রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনাকালে বিশ্ব রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থি উত্থান

করোনাকালে বিশ্ব রাজনীতিতে যেসব পরিবর্তন আসছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি দক্ষিণপন্থি উত্থান ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবর্তন। এই কর্তৃত্ববাদী শাসন সেখানে গণতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে সংকুচিত করেছে ও গণতান্ত্রিক চর্চাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ায় এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি অশনিসংকেত। সনাতন গণতান্ত্রিক সমাজে যে চর্চা, অর্থাৎ মুক্তচিন্তা, অবাধ ভোটাধিকার, আইনের শাসন এ সবই অনেক দেশে ব্যাহত হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং Internationl IDEA’র সমন্বয়ে ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে The Global Monitor of Covid-19’s Impact on Democracy and Human Rights নামে একটি উদ্যোগ, যারা ১৬২টি দেশে কভিড-১৯ কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আঘাত করছে, তা মনিটর করছে। ১৪ আগস্ট (২০২০) তাদের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় এশিয়ায় যেসব দেশে Authoritarian regime বা কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেখানে মহামারীর সময় কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক।

গত ৩০ মার্চের (২০২০) হাঙ্গেরির পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয়েছে। এই আইনবলে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জরুরি প্রয়োজনে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্ত নিল। এই আইনবলে তিনি ডিক্রি জারি করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায়ও থাকতে পারবেন। তার কর্মকান্ডের জন্য তাকে পার্লামেন্টে জবাবদিহি করতে হবে না। তিনি ইচ্ছে করলে দেশের প্রচলিত যে আইন রয়েছে, সেই আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন।

প্রয়োজন হলে সংবিধান স্থগিত রাখতে পারবেন। ভিক্টর ওরবান করোনাভাইরাসের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এটা হচ্ছে একটা দৃষ্টান্ত, যেখানে ক্ষমতাসীনরা পৃথিবীর কয়েকটি দেশে এ ধরনের আইন পার্লামেন্টে পাস করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। করোনাভাইরাস তাদের সবার জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী একটি বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি করেছে। এই সংকটকে কেন্দ্র করে এ থেকে সুবিধা নেওয়া, পার্লামেন্টে বিশেষ আইন পাস করে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেওয়া প্রকারান্তরে একনায়কতন্ত্রী মানসিকতারই প্রতিফলন। একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব ইউরোপে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল এর ইতিহাস মানুষ জানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের ভস্মস্তূপ থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এখন সেই ইউরোপেই, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন তথা ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ (সাবেক চেকোস্লাভাকিয়ায় ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে) সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বীজ বপন করলেও ভিক্টর ওরবানের মতো লোক তখন তার ‘কবর’ রচনা করতে চলেছেন। ২০১৮ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। শুধুমাত্র হাঙ্গেরিতে ওরবানের ঘটনাকে আমরা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ভাবতে পারতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমরা বিশ্লেষণ করেছি। তাতে আমরা একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করেছি অর্থাৎ সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ আইন প্রণয়ন, ক্ষমতা শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে কুক্ষিগত করা, পার্লামেন্টের ক্ষমতা কমানো, বিরোধী নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা ইত্যাদি। আমরা আজারবাইজান, রাশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইসরায়েলের কিংবা তুরস্কের দৃষ্টান্ত দিতে পারব। এইসব দেশ গণতন্ত্রের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ এর কথা বলেছে। তাদের স্ব স্ব দেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সুযোগে তারা এখন নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের হাতকে শক্তিশালী করা হয়েছে। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।

করোনাকালে আমরা বেলারুশের সর্বশেষ ঘটনা উল্লেখ করতে পারব। এই দেশটি এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বেলারুশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন আলেকজান্ডার লুকাসেনকো। ১৯৯৪ সাল থেকেই তিনি ক্ষমতায়। পঞ্চমবারের মতো তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন ২০১৫ সালে এবং ষষ্ঠবারের জন্য ৯ আগস্ট (২০২০) তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বলে ঘোষণা করা হলেও, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোটডাকাতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাভিতলানা সিকানউস্কায়া, যিনি প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। গত ১৭ আগস্ট (২০২০) সেখানে স্মরণকালের বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্ষোভে ব্যাপক শ্রমিক সমাবেশ ঘটেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলছে। দীর্ঘ ২৬ বছরের শাসনামলে লুকাসেনকো এককভাবে দেশ চালাচ্ছেন। কভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে তিনি অনেক ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে আজারবাইজানের দীর্ঘদিনের শাসক ইলহাম আলিয়েভ। ক্ষমতায় আছেন ২০০৩ সাল থেকে। তার বাবা হায়দার আলিয়েভও সে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইলহাম করোনাভাইরাসের কারণে সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করেছেন। বিরোধীদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন।

দক্ষিণ কোরিয়াতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল (২০২০)। অথচ, জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-হু’র পক্ষ থেকে বারবার ‘সামাজিক দূরত্বের’ কথা বলা হয়েছিল। সিঙ্গাপুর সরকার নাগরিকদের ‘ডাটা’ সংগ্রহ করছে, যা মানুষ মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। এ কারণেই সিঙ্গাপুরে মৃত্যুর সংখ্যা কম। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুর্তাতে জুলাই মাসে (২০২০) আইন পাস করে নিজের হাতে অনেক ক্ষমতা নিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বাস্তবায়ন করছেন। থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে জরুরি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধানমন্ত্রী নতুন ডিক্রি জারি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ও-চা তার ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছেন। হাঙ্গেরির মতো পোল্যান্ডও একদলীয় পথে হাঁটছে। ক্ষমতাসীন ‘ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ সব ধরনের উপদেশ ও সাজেশন উপেক্ষা করে জুন মাসে (২০২০) প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। সেখানে আদৌ কোনো ‘লকডাউন’ কাজ করেনি। করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলকে কোনো নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না দিয়ে দলীয় প্রার্থী আন্দ্রেই দুদাকে পাস করিয়ে এনেছে দলটি। সেখানে নতুন আইন প্রণয়ন করে সরকারকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

তুর্কমেনিস্তানে করোনা শব্দটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইন করে। কম্বোডিয়ায় হুনসেন করোনার সুযোগে নিজের ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছেন। বিরোধী দল ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টির শীর্ষস্থানীয় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করে তিনি কার্যত দেশটিতে একদলীয় শাসন চালু করেছেন। হুনসেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতায়। আমরা আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতে পারব, যেসব দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছেন। ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ‘ক্রিমিনাল চার্জ’ থাকা সত্ত্বেও তিনি আইন করে বিরোধীদলীয় জমায়েত নিষিদ্ধ করেছেন, যাতে তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে না ওঠে। তিনি বিরোধী দলকে ভেঙে এখন একটি কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাশিয়ায় এই সুযোগে প্রেসিডেন্ট পুতিন নতুন নতুন সব আইন করছেন, যাতে করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুতিন চীনের মতো নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। তুরস্কের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে।

করোনাভাইরাস পুরো বিশ্ব ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছে। এতে করে আগামীতে প্রতিটি দেশেই এর একাধিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাবে। এক্ষেত্রে সরকারগুলোর আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার আশঙ্কা বেশি। গণতান্ত্রিকভাবে এরা নির্বাচিত হলেও (জনগণের ভোট, পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসি) করোনাভাইরাসের কারণে তারা আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। তাই ওয়াশিংটন পোস্টে (৩ এপ্রিল, ২০২০) জশুয়া কুলান্টঝিক (Joshua Kurtantzick) হুনসেন, ওরকান, দুতার্তের নাম উল্লেখ করে বলেছেন এরা ধীরে ধীরে নিজের দেশকে গণতন্ত্রের পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসছেন। এই ‘গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে আসা’ই হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটা। ওরবানের কর্মকান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই তাকে সমালোচনা করেছেন। অতীতেও তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন, যখন হাজার হাজার সিরীয় অভিবাসী তার দেশে প্রবেশ করে জার্মানিতে ঢুকতে চেষ্টা করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি শুধু খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের আশ্রয় দেবেন, মুসলমানদের দেবেন না। হুনসেনের কম্বোডিয়ায় বিরোধী দল বলতে কিছু নেই। দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণাসহ সব শীর্ষস্থানীয় নেতাকে তিনি জেলে পাঠিয়েছিলেন। আর দুতার্তের ‘ড্রাগ ওয়ার’ এর কথা কে না জানে? কোনো ধরনের আইনের মুখোমুখি না করে তিনি শত শত মানুষকে গুলি করে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ড্রাগ ডিলার’ হিসেবে। ওইসব নেতা গণতন্ত্র চর্চা করেন না, গণতন্ত্রকে ধারণ করেন না, এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার, তাই তারা করছেন। এখন করোনাভাইরাস তাদের জন্য একটি ‘মহা সুযোগ’ সৃষ্টি করেছে তাদের ক্ষমতাকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করতে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এ ধরনের ঘটনা কোনো ভালো খবর নয়।

Desh Rupantor

22.8.2020

0 comments:

Post a Comment