রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিটিভি কি হুমায়ূন আহমেদকে বয়কট করেছে?

গত ২০ জুলাই বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পাঠক যখন জেনে গেছেন জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই, তখন থেকে আমার মাঝে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল যে, বিটিভি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদকে সম্মান জানায়। খুব আগ্রহ নিয়ে আমি প্রতিদিন বিটিভি খুলি, যদি হুমায়ূনকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান হয়! যদি হুমায়ূন ভাইয়ের কোনো ছবির অংশবিশেষ দেখানো হয়! শুক্রবার, শনিবার বিটিভিতে ছায়াছবি দেখানো হয়। এটা নিয়ে আবার নানা কাহিনী আছে। একটি ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ এই ছবি প্রদর্শনের সঙ্গে জড়িত। তাদের স্বার্থেই বস্তাপচা ছবি দেখানো হয়, যা কোনো দর্শক দেখে বলে আমার মনে হয় না। আমি ধারণা করেছিলাম, সারা জাতি যখন হুমায়ূনের শোকে মোহ্যমান, তখন নিদেনপক্ষে বিটিভি হুমায়ূন আহমেদের একটি পুরনো ছবি দেখাবে। না, বিটিভি দেখায়নি। এটা কি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন নয়? অতীতে হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটক বিটিভি দেখিয়েছে। নিজেরা তৈরি করেছে, কখনও অন্যের বা হুমায়ূনের নিজের করা ছবি প্রদর্শন করেছে। বিটিভি কি পারত না এ ধরনের একটি নাটক পুনঃপ্রচার করতে? বিটিভির কি এটি করা উচিত ছিল না? কী জবাব দেবেন বিটিভির মহাপরিচালক? অনেককে নিয়েই তো বিটিভি অনুষ্ঠান করে। অনেকে বিটিভিতে এসে ওইসব ব্যক্তির গুণকীর্তন করেন। এরা সবাই যে জাতীয় পর্যায়ের নেতা, তা নন। কিন্তু বিটিভি করে। কেন করে তা আমরা জানি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ কি সে ধরনের একজন ব্যক্তি ছিলেন না, থাকে নিয়ে বিটিভি একটা অনুষ্ঠান করতে পারত। প্রাইম টাইমে না হোক, গভীর রাতে হলেও তো তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না।
ম. হামিদ এখন বিটিভির মহাপরিচালক। তিনি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে আজ অবধি নিরলসভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। তিনি কীভাবে পারলেন হুমায়ূনকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান না করে? এই প্রথমবারের মতো বিটিভিতে ধারাবাহিক নাটকের একটি ‘প্রিমিয়ার শো’ অনুষ্ঠিত হয়েছে (যেখানে অবধারিতভাবে তার কন্যাও অভিনয় করেছেন)। তথ্য সচিব উপস্থিত থেকেছেন, তা-ও আবার ঘটা করে সংবাদে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু একজন হুমায়ূন আহমেদ কি বিটিভিতে উপেক্ষিত থেকে গেলেন না? বিটিভি কি তাকে অবজ্ঞা করল না? হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর সংবাদপত্রগুলো তার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছে, তাতে করে সংবাদপত্রকর্মী তথা সম্পাদকদের ওপর আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গেল। এমনকি কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রথম পাতার পুরোটা উত্সর্গ করেছে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি। সম্পাদকরা তাকে নিয়ে লিখেছেন প্রথম পাতাতেই। এটাই সঠিক। যে জাতি গুণীজনকে সম্মান না জানায়, সে জাতি বড় হতে পারে না। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ তো সেই ব্যক্তিদেরই একজন, থাকে নিয়ে জাতি গর্ব করতে পারে। তিনি প্রকাশনা জগেক কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। হুমায়ূন না থাকলে এ দেশের প্রকাশনা শিল্প পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকরা দখল করে নিত। ভারতীয় হাজারটা পণ্যের সঙ্গে যোগ হতো আরও একটা ‘পণ্য’-ভারতীয় উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ এটা হতে দেননি। তিনি নিজস্ব একটি পাঠক শ্রেণী তৈরি করেছেন, যারা পয়সা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কিনত। এই ক্রেডিট তো হুমায়ূনকে দিতেই হবে। আমি সাহিত্য সমালোচক নই। তার সাহিত্যকর্ম কতটুকু উচ্চমার্গের তা সাহিত্য সমালোচকরাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু যিনি ‘হিমু’ কিংবা ‘মিসির আলি’র মতো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তার এই সৃষ্টি নিয়ে একদিন গবেষণা হবে, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়নি। প্রথমত বয়সের একটা পার্থক্য ছিল। দ্বিতীয়ত, আমরা দু’জন ছিলাম দুই জগতের বাসিন্দা। তিনি সাহিত্য নিয়ে চর্চা করে গেছেন, আর আমি রাজনীতির উত্থান-পতন বোঝার চেষ্টা করছি। ধানমণ্ডির ‘দখিন হাওয়া’র পাশে ছিল আমার ফ্ল্যাট, লেকের পাশে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য। একবারই কথা হয়েছিল ওই বাসাতে। আরও দুয়েকবার কথা হয়েছে, সেটা মনে রাখার মতো নয়। একটা স্মৃতির কথা আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন তারা পিরোজপুরে থাকতেন। বাবা ফয়জুর রহমান ওই পিরোজপুরেই শহীদ হন। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে আমরা বাগেরহাট লঞ্চ স্টেশন থেকে হেঁটে শহরে এসেছিলাম। আমি, জাফর ইকবাল এবং হুমায়ূন ভাই। আমরা যখন মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলাম, আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের যে খবরাখবর প্রচারিত হয়, তা মনিটর করা। সেই সুবাদে একাধিকবার পিরোজপুর শহরের পুরনো থানার ঠিক উল্টো দিকে এসডিপিওর বাংলোতে গেছি। ফয়জুর রহমান সাহেব আমাকে প্রচুর তথ্য দিতেন। আমার প্রয়াত বাবার সঙ্গেও তার ছিল সখ্য। সীমিত আলাপচারিতায় ওই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হলেও তা বেশিদূর কখনও গড়ায়নি। আমি সবসময়ই চেয়েছি হুমায়ূন ভাই চাণক্য সেনের মতো (ভবানী সেনগুপ্ত) রাজনৈতিক উপন্যাস লিখবেন। সত্তর দশকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমাদের কাছে চাণক্য সেনের রাজনৈতিক উপন্যাস ছিল প্রবল এক আকর্ষণ। আজমল ভাই (সাবেক ব্যাংকার, এখন অবসরে) আমাকে সেসব বই পড়তে দিতেন। আজও সেই সব বইয়ের চরিত্রগুলো মনের আনাচে-কানাচে উঁকি দেয়। কর্নেল উনতুং (ইন্দোনেশিয়া) কিংবা কিউবার বিপ্লবের কাহিনী এত বছর পর আজও ভুলে যাইনি। এ ধরনের রাজনৈতিক উপন্যাস আমার আর পড়া হয়নি। শেষ বেলায় হুমায়ূন ভাই একটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি। ‘দেয়াল’ আদৌ সম্পাদিত আকারে প্রকাশিত হবে কি না, বলতে পারব না। কিন্তু ‘দেয়াল’ নিয়ে তো কম ‘কাহিনী’ হল না। উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনাও আছে এতে। এখন তার অবর্তমানে ‘দেয়াল’ প্রকাশ না করাই হবে মঙ্গলজনক।
হুমায়ূন আহমেদ জাতিকে অনেক দিয়েছেন। তরুণ সমাজের মাঝে একটি  ক্রেজ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ‘বাকের ভাই’-এর কাহিনী নিয়ে যে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ বাংলাদেশে ঘটে গিয়েছিল, তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু লেখালেখি করবেন, এই আশায়। তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তা পারবও না। এমনকি তার ভাই জাফর ইকবাল জনপ্রিয় লেখক হয়েও শিক্ষকতা ছেড়ে দেননি। দিতে পারবেনও না। হুমায়ূন চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আমাদের এখন উচিত স্মৃতিকে ধরে রাখা। বাংলা একাডেমীর সম্মুখের রাস্তাটি আমরা ‘হুমায়ূন স্কয়ার’ বা ‘হুমায়ূন চত্বর’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। বইমেলায় একটি কর্নার স্থায়ীভাবে হুমায়ূনের নামে নামকরণ হতে পারে। বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বাংলাবাজারের একটি সড়কের নাম হুমায়ূন আহমেদের নামে নামকরণের উদ্যোগ নিতে পারেন। বিটিভির অডিটরিয়ামের নাম হুমায়ূন আহমেদের নামে নামকরণ করলে ক্ষতি কী? বিটিভি হুমায়ূন আহমেদের প্রতি অসম্মান দেখিয়ে নিজেদের যে ‘ক্ষতি’ করেছে, সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারে এই নামকরণের উদ্যোগ নিয়ে। আমার ধারণা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। এখন ম. হামিদ কি এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেবেন? যেখানে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদকে সম্মান দিয়েছেন, নিজে হুমায়ূনের বাসায় (নিউইয়র্ক) তাকে দেখতে গেছেন, সেখানে বিটিভির এ ধরনের একটি উদ্যোগের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। মূল কথা হল উদ্যোগটাই আসল।
Daily SAKALER KHOBOR
23.7.12

0 comments:

Post a Comment