একজন মনোয়ার হোসেন আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর আত্মহত্যার খবর ছাপা হয়েছে ১৩
জুলাইয়ের সংবাদপত্রে। এ ধরনের আত্মহত্যার খবর তো সংবাদপত্রে ছাপা হয়ই।
মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কেননা তিনি জনপ্রশাসনে
কর্মরত ছিলেন। দুই বছর ধরে তিনি ওএসডি অবস্থায় ছিলেন। অর্থাৎ জনপ্রশাসনে
তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। দু-দুবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে শেষ পর্যন্ত
তিনি আত্মহত্যার পথই বেছে নিলেন। '৮৩ ব্যাচের জনপ্রশাসনের এই কর্মকর্তার
বন্ধুরা অনেকেই সচিব হয়েছেন। আর তিনি যুগ্ম সচিব হিসেবে 'বসে' ছিলেন দীর্ঘ
দুই বছর। চাকরিতে তাঁর বয়স সবার মতো দুই বছর বাড়লেও, পদোন্নতি তিনি পাননি।
আত্মহত্যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়; অভিযোগ উঠেছে যে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকে
পদোন্নতি পেয়েছেন। ঢালাওভাবে জনপ্রশাসনে এই পদোন্নতিতে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি
পদোন্নতি পাচ্ছেন এবং যোগ্যদের বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের
উচ্চপর্যায়ের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অভাবের ফলে (যুগান্তর, ২৩
সেপ্টেম্বর, ২০১১) জনপ্রশাসনে কাজের গতি আসছে না এবং 'চেইন অব কমান্ড' ভেঙে
পড়ছে। ঢালাও পদোন্নতির ফলে জনপ্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা (আমার দেশ,
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন কেন্দ্রীয় স্তরে বর্তমান
সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭,
যুগ্ম সচিব পদে ২৬৪ এবং উপসচিব পদে ২৫৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান
করা হয়েছে। মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে
পদোন্নতি দিতে গিয়ে বিদ্যমান বিধিবিধানের অপব্যবহার করে এক অশুভ নীলনকশা
বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (নয়া দিগন্ত, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২)।
দুঃখজনক হচ্ছে, এটা করতে গিয়ে ৭০০-এর অধিক জ্যেষ্ঠ ও পদোন্নতির সব শর্ত
পূরণকারী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই ৮ ফেব্রুয়ারিকে অনেকে 'কালো
দিবস' হিসেবে অভিহিত করেছেন (ঐ)। যে অভিযোগটি গুরুতর তা হচ্ছে, পিএসসি
কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে
বঞ্চিত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁরা একটি বিশেষ
রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী (ঐ)। পদোন্নতির জন্য আবশ্যক সিনিয়র স্টাফ কোর্স
এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ও উন্নয়নবিষয়ক কোর্স সম্পন্ন না করেই পদোন্নতি
পেয়েছেন কয়েকজন। মজার ব্যাপার- শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষার
ওপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব হিসেবে
পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকে এই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি 'ক্রয়' করে তাঁদের পদোন্নতি নিশ্চিত
করেছেন। কেউ কেউ অনলাইনে একখানা পিএইচডি ডিগ্রি জোগাড় করে তা ব্যবহারও
করছেন। উচ্চতর ডিগ্রি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু একটি ভুয়া ডিগ্রি যখন জনপ্রশাসনের কেউ ব্যবহার করেন, তখন আস্থার
জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যাঁরা জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরা আশা করছি
বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
জনপ্রশাসনে এভাবে ঢালাও পদোন্নতি, যাকে কি না 'সুনামি' হিসেবে আখ্যায়িত করা
হয়েছে, তা আমাদের দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যোগ্য ও
মেধাবী কর্মকর্তাদের কোনো কারণ ছাড়াই বাদ দেওয়া, পদের চেয়ে দ্বিগুণ
কর্মকর্তা (আমার দেশ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২) কিংবা যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি
করা জনপ্রশাসনের জন্য কোনো সুস্থ লক্ষণ নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন
থেকে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি ('১২) পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৮৩৫
জন, আর তিন বছর ধরে আছেন ১২৩ জন (আমার দেশ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। দুঃখজনক
হলেও সত্য, গেল আড়াই বছরে ওএসডি অবস্থায় পিআরএল-এ গেছেন ২২৭ জন কর্মকর্তা।
কর্মহীন অবস্থায় পিআরএল-এ যাওয়ায় সহকর্মীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায়
নেওয়ারও সুযোগ তাঁরা পাননি। সারা জীবন যিনি জাতির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য
শ্রম দিলেন, মেধা দিলেন, তাঁকে বাধ্য করা হলো পিআরএল-এ যেতে- ওএসডি থাকা
অবস্থায়ই। সুষ্ঠু জনপ্রশাসনের জন্য এ ধরনের প্রবণতা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে
না। ইতিমধ্যে সচিবদের মধ্যে আটটি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে এক তুঘলকি
কাণ্ড ঘটানো হয়েছে জনপ্রশাসনে। এমনকি পুলিশের মহাপরিদর্শককে সিনিয়র সচিব পদ
দিয়ে পুলিশ বিভাগে একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই 'সিনিয়র সচিব' পদ
সৃষ্টি কিংবা পুলিশ বিভাগের জন্য একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা
ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আদৌ করা হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করা,
একই সঙ্গে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দিয়ে সুবিধা আদায় করার নিমিত্তেই করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জনপ্রশাসনে ওই যে পদোন্নতি, তার কোনো
সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বিধিমালা দিয়েই চলছে গত ৪১ বছর (ডেসটিনি, ১৭
এপ্রিল ২০১২)। শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির স্বার্থেই কোনো আইন
করা হয়নি। এখানে অভিযোগ উঠেছে যে আইন প্রণয়ন না হওয়ায় শুধু ১৩৩ অনুচ্ছেদ
নয়, সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদের নির্দেশনাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে
না। ইতিমধ্যে একটি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে
এবং এর একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। এই আইনটি বাস্তবায়ন হলে কর্মকর্তাদের
নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত
করা যেত। এতে করে প্রশাসনের ওপর দলীয়করণের খৰ অনেকাংশে কমত। বাধ্যতামূলক
অবসর দেওয়ার কালাকানুন থাকত না। মেধাবী কর্মকর্তারা নির্ভয়ে কাজ করতে
পারতেন। প্রস্তাবিত এই অ্যাক্টে ২৮টি আলাদা ক্যাডার সার্ভিস প্রথা তুলে
দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি পদে পদোন্নতি
পেতে হলে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই কেবল পদোন্নতির
যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়।
প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই প্রস্তাবিত আইনটি পাস
হচ্ছে না।
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হলো জনপ্রশাসন। এ জন্যই জনপ্রশাসনে যোগ্য লোকের দরকার। অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তারা যদি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান, তাঁরা দরকষাকষিতে কোনো যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন না। ফলে বিদেশে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে তাঁরা ব্যর্থ হবেন। এ জন্য দরকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। আন্ত-ক্যাডার কলহ, বদলি আতঙ্ক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি দূর করা না যায়, তাহলে সেই প্রশাসন দিয়ে জাতির কোনো মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায় না। একজন মনোয়ার হোসেন আত্মহত্যা করলেন। তিনি কি কোনো প্রতিবাদ করে গেলেন? যাঁরা আজ জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরা কি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন? হতাশা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা তার বড় প্রমাণ। আত্মহত্যা পাপ। এটি কাম্য নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। তবুও এই আত্মহত্যা একটি 'মেসেজ' দিয়ে গেল- কোনো কর্মকর্তা তাঁর অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হন। যোগ্য ও মেধাবীরাই যেন পদোন্নতি পান। আর কোনো রাজনৈতিক বিবেচনাই যেন জনপ্রশাসন পরিচালনায় মুখ্য হয়ে দেখা না দেয়। এ দেশে রাজনীতি থাকবে। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করবেন। একটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনকে রাজনীতির ঊধর্ে্ব রাখা উচিত। এখানে মনোয়ার হোসেনের মতো কর্মকর্তারা যেন পদবঞ্চিত না হন। পদোন্নতি তাঁদের অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়।Daily KALER KONTHO01.08.12
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হলো জনপ্রশাসন। এ জন্যই জনপ্রশাসনে যোগ্য লোকের দরকার। অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তারা যদি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান, তাঁরা দরকষাকষিতে কোনো যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন না। ফলে বিদেশে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে তাঁরা ব্যর্থ হবেন। এ জন্য দরকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। আন্ত-ক্যাডার কলহ, বদলি আতঙ্ক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি দূর করা না যায়, তাহলে সেই প্রশাসন দিয়ে জাতির কোনো মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায় না। একজন মনোয়ার হোসেন আত্মহত্যা করলেন। তিনি কি কোনো প্রতিবাদ করে গেলেন? যাঁরা আজ জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরা কি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন? হতাশা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, মনোয়ার হোসেনের আত্মহত্যা তার বড় প্রমাণ। আত্মহত্যা পাপ। এটি কাম্য নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। তবুও এই আত্মহত্যা একটি 'মেসেজ' দিয়ে গেল- কোনো কর্মকর্তা তাঁর অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হন। যোগ্য ও মেধাবীরাই যেন পদোন্নতি পান। আর কোনো রাজনৈতিক বিবেচনাই যেন জনপ্রশাসন পরিচালনায় মুখ্য হয়ে দেখা না দেয়। এ দেশে রাজনীতি থাকবে। রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করবেন। একটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনকে রাজনীতির ঊধর্ে্ব রাখা উচিত। এখানে মনোয়ার হোসেনের মতো কর্মকর্তারা যেন পদবঞ্চিত না হন। পদোন্নতি তাঁদের অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়।Daily KALER KONTHO01.08.12