রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সবাইকে আস্থায় আনতে পারাও গণতন্ত্র

 গত ২০ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে কি স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসছে? একদিকে শিক্ষকদের এক অংশের অনশন, অন্যদিকে সিনেটের অধিবেশন_ এটা ছিল ২০ জুলাইয়ের চিত্র। জাবির ভিসি ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছিলেন। সে কারণে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন; কিন্তু তা অত সহজ ছিল না। শিক্ষকদের একটি শক্তিশালী গ্রুপ (আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামমনা শিক্ষকদের সমন্বয়ে) প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত কোর্টের আদেশ নিয়ে তাকে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়। এ নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো, সেসব প্রশ্নের জবাবের ওপর নির্ভর করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী দিনের রাজনীতি। প্রশ্ন এক. এই নির্বাচন প্রমাণ করল সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর এখনও জনপ্রিয় এবং সমান শক্তিশালী। জাবির শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি যে একটি ফ্যাক্টর, এটা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন। তিনি সর্বোচ্চ ৫০ ভোট পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের অবস্থান দ্বিতীয়, তাও টস করে। যদি গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলা হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরকে আবার নিয়োগ দেবেন। যদিও আইনে এটি স্পষ্ট করে বলা নেই যে, সিনেটে সর্বোচ্চ ভোট যিনি পাবেন রাষ্ট্রপতি তাকেই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আবার নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ওপর তা নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রপতি অনেক কিছু বিবেচনায় নেবেন। তবে এটাও সত্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে পুরস্কৃত হওয়া অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর একজন \'সুপার ভিসি\' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন বলেই অনেকের ধারণা।
এখন প্রশ্ন_ আন্দোলনকারীদের ভূমিকা কী হবে? তারা অনশন করেছেন। অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। সেটা ছিল তাদের \'প্রতিবাদ\'। কিন্তু এখন? সিনেটে একটি প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। একটি বৈধ প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাবিতে। তাদের পক্ষে আন্দোলন করা এখন কঠিন হবে। নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজটি অত সহজ হবে না। নয়া প্রশাসনের উচিত হবে, আন্দোলনকারী সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের সঙ্গে একটা \'ডায়ালগ\' ওপেন করা। তাদের আস্থায় নিতে হবে। আস্থায় নিতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর সমর্থিত শিক্ষকদের একটি অংশ তাকে ছেড়ে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদে যোগ দিয়েছিল। তাদের অন্যতম ছিলেন যৌন অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালায়র একমাত্র শিক্ষক। গত ১৮ জুলাই প্রশাসনিকভাবে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজও সারেন। এখন এসব শিক্ষককে কি শরীফ সমর্থিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ ফিরিয়ে নেবে? নাকি চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেবে? অভিযোগ উঠেছিল, মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট, সিন্ডিকেট ও ডিন নির্বাচনের। ডিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। বাকি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে কর্তৃপক্ষ ভালো করবে। তবে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ফলাফল ডিন নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। ৪টি ডিন নির্বাচনে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের সমর্থকরা এখন ভালো করবেন। এর অর্থ জাবির সিন্ডিকেটও এখন থাকবে শরীফ সমর্থিতদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। গত কয়েক মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ভিসি উৎখাত আন্দোলনের সময় একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু অনেক কাজ এখনও বাকি। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর ভিসি থাকার সময় কিছু ভুল-ভ্রান্তি করেছেন।
তিনি তা স্বীকারও করেছেন। সে ভুলগুলো থেকে যদি \'কিছু\' শিখে থাকেন তাহলে তিনি ভালো করবেন। জাবির ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন গত ২৯ জুন ৩১তম সিনেট অধিবেশনে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান। এখন এ স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপটি কী হবে?
একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে জাবিতে। এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর চর্চা হয়েছে বটে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু শুধু এর নামই গণতন্ত্র নয়। বরং গণতন্ত্রে বলে সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথা। আস্থা অর্জন করাটা জরুরি। সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে যারা এতদিন আন্দোলন করে আসছিলেন তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় একটি সুবিবেচকের পরিচয় দিয়েছেন। তারা অনশনও দীর্ঘস্থায়ী করেননি। এটা ভালো লক্ষণ। নয়া প্রশাসনকে এখন এদিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। প্রশাসনকে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আস্থায় নিতে হবে। এভাবেই গণতন্ত্র চর্চাকে আরও শক্তিশালী করা যায়। নির্বাচনে বিজয়ের নামই গণতন্ত্র নয়। আস্থায় নেওয়ার আরেক নামও গণতন্ত্র। একটি \'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস\', অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। দ্বিতীয় যে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, শিক্ষার একটা পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। বেশ ক\'টি বিভাগে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে নানা কারণে। তরুণ শিক্ষকদের একটা অংশের উদ্যত আচরণ, সহকর্মীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন, ক্লাস না নেওয়া, দলবাজিতে ব্যস্ত সময় পার করা, সিনিয়র শিক্ষকের অভাব প্রভৃতি কারণে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনকে এখন এদিকটার দিকে নজর দিতে হবে। অনেক বিভাগে অধ্যাপক নেই। অথচ ওইসব বিভাগে পিএইচডি-এমফিল প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। বিভাগে সিনিয়র শিক্ষক ছাড়া পিএইচডি প্রোগ্রাম কীভাবে চালু হয়? বিজনেস স্টাডিজ ও আইন অনুষদ চালু হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক নেই। ফলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সামনে প্রথম বর্ষ অনার্সের ভর্তি পরীক্ষা। ৬১ হাজার ছাত্রছাত্রী এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের অনেকের আশার জায়গা এই জাহাঙ্গীরনগর। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আস্থায় নিয়েই এ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। অতীত আঁকড়ে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। জাবিতে উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন নতুন একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল। সবকিছু ভুলে, সবাইকে নিয়েই এ \'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর\' গড়তে হবে। এ কাজটি করতে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দায়িত্ব যত না বেশি তার চেয়ে বেশি প্রশাসনের। প্রশাসনকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে। সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ একটি শক্তিশালী পক্ষ। সাবেক দুই উপাচার্যের আশীর্বাদ রয়েছে তাদের পেছনে। সুতরাং তাদের আস্থায় নিতে না পারলে স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। বারবার আন্দোলন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট করে, ঠিক তেমনি এটাও সত্য যে, আন্দোলনের কারণগুলো যদি আমরা অনুসন্ধান করি এবং সে মতে ব্যবস্থা নিই তাহলে তা বন্ধ করা সম্ভব। আসুন, সবাই মিলে আমরা জাহাঙ্গীরনগরকে গড়ে তুলি, যেখানে কোনো প্রতিপক্ষ থাকবে না। কাউকে আমরা প্রতিপক্ষ ভাববও না। যারা সমালোচনা করে তাদের আস্থায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াব। এরই নাম গণতন্ত্র। শুধু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নিশ্চিত করে না।
Daily SAMAKAL,
29.7.12

0 comments:

Post a Comment