রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কঠিন সময় পার করছে পাকিস্তান

পাকিস্তানে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, পাকিস্তানে এ মুহূর্তে এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। পাকিস্তানের সমস্যা নানা রকম- রাষ্ট্রীয় উগ্রবাদ, বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর আন্দোলন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি, অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা ইত্যাদি। এসব সমস্যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন আরো জটিল করে তুলেছে। আগামী বছরগুলোতে পাকিস্তান তার বর্তমান কাঠামো নিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এ মুহূর্তে সমস্যা একটাই- বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ক্ষমতা হারিয়েছেন। মকদুম শাহাবুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর নিয়োগ পান রাজা পারভেজ আশরাফ। তাঁর ভবিষ্যৎও এখন প্রশ্নের মুখে। সুইস ব্যাংকে জারদারির আর্থিক কেলেঙ্কারি তদন্ত করে দেখার উচ্চ আদালতের নির্দেশও তাঁকে মানতে হবে। না হলে আদালত অবমাননার অভিযোগে তিনিও অভিযুক্ত হবেন এবং গিলানির মতো ভাগ্য তাঁকেও বরণ করতে হতে পারে। বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভবত একটাই- আর তা হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু ততদিন এই সংসদ টিকবে বলে মনে হয় না।
যদিও জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা যাবে না বলে সংসদে একটি আইন পাস করা হয়েছে। তথাপি আগামী কয়েকটি মাস পাকিস্তানের জন্য সত্যিই এক কঠিন সময়। পর্দার অন্তরালে থেকে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী সব কলকাঠি নাড়াচ্ছে- এমন অভিযোগও কোনো কোনো বিশ্লেষকের। এটা অস্বীকারই বা করি কী করে? সেনাবাহিনী তো সেখানে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী। গণতান্ত্রিক শক্তিকে কোনোদিনই বিকশিত হতে দেয়নি এই সেনাবাহিনী। বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে রয়েছে দুজন পূর্ণ জেনারেল, ২১ জন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আর ১৫০ জন মেজর জেনারেল। নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনীর হিসাব না হয় না-ই দিলাম। এই বিপুল প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি শক্তি। এই শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন 'পেট্রোনাইজ' করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া হয়, তার একটা বড় অংশ যায় সেনাবাহিনীর কাছে। পরোক্ষভাবে এই সাহায্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে 'পেট্রোনাইজ' করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাতে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করেছে এই দুর্নীতির প্রশ্নটি। একসময় জারদারির পরিচিতি ছিল 'মি. টেন পারসেন্ট' হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কন্ট্রাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ড তথা লন্ডনেও রয়েছে তাঁর সম্পদ। তবে তাঁর প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফও 'ধোয়া তুলসী পাতা' নন। তাঁর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও কোনো রুল ইস্যু করেন আমি অবাক হব না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইমরান খানের মধ্যে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায়, তাহলে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজি তাতে সার্থক হবে। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার পথ আরো প্রশস্ত করছে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই আমাদের বলতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রায় ইসলামী কট্টরপন্থীদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি 'তালেবানি রাষ্ট্র'-র দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থী তালেবান। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে।
মনে রাখতে হবে, ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালেবানের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে 'ঘিরে ফেলার' এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। একদিকে আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এই পথ সম্প্রতি (খাইবার উপত্যকা) খুলে দিতে রাজি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের শামসি বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতি জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারোর গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের পেছনে এই স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে বলে আমার ধারণা। আর এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান এ বছরের শেষের দিকেই পেতে যাচ্ছে আরেকটি নয়া সরকার। কিন্তু তাতে করে কি সমস্যার সমাধান হবে? যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরবর্তী অঞ্চলগুলো নিয়ে যে একটি নয়া স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে, তাতে পাকিস্তানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানের পশতুন আর বেলুচিস্তানের পাঠানরা এক হয়ে ভবিষ্যতে একটি 'পাশতু রাষ্ট্র' (Pashto state) গঠন করতে পারে। আফগানিস্তানের তালেবানকে যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায় (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে একদিন এ অঞ্চলে জন্ম হবে তালেবানমুক্ত 'পাশতু রাষ্ট্র'।
যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাবশালী হয়ে ওঠা সহজভাবে দেখছে না। তাই পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ আর ইরানের 'সিসতান বেলুচিস্তান' মিলে একটি 'গ্রেটার বেলুচিস্তান' রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে 'বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি' ও 'বেলুচিস্তান পিপলস ফ্রন্ট', যারা স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে ওই আন্দোলনের পেছনে শক্তি জোগাতে পারে। উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের কারণে পাকিস্তানের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এই উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানে কেবল মাদ্রাসা শিক্ষাই দায়ী নয়; বরং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি সংকট, পানির অভাব ও অর্থনীতির নিম্নগতি পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই তিনটিই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ। তাই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল। ২০২০ সালের পর লাহোর ও ইসলামাবাদকেন্দ্রিক এক 'ক্ষুদ্র পাকিস্তানের' যদি জন্ম হয়, আমি তাতে অবাক হব না।Daily KALER KONTHO16.7.12

0 comments:

Post a Comment