রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা কেন


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপাচার্যদের পরিবর্তন করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এতটুকুও। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তারপর যাঁকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো, তিনিও পড়েছেন আন্দোলনের মুখে। আগামী ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। বুয়েটের পরিস্থিতি এখন চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষকরা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে খোদ সরকারি দলের সমর্থক শিক্ষকরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ভিসির সঙ্গে দ্বন্দ্বে সাবেক প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার ক্ষমতা হারিয়েছেন। হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছে। অসন্তোষ আছে পাবনা, রাজশাহী, ডুয়েট, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক কথায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অশান্ত। মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অশান্তি, অস্থিরতা আমাদের উচ্চ শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা যদি মোটা দাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে বেশ কিছু চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এক. এই অস্থিরতার সঙ্গে দেশের চলমান রাজনীতির সম্পৃক্ততা কম। দেশীয় রাজনীতি আদৌ প্রভাব ফেলেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণেই এই অস্থিরতা বেড়েছে। দুই. প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারসমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই আন্দোলনে বিরোধী দল সমর্থক শিক্ষকরা শরিক হলেও তাঁরা বড় কোনো ভূমিকা পালন করছেন না। জাবিতে যাঁরা ভিসিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন, তাঁরাই এখন নয়া ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুয়েটে আন্দোলনে আছেন আওয়ামী লীগ তথা বাম আদর্শের শিক্ষকরা। বিএনপি তথা ইসলামপন্থী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সীমিত। তিন. এই আন্দোলনে শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীরাও সংহতি প্রকাশ করেছেন। এ রকমটি অতীতে কখনো হয়নি। চার. আন্দোলন দমানোর ক্ষেত্রে ভিসিরা নিজ উদ্যোগে তাঁর সমর্থিত শিক্ষকদের নিয়ে একটা পাল্টা 'শো-ডাউনে'র চেষ্টা করছেন। জাবিতে চেষ্টা করেছিলেন ভিসি। কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। বর্তমান ভিসিও নিজস্ব একটি বলয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। রাজশাহীতেও এমনটি আমরা লক্ষ করি। বুয়েটেও শেষপর্যায়ে এসে ভিসি তাঁর সমর্থিত শিক্ষকদের মাঠে নামিয়েছেন। এখানে ছাত্রলীগের ভূমিকাও লক্ষ করার বিষয়। জাবিতে সাবেক ভিসি নিজস্ব একটি ছাত্রলীগ তৈরি করেছিলেন। মূলধারা ছাত্রলীগের সমর্থন তিনি পাননি। আর বুয়েটে ছাত্রলীগ ভিসির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। রাজশাহী বা ডুয়েটের ছাত্রলীগের ভূমিকা অনেকটা একই। পাঁচ. প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারপ্রধানকে একসময় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। জাবিতে তিনি করেছেন এবং একটি সমাধানও দিয়েছেন। বুয়েটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ১৬ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর একটি উদ্যোগ কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত সরকারপ্রধানকেই হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এই প্রবণতা ভালো নয়। কাম্যও নয়। যিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন বা তাঁকে থাকতে হয়, তিনি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করবেন? তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন কেন আছে? প্রয়োজনে ইউজিসির 'অথরিটি' বাড়াতে হবে। সরকারপ্রধান নিঃসন্দেহে আমাদের সবার মুরবি্ব। কিন্তু প্রতিটি কাজে তাঁর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকা কোনো ভালো কথা নয়। ছয়. প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি, আত্মীয়প্রীতির অভিযোগ উঠেছে। জাবিতে শিক্ষক নিয়োগে টাকার লেনদেন হয়েছে, এ অভিযোগ সংবাদকর্মীদের তথা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের। এটা অস্বীকার করা যাবে না, জাবিতে কম মেধাসম্পন্নরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। টাকার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়নি, কেউ উদ্যোগও নেয়নি। কিন্তু ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ার একটি ঘটনায় আশুলিয়া থানায় জিডি হয়েছে। যিনি ঘুষ দিয়েছেন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষকপ্রার্থী ছিলেন। এই ঘটনা কি প্রমাণ করে না অতীতেও এ রকমটি হয়েছিল? ১০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়েছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনিও জাবির লোক। কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিনি অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। বুয়েটেও অতিরিক্ত শিক্ষক, দলবাজ শিক্ষক নিয়োগে অভিযুক্ত হয়েছেন ভিসি। খুলনায় ভিসি থাকার সময়ও তিনি একই ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অঞ্চলপ্রীতিতে তিনি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছেন (বাড়ি তাঁর গোপালগঞ্জে)। তবে আত্মীয়প্রীতিতে সবার শীর্ষে আছেন পাবনা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ নিজ গ্রামের অর্ধশত লোককে তিনি কর্মচারী তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও বাদ যাননি। সাত. আরেকটি নতুন প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি, আর তা হচ্ছে, নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি নিয়োগের দাবি। জাবির ভিসিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল জাবির শিক্ষক সমিতি। এখন ডুয়েট বা ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও একই দাবি উঠেছে। এটা ভালো নয় এবং সমর্থনযোগ্যও নয়। ডুয়েটকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। সেখানে উপাচার্য হওয়ার মতো সিনিয়র ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও। আট. জাবিতে যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনকে 'স্বেচ্ছাচারী' হিসেবে অভিহিত করেছেন নয়া ভিসি। তাঁর এই মূল্যায়ন ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে (সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়) একটি প্রশ্নের মুখে ফেলল। এই আইন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এক ধরনের অধিকার দিয়েছে। তাঁদের 'স্বেচ্ছাচারী' বলা ঠিক নয়। জাবি ভিসি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন বাস্তবায়নে সব সময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। 'ওয়ান-ইলেভেন'-এর ঘটনায় তিনি যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখন যুক্তি তুলে ধরেছিলেন ১৯৭৩ সালের এই আইনটির, যে আইন বলে শিক্ষকরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। এখন জাবিতে শিক্ষকরা যে 'আন্দোলন' করছেন, তার সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। এটাও তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু 'স্বেচ্ছাচারী' বলাটা শোভন হয়নি। শিক্ষকরা সিনেটে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের আগে পর্যায়ক্রমে সিন্ডিকেট, শিক্ষক প্রতিনিধি (সিনেট) নির্বাচনের যে দাবি করেছেন, তা মেনে নিলে তো ক্ষতির কিছু ছিল না? সবাইকে নিয়েই তো বিশ্ববিদ্যালয়। সবাইকে নিয়েই তাঁকে চলতে হবে। আন্দোলনরত শিক্ষকরাও তো চান ভিসি প্যানেল নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে বিরোধ থাকার তো কথা নয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা আমাদের জন্য একটা আশঙ্কার কারণ। বুয়েট তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। বুয়েটে এ রকমটি কখনো হয়নি। এখানে শীর্ষে থাকা সিনিয়র শিক্ষকই অতীতে সব সময় ভিসি হয়েছেন। প্রো-ভিসির আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবু সিনিয়রিটির দিক থেকে ৫৯ নম্বরে থাকা একজন অধ্যাপককে প্রো-ভিসি করা হয়েছে শুধু দলীয় স্বার্থে। এর ফলে যে ট্র্যাডিশন ভাঙল, তা কি আর বুয়েটে ফিরে আসবে? বুয়েটের ভিসি ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন। কিন্তু তাতে তাঁর সম্মান বাড়েনি। মুক্তিযোদ্ধা ও জাবির ভিসি জাবির শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বার্থের কথা শুনিয়েছিলেন। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিনি শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা হারালেন। তিনি সবার ভিসি হতে পারলেন না। অন্তর্দ্বন্দ্বে ঢাবির ভিসি 'বিজয়ী' হয়েছেন। কিন্তু টিকতে পারবেন কি? আসলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনেরও ত্রুটি রয়েছে। একুশ শতকে এই আইনটি অচল। অতিরিক্ত স্বায়ত্তশাসন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থার একটা কারণ। ১৯৭৩ সালের আইন (যা আবার মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য) ভিসিকে আপাত ক্ষমতা দিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ, দলীয় আনুগত্য, আত্মীয়তা প্রাধান্য পাচ্ছে। মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে বাদ পড়ছেন। তাই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি রাখতে হবে ইউজিসির হাতে, অথবা পিএসসির মতো একটি সংস্থা গঠন করতে হবে, যার মাধ্যমে শিক্ষকরা নিয়োগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে চারটি স্টেজ বিবেচনায় নিতে হবে (লিখিত পরীক্ষা, ডেমো, মৌলিক পরীক্ষা ও অতীত শিক্ষা রেকর্ড)। শিক্ষকদের অবসরের বয়স আমরা বাড়িয়েছি। কিন্তু তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও তাঁদেরকে যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ আমরা নিইনি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি জাবি ও বুয়েটের ঘটনাবলি থেকে কিছুটা শেখেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের হারানো গৌরব কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে পারবে। জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে কোনো সার্থকতা নেই।Daily KALERKONTHO19.7.12

0 comments:

Post a Comment