রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিশ্ব কি আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে?






আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে যারা ধারণা রাখেন, তাদের কাছে স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরিতা, যা স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল, তা বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আজ স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের (১৯৯১) ২৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বৈরিতা নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে যাচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধ-২। সিরিয়াস পাঠকরা স্নায়ুযুদ্ধ-পূর্বকালীন কিছু ঘটনা স্মরণ করতে পারেন, যা স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রভীতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান কর্তৃক স্ট্যালিনকে অপছন্দ, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক আন্তঃসম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়, পুঁজিবাদ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরূপ ধারণা, বার্লিন পরিস্থিতি, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণ ইত্যাদি। এক ধরনের সোভিয়েতভীতি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মাঝে কাজ করেছিল, যে কারণে তারা এক ধরনের ‘কনটেইনমেন্ট পলিসি’ গ্রহণ করেছিল। আজ ২৮ বছর পর বিশ্ব আসরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে আবিভর্‚ত হয়েছে চীন। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর কর্মসূচির আওতায় ৬১টি দেশকে চীনের পতাকাতলে আনা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতিÑ ইত্যাদি প্রতিটি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তথাকথিত ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ থেকে শুরু করে হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট অফিস বন্ধ করে দেওয়া, চীনা ছাত্রদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগ আনা, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার জন্য চীনা জনগণকে আহŸান জানানো, প্রতিটি ঘটনায় চীন-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় তার সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন ঘটনাবলি নতুন করে আবারও স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সিনেটর জিম রিস ও করি গার্ডনার মার্কিন সিনেটে একটি বিল উপস্থাপন করেছেন, যেখানে চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মেধাস্বত্ব চুরি করার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ওইসব কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারণা করছি, এ বিলটি সিনেটে পাস হবে এবং এতে করে আগামীতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও অবনতি হবে। এর আগে মার্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প Taipei Act স্বাক্ষর করেছিলেন। এই আইন বলে তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পূনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। চীন এই সিদ্ধান্তকে কোনো ভালো চোখে নেবে না। তাইওয়ানকে চীন বৃহত্তর চীনের অংশ বলেই মনে করে। ‘হংকং মডেলে’ চীন তাইওয়ানকে বৃহত্তর চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তবে বিষয়টি এত সহজ নয়। অনেক দেশের সঙ্গেই তাইওয়ানের কোনো ক‚টনৈতিক সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার না করলেও ওয়াশিংটন ডিসিতে তাইওয়ানের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। তাইওয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাইওয়ানের নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানে অত্যাধুনিক অস্ত্র, বিশেষ করে সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিয়ে অতীতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল। এখন নতুন করে ট্রাম্পের Taipei Act দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাবে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন গত সপ্তাহে পম্পেও ব্রিটেন সফরে গিয়েছিলেন। এখানে তিনি চীনা ..Company .. হুয়াওয়ে ৫জি (  Huawei 5 G  )নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে ব্রিটেনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী চীনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবে’ ( Bloomberg )। ম্যাসেজটি স্পষ্টÑ যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে টার্গেট করছে এবং চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে চাইছে। অতীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এভাবেই জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। এখন সেই স্নায়ুযুদ্ধের ধারণায় আবার ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র। পম্পেওর কথায় সে ধারণাই প্রতিফলিত হলো।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে টার্গেট করে একের পর এক যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ও উদ্যোগে নৌ-সামরিক মহড়া। দু-দুটো নৌ-সামরিক মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অংশ নিয়েছে। এই নৌ-সামরিক মহড়া কার্যত চীনের প্রতি এক ধরনের হুমকি। ২২ জুলাই দক্ষিণ চীন সাগরের পার্শ¦বর্তী এলাকা ফিলিপাইন্স সাগরে যুক্তরাষ্ট্র নৌ-মহড়া সম্পন্ন করেছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। একই সঙ্গে ভারতের নৌবাহিনীর সঙ্গেও নৌ-মহড়া সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে একটি চারদেশীয় সামরিক জোট গঠন করেছিল।QUAD- Quadrilateral Security Dialogue  গঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই জোট। এই জোটের উদ্যোগে ও ভারতের আগ্রহে এই জোটের পক্ষ থেকে মাল্লাক্কা প্রণালির অদূরে প্রতিবছরই একটি নৌ-মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘ Malabar ‘  নৌ-মহড়া নামে পরিচিত। যদিও গত কয়েক বছর অস্ট্রেলিয়া এই  Malabar নৌ-মহড়ায় অংশ নিচ্ছে না। তবে ২০২০ সালের ‘ Malabar ‘ মহড়ায়’ ভারত অস্ট্রেলিয়াকে আমন্ত্রণ জানাবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। চীন এসব নৌ-সামরিক মহড়াকে যে খুব সহজভাবে নেবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। 
আমরা ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘সোভিয়েত আতঙ্কে’ মার্কিন নেতারা যেসব কথা বলতেন, আজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেকটা সেই রকম কথাবার্তা বলছেন। হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি চীনের কর্মকাÐকে ‘কুকর্ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন (২৯ মে, ২০২০)। ট্রাম্প WHO- World Health Organization প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, চীন এই সংস্থায় বার্ষিক চাঁদা দেয় মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু নীতিনির্ধারণে গড় ভ‚মিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র চাঁদা দেয় বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভ‚মিকা নেই। তার উগ্রবাদী নীতি শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে জনপ্রিয় করলেও কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের কাছে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। জনপ্রিয়তা বাড়াতে ‘চীনা কার্ড’ এখন ব্যবহার করছেন। তার উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, চীনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করল। একটি ‘এশিয়ান ন্যাটো’ গঠনের কথাও কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে। মোদ্দা কথা, ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে একসময় স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এখন ভারত মহাসাগরে জন্ম হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধ-২ এর। খুব সঙ্গতকারণেই এশিয়ার দেশগুলো এই ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের খেলায়’ আক্রান্ত হবে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। এখন দেখার পালা চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতায় এশিয়ার দেশগুলো কোন পক্ষ অবলম্বন করে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনি সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, ভারত মহাসাগর তথা গালফ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সব সেনাসদস্যকে প্রত্যাহার করে নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চিন্তার কারণ হচ্ছে চীন-ইরান অ্যালায়েন্স। গত জুলাইয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট ইরান সফর করেন। ওই সফরে চীন ইরানের সঙ্গে ‘ Comprehensive Strategic Partnership চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে চীন ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দরগুলোয় এবং একই সালে ইরানের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় একটি বড় সুবিধা পাবে। চীনের বহুল আলোচিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে ইরানের অংশগ্রহণ এখন নিশ্চিত হলো (দ্য ডিপ্লোম্যাট, ১৫ জুলাই ২০২০)। ক্রমবর্ধমান মার্কিনি চাপের মুখে এই চুক্তি ইরানকে এক ধরনের নিরাপত্তা দেবে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের ওপর চীনের নির্ভরতা চীন এখন কাটিয়ে উঠতে পারবে। পরিসংখ্যান বলছে, ইরান তার উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ২২ শতাংশ চীনের কাছে বিক্রি করে। যদিও এ ব্যাপারে মার্কিনি নিষেধাজ্ঞা আছে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই চীন ইরান থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এটা একটা চিন্তার কারণ। আগামী দিনগুলো স্ট্রেইট অব হরমুজ (Strait of Hormuz  ) প্রণালিতে উত্তেজনা বাড়তে পারে। তেলবাহী ট্যাংকারগুলো আক্রমণের শিকার হতে পারে। প্রতিদিন এই প্রণালি দিয়ে ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ও ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট তরল গ্যাস (এলএনজি) পরিবহন করা হয়। তাই একদিকে চীন, অন্যদিকে ইরানকে চাপে রাখার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন তখাকথিত ‘এশিয়ান ন্যাটোর’ ধারণা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। সুতরাং ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হচ্ছে। স্পষ্টতই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধেরÑ একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে চীন। এই দুটি পরাশক্তির মধ্যকার দ্ব›দ্ব এ অঞ্চলের রাজনীতিকে যে উত্তপ্ত করবে, তা বলাই বাহুল্য
Amader Somoy
8.8.2020

0 comments:

Post a Comment