রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এ দুঃখ আমরা রাখব কোথায়


তারেক শামসুর রেহমান   


এ দুঃখ আমরা রাখব কোথায়? একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইতালি থেকে ফেরত এসেছেন অনেক বাংলাদেশি, যাঁরা প্রায় সবাই ইতালির নাগরিক। ইতালির নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও রোমের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁদের সে দেশে ঢুকতে দেয়নি। কারণ তাঁরা ছিলেন করোনাভাইরাস বহনকারী। কিন্তু তাঁদের সবার কাছে তো করোনাভাইরাসের নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছিল। অর্থাৎ তাঁরা কাগজে-কলমে করোনামুক্ত ছিলেন। প্রকৃত অর্থে তাঁদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। রোম বিমানবন্দরে পরীক্ষা হলো। জানা গেল তাঁরা সবাই ভুয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটধারী। তাঁদের কাছে আসল সার্টিফিকেট ছিল না। তাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন ভুয়া সার্টিফিকেট। ফলে সবাইকে ফেরত আসতে হলো। কিন্তু তাঁরা দেশের কী ক্ষতি করলেন, তা কি তাঁরা বুঝছেন? যাঁরা বিমানবন্দর থেকে তাঁদের যাত্রার অনুমতি দিলেন, তাঁদের কি আমরা আইনের আশ্রয়ে নিতে পেরেছি? এটা কি শুধুই শৈথিল্য? নাকি এটাও ‘ম্যানেজ’ করা কোনো বিষয়? যাঁরা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করেন, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাঁদের কারোরই চাকরি থাকা উচিত নয়।


করোনাভাইরাস নিয়ে সারা জাতি যখন উৎকণ্ঠিত, তখন এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সাহেদ আর সাবরিনা-আরিফ ‘কাহিনি’ সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে না। এঁরা সবাই ভুঁয়া করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট ইস্যু করে কোটি কোটি টাকা কামাই করেছেন। করোনা নিয়েও বাণিজ্য হলো শেষ পর্যন্ত? মানুষ কত নিচে নামলে এ ধরনের কাজ করতে পারে? সাহেদের ছিল দুটি হাসপাতাল, যা ‘করোনা ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব সেখানে অভিযান চালায়। তখনই জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতালে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই শুধু টাকার বিনিময়ে ‘করোনা নেগেটিভ’ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু করে বাণিজ্য! করোনার সময়ে জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের খবরও ছাপা হয়েছে—তারা ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছিল। রিজেন্ট কিংবা জেকেজির রিপোর্ট নিয়েই কেউ কেউ হয়তো ইতালি গিয়েছিলেন। ধরা পড়ে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। এই সব ভুয়া করোনা রিপোর্টের কারণেই আকাশপথ বন্ধের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ—কালের কণ্ঠ জানাচ্ছে আমাদের সে কথাও। ইতালি বাংলাদেশিদের নিষিদ্ধ করেছে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত।


বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় থাকে যখন সিআইডি আমাদের জানায় আজম খানের কুকর্মের কথা—সহস্রাধিক বাংলাদেশি নারীকে দুবাইয়ে পাচার করেছেন ওই খান। সেখানে তাঁর রয়েছে বেশ কয়েকটি হোটেল। অল্প বয়সী নারীদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে তিনি সেখানে নিয়ে যেতেন এবং তাঁদের যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন। তিনি দালালদের মাধ্যমে এসব নারী সংগ্রহ করতেন। বাংলাদেশের মানসম্মান কোথায় রাখলেন এই আজম খান? পাপুল কাহিনি তো আরো দুঃখজনক। তিনি একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য, অথচ থাকেন কুয়েতে, ব্যবসা করেন কুয়েতে। তিনি কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের আসনে জোটের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। টাকার বিনিময়ে ওই আসনটি এক অর্থে কিনে নেন পাপুল। এখন অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে তিনি কুয়েতের জেলে। একজন এমপি যদি অর্থপাচার আর মানবপাচারের অভিযোগে বিদেশের জেলে থাকেন, তাহলে দেশের সম্মানটা থাকল কোথায়? যেদিন তিনি জেলে গেছেন, সেদিনই তো তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মর্যাদা তিনি নষ্ট করেছেন। পাপুল, সাহেদ, সাবরিনা-আরিফ ‘কাহিনি’ যখন সবার মুখে মুখে, তখন আরো কয়েকটি ছোট ছোট সংবাদ, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন কিছু বাংলাদেশি। তাঁরা বাংলাদেশ দূতাবাস দখলের হুমকি দিয়েছিলেন—এই অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপে পাওয়া গেল অবৈধ ৩৬২ জন বাংলাদেশিকে। এই অভিযোগ জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশিদের জমা দেওয়া টাকার পরিমাণ ১৯৯৬ সালের তুলনায় বেড়েছে ১৬ গুণেরও বেশি।


এসব সংবাদ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। সাহেদ, সাবরিনা কিংবা পাপুলরা আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। অথচ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবদান বিশ্বের সর্বত্র প্রশংসিত। একজন সাহেদ কিংবা একজন পাপুল আমাদের এই অর্জন নষ্ট করেছেন। ভুয়া সনদ দিয়ে এঁরা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছেন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দুয়ার এখন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এঁদের সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক।

Kalerkontho

17.7.2020


0 comments:

Post a Comment