রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা নিয়ে কিছু প্রশ্ন



গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের সময়সীমা ৬৫ বছর করতে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ) (বিশেষ বিধান) বিল ২০১২’ উত্থাপন করা হয়েছে। ধারণা করছি সংসদের আগামী যেকোনো অধিবেশনে এই আইনটি পাস হবে। আগে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই সুবিধাটুকু গ্রহণ করতেন। এখন এই আইনটি সংসদে পাস হলে দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই ৬৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এটা নিয়ে ক্ষোভ ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। এখন সরকার এই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিল। এতে সরকারপ্রধান সকল শিক্ষকের ধন্যবাদ পাবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হল, সেই উদ্দেশ্য সফল হবে কি?

অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে কি তাদের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা তা পূরণ হবে? আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অবসরের বয়সসীমা ৬৫-তে উন্নীত করার সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। কেননা এতে সরকারের ওপর অতিরিক্ত একটি ‘চাপ’ আসবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার এই ‘চাপ’ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় ৬০ বছরের পর একজন সিনিয়র শিক্ষকের দেওয়ার কিছুই থাকে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, খুব কম শিক্ষকই ৬০ বছরের পর গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন না, অথবা রাখতে পারেন না। অসুস্থতা তাকে পেয়ে বসে। এই বয়সে এসে অনেকেই প্রবাসে অবস্থানরত ছেলে বা মেয়ে এবং সেই সঙ্গে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পড়াশোনা, গবেষণা, ক্লাস নেওয়া ইত্যাদির পেছনে ‘সময় দেওয়ার’ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কম। এর একটি বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে।

আমাদের যে সংস্কৃতি, তাতে পরিণত বয়সে এসে মানুষ সন্তানদের কাছে আবার ফিরে যায়। এটাই বাস্তব। গবেষণা তাকে টানে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা আমি বলছি না। ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু আমরা অনেক জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিকে এই ৬৫ বছরের সুযোগ দিইনি। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এই সমাজে এখনও আছেন, যারা ৬০ বছর বয়সের আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন, কিন্তু এখনও সক্রিয়। বই লিখছেন। সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এই প্রজন্মের তরুণরা তাদেরকে ক্যাম্পাসে পেলে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উত্সাহিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। আমি আরও একটি কারণে অবসরের বয়স ৬৫-তে উন্নীত করার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছি, তা হচ্ছে ৬৫ বছর নির্ধারণ করে দেওয়ায় অনেকেই (যারা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত) সরাসরি ৪০ বছর শিক্ষকতা করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? গবেষণা, পাঠদানের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য যেখানে বেশি, সেখানে তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন, পাঠ্যবই রচনা করবেন-এটা আশা করা যায় না। অনেক তরুণ প্রভাষকের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ শুনি, তাতে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত্ নিয়ে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫-তে উন্নীত করায় সমাজ-রাষ্ট্র উপকৃত হবে এ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। এর ফলে ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শত শত অফিসার ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও দাবি উঠেছে তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর। রাজনৈতিক সরকারের ওপর সঙ্গত কারণেই ‘চাপ’ আসবে। এবং কোনো সরকারই চাইবে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হোক। একসময় সরকারও বাধ্য হবে অফিসার ও কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়াতে। ফলে যা হবে তা হচ্ছে ‘ওপরের স্তরে’ জট সৃষ্টি হবে এবং নতুনদের চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরদের দুটো গ্রেড-প্রফেসর ও সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর। অনেক শিক্ষক দীর্ঘদিন প্রফেসর হিসেবে নিজ পদে থাকলেও ১০ ভাগ কোটার কারণে কোনো দিনই ‘সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর’ হতে পারেন না। ফলে যা হবে, তা হচ্ছে সিনিয়র সচিবদের মতো ‘সিনিয়র প্রফেসরের’ পদ সৃষ্টি করতে বাধ্য হবে সরকার। কেননা রাজনৈতিক সরকার সব সময়ই চায় শিক্ষকদের সমর্থন। শিক্ষকদের খুশি করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ‘সিনিয়র প্রফেসরের’ পদ আগামীতে সৃষ্টি করা হয়, আমি অবাক হব না। তবে এ ক্ষেত্রে যেন একটি নীতিমালা থাকে।

সরকার সিনিয়র সচিবের আটটি পদ সৃষ্টি করেছে। এতে সচিবদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে? বয়সে সিনিয়র-এটাই কি নীতিমালা? আসলে নীতিমালাটি হওয়া উচিত যোগ্যতার বলে। একজন সচিব বয়সের কারণে সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা পাবেন, সেটি ঠিক নয়। তিনি যোগ্যতা দেখাতে পেরেছেন কি না, সেটাই হল আসল কথা। সচিব সাহেবদের কাজ যদি হয় ‘বিদেশ ভ্রমণ’ আর ‘দাতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী’ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করা, সেই সচিব ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হবেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী মেধাশূন্য সচিবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর (২০১১) এ ধরনের একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। সচিবদের ‘পারফরম্যান্সে’ প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট এমন খবরও আছে ওই প্রতিবেদনে। তবুও প্রধানমন্ত্রীকে সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছে। আইজিকে ‘থ্রি-স্টার জেনারেলের’ পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিবের পদও সৃষ্টি করা হয়েছে। তাতে রাষ্ট্র, সমাজ কতটুকু উপকৃত হল? এখন সঙ্গত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি করবেন ‘সিনিয়র প্রফেসর’-এর পদ সৃষ্টি করার। তাদের কি ফেলে দিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী?

এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ হোক আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে যেন কিছু ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ থাকে। ঢালাওভাবে একজন অসুস্থ, কর্মে অক্ষম, মেধাহীন, অযোগ্য শিক্ষক ৬৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতা করবেন এটি কাম্য নয়। সমাজ তার কাছ থেকে কিছু পাবে না। শিক্ষকতায় দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘দলীয় ক্যাডার’ নিয়োগ দিয়ে আমরা এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি। আর নয়। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের অবসর সংক্রান্ত আইনটি খসড়া আকারে রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই তা সংসদে উপস্থাপিত হবে। সংসদীয় কমিটির দায়িত্ব এখন অনেক বেশি। এখানে সংসদীয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, যা প্রশংসিত হয়েছে। রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে এই কমিটি আমাদের জন্য একটা আস্থার জায়গা। তারা তা প্রমাণও করেছেন। শিক্ষকদের স্বার্থে আঘাত করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এই কমিটি অতীতেও নেয়নি, আগামীতেও নেবে না।

তবে সংসদীয় কমিটির শিক্ষকদের অবসরের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারে : (১) অবসরের বয়সসীমা ৬৫ করা হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি শারীরিকভাবে ‘ফিট’। অর্থাত্ সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে (এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা এড়িয়ে চলতে হবে)। (২) ২ + ২ + ১ এর যে ফর্মুলা ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, তা অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাত্ সরাসরি ৬৫ পর্যন্ত আইন না করে ধাপে ধাপে তা কার্যকর করলে ভালো হয়। (৩) এই সুযোগ তিনি পাবেন, যিনি নিয়মিত এমফিল এবং পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন। (৪) শর্ত হিসেবে তাকে ৬০ বছরের পর প্রতিবছর একটি পাঠ্যবই রচনা করতে হবে। যদি তিনি তা না পারেন, তাহলে তিনি ৬৫ বছরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না। (৫) ৬৫-তে যাওয়ার যোগ্যতা তিনিই অর্জন করতে পারবেন, অথবা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, যিনি অধ্যাপক পদে থাকাকালীন ন্যূনতম একবার ‘সেবাটিক্যাল লিভ’ নিয়ে (এক বছর) একটি গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন।

যার কোনো গবেষণা গ্রন্থ নেই, তিনি ৬৫-তে যাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। অধ্যাপক থাকাকালীন তিনি যদি আদৌ কোনো এমফিল বা পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান না-করে থাকেন, তিনিও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। মোট কথা, একটা নীতিমালা থাকুক, কিছু শর্ত থাকুক। যদি ঢালাওভাবে ৬৫ করা হয়, তা হলে তাতে ‘রাজনীতি’ ঢুকে যাবে। জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েও তেমন উপকৃত হবে না। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ন্যূনতম পাওয়া’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না। আমি প্রশ্ন তুলছি নৈতিকতার। আমি যদি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তা হলে কী অধিকার আছে আমার শিক্ষকতার পদকে দীর্ঘায়িত করার? আমি বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাই। শুধু অবসরের বয়স পাঁচ বছর বাড়িয়ে রাষ্ট্রের কি ক্ষতিসাধন আমরা করছি না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক তরুণ প্রভাষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে স্বয়ং তার শিক্ষকরাই প্রশ্ন তুলেছেন।

যিনি তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তিনি এখন ৬৫ বছরের অবসরের সুবিধা ভোগ করবেন। একটি ‘বিতর্কিত’ থিসিস তত্ত্বাবধায়ন করে তিনি আদৌ বিভাগের কোনো সুনাম আনতে পারেননি। তিনি যদি ৬৫ বছর পর্যন্ত থাকেন, তিনি কী সুনাম আনবেন আর? আরেক ভদ্রলোক ‘ঘুষ’ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। ভিসির নির্দেশে মামলা হয়েছে। এখন যে ভদ্রলোক টাকা দিয়ে ‘শিক্ষক’ হতে চান, তিনি যদি ঘটনাক্রমে শিক্ষক হয়ে যান অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি জাতিকে কী দেবেন? তাদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় হতাশাগ্রস্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অভিযোগ করেছেন টাকার বিনিময়ে সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নয়া উপাচার্য বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখেননি বটে, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি ‘কালো দাগ’ তো রয়েই গেল। তাই শিক্ষকদের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে আমি খুশি হতে পারছি না। অনেক শিক্ষকই খুশি হবেন। আমি খুশি হব যদি এতে এখন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের সময়সীমা ৬৫ বছর করতে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (অবসর গ্রহণ) (বিশেষ বিধান) বিল ২০১২’ উত্থাপন করা হয়েছে। ধারণা করছি সংসদের আগামী যেকোনো অধিবেশনে এই আইনটি পাস হবে। আগে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই সুবিধাটুকু গ্রহণ করতেন। এখন এই আইনটি সংসদে পাস হলে দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই ৬৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এটা নিয়ে ক্ষোভ ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। এখন সরকার এই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিল। এতে সরকারপ্রধান সকল শিক্ষকের ধন্যবাদ পাবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হল, সেই উদ্দেশ্য সফল হবে কি?

অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে কি তাদের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা তা পূরণ হবে? আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অবসরের বয়সসীমা ৬৫-তে উন্নীত করার সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। কেননা এতে সরকারের ওপর অতিরিক্ত একটি ‘চাপ’ আসবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার এই ‘চাপ’ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। দ্বিতীয়ত, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় ৬০ বছরের পর একজন সিনিয়র শিক্ষকের দেওয়ার কিছুই থাকে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, খুব কম শিক্ষকই ৬০ বছরের পর গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন না, অথবা রাখতে পারেন না। অসুস্থতা তাকে পেয়ে বসে। এই বয়সে এসে অনেকেই প্রবাসে অবস্থানরত ছেলে বা মেয়ে এবং সেই সঙ্গে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পড়াশোনা, গবেষণা, ক্লাস নেওয়া ইত্যাদির পেছনে ‘সময় দেওয়ার’ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কম। এর একটি বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে।

আমাদের যে সংস্কৃতি, তাতে পরিণত বয়সে এসে মানুষ সন্তানদের কাছে আবার ফিরে যায়। এটাই বাস্তব। গবেষণা তাকে টানে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা আমি বলছি না। ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু আমরা অনেক জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিকে এই ৬৫ বছরের সুযোগ দিইনি। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এই সমাজে এখনও আছেন, যারা ৬০ বছর বয়সের আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন, কিন্তু এখনও সক্রিয়। বই লিখছেন। সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এই প্রজন্মের তরুণরা তাদেরকে ক্যাম্পাসে পেলে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উত্সাহিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। আমি আরও একটি কারণে অবসরের বয়স ৬৫-তে উন্নীত করার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছি, তা হচ্ছে ৬৫ বছর নির্ধারণ করে দেওয়ায় অনেকেই (যারা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত) সরাসরি ৪০ বছর শিক্ষকতা করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? গবেষণা, পাঠদানের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য যেখানে বেশি, সেখানে তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করবেন, পাঠ্যবই রচনা করবেন-এটা আশা করা যায় না। অনেক তরুণ প্রভাষকের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ শুনি, তাতে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত্ নিয়ে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫-তে উন্নীত করায় সমাজ-রাষ্ট্র উপকৃত হবে এ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। এর ফলে ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শত শত অফিসার ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও দাবি উঠেছে তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর। রাজনৈতিক সরকারের ওপর সঙ্গত কারণেই ‘চাপ’ আসবে। এবং কোনো সরকারই চাইবে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হোক। একসময় সরকারও বাধ্য হবে অফিসার ও কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়াতে। ফলে যা হবে তা হচ্ছে ‘ওপরের স্তরে’ জট সৃষ্টি হবে এবং নতুনদের চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরদের দুটো গ্রেড-প্রফেসর ও সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর। অনেক শিক্ষক দীর্ঘদিন প্রফেসর হিসেবে নিজ পদে থাকলেও ১০ ভাগ কোটার কারণে কোনো দিনই ‘সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর’ হতে পারেন না। ফলে যা হবে, তা হচ্ছে সিনিয়র সচিবদের মতো ‘সিনিয়র প্রফেসরের’ পদ সৃষ্টি করতে বাধ্য হবে সরকার। কেননা রাজনৈতিক সরকার সব সময়ই চায় শিক্ষকদের সমর্থন। শিক্ষকদের খুশি করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ‘সিনিয়র প্রফেসরের’ পদ আগামীতে সৃষ্টি করা হয়, আমি অবাক হব না। তবে এ ক্ষেত্রে যেন একটি নীতিমালা থাকে।

সরকার সিনিয়র সচিবের আটটি পদ সৃষ্টি করেছে। এতে সচিবদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে? বয়সে সিনিয়র-এটাই কি নীতিমালা? আসলে নীতিমালাটি হওয়া উচিত যোগ্যতার বলে। একজন সচিব বয়সের কারণে সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা পাবেন, সেটি ঠিক নয়। তিনি যোগ্যতা দেখাতে পেরেছেন কি না, সেটাই হল আসল কথা। সচিব সাহেবদের কাজ যদি হয় ‘বিদেশ ভ্রমণ’ আর ‘দাতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী’ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করা, সেই সচিব ‘যোগ্য’ বলে বিবেচিত হবেন না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী মেধাশূন্য সচিবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর (২০১১) এ ধরনের একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। সচিবদের ‘পারফরম্যান্সে’ প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট এমন খবরও আছে ওই প্রতিবেদনে। তবুও প্রধানমন্ত্রীকে সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছে। আইজিকে ‘থ্রি-স্টার জেনারেলের’ পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য পাঁচজন সিনিয়র সচিবের পদও সৃষ্টি করা হয়েছে। তাতে রাষ্ট্র, সমাজ কতটুকু উপকৃত হল? এখন সঙ্গত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি করবেন ‘সিনিয়র প্রফেসর’-এর পদ সৃষ্টি করার। তাদের কি ফেলে দিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী?

এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ হোক আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে যেন কিছু ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ থাকে। ঢালাওভাবে একজন অসুস্থ, কর্মে অক্ষম, মেধাহীন, অযোগ্য শিক্ষক ৬৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষকতা করবেন এটি কাম্য নয়। সমাজ তার কাছ থেকে কিছু পাবে না। শিক্ষকতায় দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘দলীয় ক্যাডার’ নিয়োগ দিয়ে আমরা এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি। আর নয়। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের অবসর সংক্রান্ত আইনটি খসড়া আকারে রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই তা সংসদে উপস্থাপিত হবে। সংসদীয় কমিটির দায়িত্ব এখন অনেক বেশি। এখানে সংসদীয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, যা প্রশংসিত হয়েছে। রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে এই কমিটি আমাদের জন্য একটা আস্থার জায়গা। তারা তা প্রমাণও করেছেন। শিক্ষকদের স্বার্থে আঘাত করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এই কমিটি অতীতেও নেয়নি, আগামীতেও নেবে না।

তবে সংসদীয় কমিটির শিক্ষকদের অবসরের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারে : (১) অবসরের বয়সসীমা ৬৫ করা হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি শারীরিকভাবে ‘ফিট’। অর্থাত্ সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে (এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা এড়িয়ে চলতে হবে)। (২) ২ + ২ + ১ এর যে ফর্মুলা ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, তা অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাত্ সরাসরি ৬৫ পর্যন্ত আইন না করে ধাপে ধাপে তা কার্যকর করলে ভালো হয়। (৩) এই সুযোগ তিনি পাবেন, যিনি নিয়মিত এমফিল এবং পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন। (৪) শর্ত হিসেবে তাকে ৬০ বছরের পর প্রতিবছর একটি পাঠ্যবই রচনা করতে হবে। যদি তিনি তা না পারেন, তাহলে তিনি ৬৫ বছরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না। (৫) ৬৫-তে যাওয়ার যোগ্যতা তিনিই অর্জন করতে পারবেন, অথবা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, যিনি অধ্যাপক পদে থাকাকালীন ন্যূনতম একবার ‘সেবাটিক্যাল লিভ’ নিয়ে (এক বছর) একটি গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন।

যার কোনো গবেষণা গ্রন্থ নেই, তিনি ৬৫-তে যাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। অধ্যাপক থাকাকালীন তিনি যদি আদৌ কোনো এমফিল বা পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান না-করে থাকেন, তিনিও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। মোট কথা, একটা নীতিমালা থাকুক, কিছু শর্ত থাকুক। যদি ঢালাওভাবে ৬৫ করা হয়, তা হলে তাতে ‘রাজনীতি’ ঢুকে যাবে। জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েও তেমন উপকৃত হবে না। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘ন্যূনতম পাওয়া’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না। আমি প্রশ্ন তুলছি নৈতিকতার। আমি যদি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তা হলে কী অধিকার আছে আমার শিক্ষকতার পদকে দীর্ঘায়িত করার? আমি বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাই। শুধু অবসরের বয়স পাঁচ বছর বাড়িয়ে রাষ্ট্রের কি ক্ষতিসাধন আমরা করছি না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক তরুণ প্রভাষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে স্বয়ং তার শিক্ষকরাই প্রশ্ন তুলেছেন।

যিনি তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তিনি এখন ৬৫ বছরের অবসরের সুবিধা ভোগ করবেন। একটি ‘বিতর্কিত’ থিসিস তত্ত্বাবধায়ন করে তিনি আদৌ বিভাগের কোনো সুনাম আনতে পারেননি। তিনি যদি ৬৫ বছর পর্যন্ত থাকেন, তিনি কী সুনাম আনবেন আর? আরেক ভদ্রলোক ‘ঘুষ’ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। ভিসির নির্দেশে মামলা হয়েছে। এখন যে ভদ্রলোক টাকা দিয়ে ‘শিক্ষক’ হতে চান, তিনি যদি ঘটনাক্রমে শিক্ষক হয়ে যান অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনি জাতিকে কী দেবেন? তাদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় হতাশাগ্রস্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অভিযোগ করেছেন টাকার বিনিময়ে সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নয়া উপাচার্য বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখেননি বটে, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি ‘কালো দাগ’ তো রয়েই গেল। তাই শিক্ষকদের বয়সসীমা বৃদ্ধিতে আমি খুশি হতে পারছি না। অনেক শিক্ষকই খুশি হবেন। আমি খুশি হব যদি এতে এখন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।  Daily SAKALER KHOBOR, 2.7.12

0 comments:

Post a Comment