রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তারুণ্যের প্রতিবাদ ও ক্যাম্পাসে অস্থিরতা প্রসঙ্গে

বুয়েট ক্যাম্পাস ‘দখল’ করে নেওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ছবি দেখে আমার নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর কথাই স্মরণ হল। সেখানে মার্কিন সমাজের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলন এখনও চলছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সঙ্গত। যুগে যুগে তরুণ সমাজ এভাবেই প্রতিবাদ করে আসছে। এক সময় এ সমাজের ধারণা ছিল বুয়েটের ছাত্ররা যেহেতু তুলনামূলকভাবে মেধাবী, সে কারণে তারা রাজনীতির ব্যাপারে ততটা সচেতন নয়। কিন্তু ওরা সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ওরাও শরিক হয়েছে, যেমনটি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরে কিছুদিন আগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে জাবির ভিসি পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তাতে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে বলা যাবে না। নয়া ভিসি ছাত্র ও শিক্ষকদের আস্থায় নিতে পেরেছেন- তা-ও মনে হয় না। শিক্ষকরা সেখানে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। আর মজার ব্যাপার হল আন্দোলনরত শিক্ষকদের একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ দিয়েছেন নয়া উপাচার্য। আর শিক্ষকদের দাবি, মেয়াদ-উত্তীর্ণ সিনেট দিয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন করা যাবে না। এর আগে মেয়াদ-উত্তীর্ণ ডিন ও সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের বড় অংশের দাবি উপেক্ষা করে তিনি যদি ভিসি প্যানেলে নির্বাচন করেন তাহলে জটিলতা বাড়বে। সঙ্কটকে আরও গভীরতর করবে। আজ শিক্ষকরা অনশন ধর্মঘট পালন করবেন। গত এক সপ্তাহে সেখানে কোনো ক্লাস হয়নি। একই সঙ্গে বুয়েটে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীরা সবাই একাট্টা হয়েছেন ভিসি ও প্রো-ভিসির পদত্যাগের দাবিতে। বুয়েটে তারা সৃষ্টি করেছেন একটি ইতিহাস। একটা সমাজে যখন পরিবর্তন আনতে হয়, তখন সবাইকে এক হতে হয়। বুয়েটে তা-ই হয়েছে। জাবিতেও তা-ই হয়েছিল। সেখানে পরিবর্তন এসেছে। এখন বুয়েটে যে পরিবর্তন আসবে, তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয় নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। গত ১৪ জুলাই এই আন্দোলন তার ৩০০ দিন পার করেছে। আগের মতো এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর শীর্ষস্থানীয় মার্কিন সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয় না সত্য, কিন্তু যারা অনলাইনে বিভিন্ন ব্লগে তথ্য অনুসন্ধান করেন, তারা ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর খবর পাবেন। এই আন্দোলন এখনও চলছে এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদও অব্যাহত রয়েছে। মূলত মার্কিন সমাজে বৈষম্য, অসমতা, দারিদ্র্য আর ধনিক শ্রেণীভিত্তিক যে সমাজ ব্যবস্থা (প্লুটোনমি), তার প্রতিবাদেই নিউইয়র্কে ওই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জন্ম হয়েছিল। এক সময় এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ইউরোপ ও প্যাসিফিকভুক্ত দেশগুলোতেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের কোনো মিল নেই সত্য, কিন্তু এক জায়গায় আমি অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। আর তা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এ নিজেদেরকে শরিক করে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর বুয়েটে শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হওয়া ‘সকল অন্যায়ের’ বিরুদ্ধে গত বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। মিলটা এখানেই। শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের সচেতন শ্রেণী। তারাই তো প্রতিবাদ করবেন। প্রতিবাদের এই ধরন ন্যায়সঙ্গত। সমাজে অসমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যে প্রতিবাদ, যুগে যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে এর প্রকাশ ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে সারা ইউরোপে তরুণ প্রজন্ম প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করেছিল। তারা সমাজ ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি সত্য, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আমাদের দেখিয়ে দিল এই ‘বিদ্রোহের’ সঙ্গে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ, তার সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ একটি নতুন ধরনের ‘বিপ্লব’। ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল তার পেছনেও কাজ করেছিল সমাজের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্য। আজ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং যাদের সঙ্গে অতি সম্প্রতি যোগ দিয়েছে ছাত্র ও কর্মচারীরা-তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার অসমতা আর বৈষম্যেরই প্রতিবাদ করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ড়পপঁঢ়ু-তে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘রঃ রং ঔঁংঃ ধ ধুি ড়ভ ষরারহম’-জীবনধারণের একটা অংশ। আজ বুয়েটের ক্যাম্পাসে তরুণ প্রজন্ম যখন সবাই একত্রিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এমনটিই আমরা লক্ষ করেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যে ন্যায়সঙ্গত, সেটা বুয়েটের তরুণরা আবারও প্রমাণ করল। যেমনটি করেছিল জাহাঙ্গীরনগরের তরুণরা।
শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। আমার ধারণা, এ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে পছন্দ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি যে বোঝেন না তা নয়। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অস্থিরতা বিরাজ করছে। জাহাঙ্গীরনগর, পাবনা, রাজশাহী, ডুয়েট-সব জায়গাতেই এই অস্থিরতা। এই অস্থিরতা সমাধানে সরকারপ্রধানকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগরে তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। একটা সমাধান দিয়েছিলেন। নয়া ভিসি সেখানে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা যা ছিল তা রয়ে গেছে। ঢাকার উপকণ্ঠে ডুয়েটে উপাচার্য নেই বেশ কয়েক দিন হল। নতুন উপাচার্যও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সেখানকার শিক্ষকরা দাবি করেছেন উপাচার্য তাদের শিক্ষকদের মধ্যে থেকেই নিয়োগ দিতে হবে। ঢাকার শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবিও তেমনি। সেখানকার উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী ও পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দলীয় বিবেচনায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ। আর এই শিক্ষক নিয়োগে আত্মীয় কোটা ও জেলা কোটা প্রাধান্য পেয়েছে। মজার ব্যাপার, রাজশাহীর বর্তমান ভিসি সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেখানে আন্দোলন করেছিলেন একটি ইস্যুকে সামনে রেখে। তা হচ্ছে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ। আজ তিনি নিজে ভিসি হয়ে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন।
আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার পেছনে যে কারণগুলো কাজ করছে, তা অনেকটা এ রকম : ১. দলীয় কোটায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ২. কর্মচারী নিয়োগে জেলা কোটা, ৩. উপাচার্যদের দলবাজি, ৪. শিক্ষকদের অগাধ স্বাধীনতা, ৫. উপাচার্য কর্তৃক সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ব্যবহার, ৬. ছাত্র নেতাদের টেন্ডারবাজি, ৭. সরকার সমর্থক শিক্ষকদের গ্রুপিং, ৮. ভিসি নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের নিয়োগের দাবি, ৯. বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩-এর অপব্যবহার ইত্যাদি। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রায় ক্ষেত্রেই দলীয়ভাবে মনোনীত উপাচার্যরা সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না। প্রায় ক্ষেত্রে সরকার সমর্থক অনেক শিক্ষকই ভিসি হতে চান এবং তারাই সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হচ্ছে না। অসহায় শিক্ষামন্ত্রীকে তাকিয়ে থাকতে হয় সরকারপ্রধানের দিকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য যদি প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাজটি কী? ওই সংস্থার চেয়ারম্যান বা সদস্যদের দায়িত্বটি তাহলে কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা থাকতেই পারে। আর এর দেখ-ভালের দায়িত্ব তো মঞ্জুরি কমিশনের।
বুয়েটের সর্বশেষ ঘটনা প্রমাণ করল দলীয়ভাবে নির্বাচিত ও অদক্ষ উপাচার্যের জন্য একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যেখানে আদৌ প্রয়োজন নেই, সেখানে একজন প্রো-ভিসি দিয়ে বুয়েটকে দলীয়করণের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলাম আমরা। ভিসি ও প্রো-ভিসির পদত্যাগ ছাড়া কোনো কিনারা নেই। কিন্তু তারা বুয়েটে যে ক্ষত সৃষ্টি করে গেলেন, সেই ক্ষত আমরা সারাব কীভাবে? অতিদ্রুত বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে আলাপ করে আমরা যদি সমস্যার সমাধান করতে না পারি তাহলে অনেক ক্ষতি করে ফেলব। বুয়েটের ঘটনাবলি সরকারের জন্য একটা শিক্ষাও বটে।
Daily SAKALER KHOBOR
19.7.12

0 comments:

Post a Comment