মিছিলের ছবি। ব্যানারের বক্তব্য ‘ওসি প্রদীপ কুমারের বিকল্প নেই’। সেখানে হত্যা মামলা হয়েছে, র‌্যাব তদন্ত করছে, সেখানে এ ধরনের বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন ভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।

একজন প্রদীপ পুলিশ বাহিনীর মানমর্যাদাকে কিছুটা হলেও ক্ষতি করেছেন। তবে তার কর্মকাণ্ড দিয়ে সব পুলিশ সদস্যকে আমি বিচার করব না। তবে এই ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের দায়িত্ব নিতে হবে পুলিশকেই

Sarabangla

11.8.2020

0 comments:

Post a Comment