রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মেনন ভাইয়ের মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ

রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, সংসদের মেয়াদ থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তার যুক্তি হচ্ছে নির্বাচনের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি তার পদে বহাল থাকেন, তা হলে বর্তমান এমপি ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে সমান সুযোগ (লেভেল প্লেইং ফিল্ড) থাকবে না। বর্তমান এমপি প্রশাসনের কাছে বেশি গুরুত্ব পাবে। এই অসঙ্গতি দূর করতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গত ১ জুলাই। মেনন ভাইয়ের এই বক্তব্যের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে। কেননা মহাজোটে থেকেও তিনি সত্য কথা বলতে পিছপা হননি। একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি তার অভিমতটি জাতির কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি নিজে এমপি এবং মহাজোট সরকারে তার দল ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিনিধিত্বও করছে। কিন্তু তাই বলে তিনি মহাজোট সরকারের সকল অনুসৃত নীতি অন্ধভাবে সমর্থন করেননি। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে সংশোধনী এনেছে। গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে। সংশোধিত সংবিধানে বলা হয়েছে বর্তমান সরকারের শেষ তিন মাস এই সরকার ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসেবে কাজ করবে। এবং সেই সরকার পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। অর্থাত্ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল শেষ হচ্ছে। এর আগের তিন মাস অর্থাত্ অক্টোবর ২০১৩-এর পর থেকে এই সরকার ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং তারাই নির্বাচন আয়োজন করবে। মন্ত্রীরা থাকবেন। এমপিরা থাকবেন। নির্বাচন হবে। তাতে প্রশাসন তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। বর্তমান সরকারের সময় ভোলার উপনির্বাচনের খবর আমরা জানি। অতীতে মাগুরা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার জন্ম হয়েছিল। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করলেও এখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে কিছু নেই। সংবিধানে আরও বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মেনন। তার এই বক্তব্য হালকাভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সংবিধানে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে অসঙ্গতি,  তা কিন্তু নয় বরং সংশোধিত সংবিধানের বেশ কিছু জায়গায় এ ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করা প্রয়োজন। সংবিধানে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদের মধ্যে চরম অসঙ্গতি রয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বজায় রাখা হয়েছে। এটা ভালো ও যুক্তিযুক্ত। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে (২অ) বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু অষ্টম অনুচ্ছেদে [৮(১)] ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এটা একধরনের স্ববিরোধিতা। সংবিধানে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চার নীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ আর ২০১২ এক নয়। ১৯৭২ সালে সমাজতন্ত্র আমরা চেয়েছি বটে; কিন্তু ২০১২ সালে এসে কোন সমাজতন্ত্র আমরা বাস্তবায়ন করব? সমাজতন্ত্রের কোন ‘মডেল’ আমরা অনুসরণ করব? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। রাশিয়া এখন আর মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। চীনকে পুরোপুরি মার্কসবাদী একটি রাষ্ট্র বলা যাবে না। চীনে এখন ‘সমাজতন্ত্রী বাজার অর্থনীতি’ চালু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কোন ‘মডেল’কে অনুসরণ করব? স্বাধীনতা আন্দোলনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য ও সহযোগিতায় উত্সাহিত হয়ে একটি সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্র আমরা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ? সম্ভবত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিশ্চিত করতে সংবিধানের ২৫ (২) অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ নতুন সংবিধানে এই ধারাটি নেই। অথচ আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এখন সংবিধানে ওই ধারাটি বাদ দেওয়ায় মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সংবিধান সংশোধনের ফলে জাতীয় পরিচয় (২) আমাদের বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে আমরা তখন বাংলাদেশি। কিন্তু এ প্রশ্নে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর, বিশেষ করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩টি নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থান তো ভিন্ন। পাহাড়িরা তো বাঙালি নয়, তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নিলে সেদিন পাহাড়ে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। নয়া সংবিধান তারা মেনে নিয়েছেন এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। সংবিধানে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তফসিল নামে নতুন তিনটি তফসিল সংযোজন করা হয়েছে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ জিয়ার ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত হলে ক্ষতির কিছু ছিল না। সংবিধান সংশোধনীর (১৫তম) মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন (প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার) পুনর্গঠিত হয়েছে। কিন্তু সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে কি তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে? আর্থিক অভাবে সরকারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার প্রশ্নে সংবিধানে কোনো রক্ষাকবচ নেই। অবৈধ ক্ষমতা দখলকে (৭অ)  রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন, তারা কি সব সময় সংবিধান মেনে চলেন? আমরা কি পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত দিতে পারি? পাকিস্তানে ১৯৭৩ সালের সংবিধানে এরকম একটা রক্ষাকবচ ছিল (ধারা ৬-১)। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সংবিধান রচনার পর পাকিস্তানে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউল হকের মৃত্যুদণ্ড হয়নি। হয়েছিল জুলফিকার আলি ভুট্টোর।
বিএনপি এবং রাশেদ খান মেনন সংবিধান সংশোধন করার কথা বলেছেন। সংবিধানের ১৪২নং ধারায় সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধিত হওয়ায় নতুন করে সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়াও জটিল হয়ে গেছে। নয়া প্রক্রিয়ায় যেতে হলে উচ্চ আদালতসহ বহু বাধা পেরুতে হবে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর (৭ই) বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিত-করণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন এখন ‘অযোগ্য’ হবে। অর্থাত্ মৌলিক কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এর ফলে ‘জাতির পিতা’ শিরোনামের অনুচ্ছেদ ৪-এ যা কিছু আছে (ছবি প্রদর্শন), তাতে সংশোধনী আনা সহজ হবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি সংযুুক্তি (অনুচ্ছেদ ১৫০.২) সংশোধন কঠিন হবে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি, জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকতায় বাংলাদেশি বাতিল করা কিংবা ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করা খুব সহজ হবে না।
রাশেদ খান মেনন সংবিধানের এই অসঙ্গতিগুলো দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মেননের সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি। সেনগুপ্তের অতিকথন তাকে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। ‘কালো বিড়াল’-এর কাহিনী মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। তারপরও তিনি একের পর এক বক্তব্য দিয়ে নিজেকে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। মেনন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মহাজোট সরকারের বক্তব্য নয়। এটা তার দলের বক্তব্য এবং জনগণের একটা বড় অংশ এই বক্তব্য সমর্থন করে বলেই আমার ধারণা। এ দেশের সাধারণ মানুষও চায় দেশে একটি নির্বাচন হোক। কিন্তু সেই নির্বাচন যেন হয় নিরপেক্ষ। একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ  হবে না-এটাই স্বাভাবিক। মহাজোটে থেকেও তিনি জোটের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারেন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এভাবেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়।
রাশেদ খান মেনন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সভাপতি, তার নামে ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালিত হতো। এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির যারা প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন, তাদের মধ্যে মেনন অন্যতম। আমরা যারা সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আমাদের কাছে মেনন ভাই ছিলেন আদর্শ। প্রবাদ পুরুষ। প্রগতিশীল রাজনীতি থেকে উঠে আসা মানুষ। জাতির এক সঙ্কটের সময় তিনি যে মন্তব্যটি করলেন, তার গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট। স্পষ্টতই জাতি আজ বিভক্ত। একটি নির্বাচন হবে। কিন্তু দাবি উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের। দাবি উঠেছে পুনরায় সংবিধান সংশোধনের। এমনিতেই রাজনীতি উত্তপ্ত। বহির্বিশ্বে আমাদের ‘ইমেজ’ নষ্ট হয়েছে নানা কারণে। সরকার এখনও হার্ডলাইনে। একটি সংলাপের কথা বিভিন্ন মহল থেকে বলা হলেও তার জট খুলছে না। এমনই এক সময়ে রাশেদ খান মেনন গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বললেন। তার এই বক্তব্য সরকার যদি বিবেচনায় নেয়, তাতে জাতির মঙ্গল হতে পারে।
Daily SAKALER KHOBOR
10.7.12

0 comments:

Post a Comment