রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তৃতীয় শক্তি’ রাজনীতিতে কী অবদান রাখবে?



রাজনীতিতে এখন আলোচনার বিষয় একটিÑ আর তা হচ্ছে তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’। গত ৭ জুন নাগরিক ঐক্যের উদ্যোগে আয়োজিত একটি সেমিনারে বলা হয়েছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি। বিষয়টি নতুন নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ৫-৬ বছর ধরে এই তৃতীয় শক্তির কথা বারবার বলা হচ্ছে। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘তৃতীয় শক্তি’ গড়ার একটি উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সাধারণ মানুষের মাঝে আদৌ কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। একটি ‘কিংস পার্টি’কে লাইমলাইটে আনার উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিল। এই তৃতীয় শক্তি হচ্ছে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুটি প্রধান রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী দুটি বড় দলের দুই নেত্রীকে গৃহবন্দি করা হলেও দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষেই দাঁড়িয়ে গেছে। কোন তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠেনি উচ্চ পর্যায় থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও।
দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবারও উত্থাপন করা হয়েছে তৃতীয় শক্তির বক্তব্যটি। এখনও নির্বাচনের বাকি আছে দেড় বছর। দেড় বছর আগেই এ প্রশ্নটি কেন তোলা হল, এটা ভাববার বিষয়। এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। এ বক্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রথমত, তৃতীয় শক্তির ডাক যারা দিয়েছেন, তাদের মাঝে একজন বাদে বাকিদের জনগণের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না মূলত রাজনৈতিক শক্তি। বাকিরা অরাজনৈতিক। জনাব মান্না নিজে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে টিকিটও পেয়েছিলেন। কিন্তু বিজয়ী হতে পারেননি। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছেনÑ এমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। ডিসিসি নির্বাচনে নিজের প্রার্থীপদ তিনি নিজেই ঘোষণা করেছিলেন। ডিসিসি নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন নাগরিক ঐক্য, নাগরিক উদ্যোগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এর আগে তিনি ব্যারিস্টার রফিক উল হককে সঙ্গে নিয়ে অপর আরেকটি সংগঠন করেছিলেন। এই সংগঠনটির অবলুপ্তি ঘটিয়ে তিনি নাগরিক ঐক্য গঠন করেছেন কিনা, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়œ। নাগরিক ঐক্যের কোন সাংগঠনিক কাঠামো নেই। সংবিধান নেই। কর্মসূচি নেই। কিন্তু তিনি যখন বলেন, তিনি তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেবেন, তখন তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যে অনুষ্ঠানে তিনি তৃতীয় শক্তি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন দু’জন নামি ব্যক্তিÑ সাবেক আমলা এম হাফিজউদ্দিন খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল। হাফিজ সাহেব মন্তব্য করেছেন, ‘তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি’। একজন আমলা, আজীবন যিনি ব্যস্ত ছিলেন সরকারের কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে, তিনি কিভাবে উপলব্ধি করলেন যে তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি? আজীবন তো চাকরি করে গেছেন তিনি। জনসাধারণের সমস্যা সম্পর্কে যিনি আদৌ কোন ধারণা রাখেননি কোনদিন, তিনি কিভাবে উপলব্ধি করলেন বড় দুই শক্তি ব্যর্থ হয়েছে(?), এখন তৃতীয় একটি শক্তি দরকার। আমলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কারও সঙ্গেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। কোনদিন তাদের স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় তারা আদৌ গিয়েছিলেন কিনা, তাতে আমার সন্দেহ রয়েছে। এখন তারাই বললেন, তারা তিনশ’ সিটে প্রার্থী দেবেন। সাধারণ মানুষ কি এটা সহজভাবে নেবে? নেবে না।
দ্বিতীয়ত, এটা সত্য, মহাজোটের অবস্থা আদৌ ভালো নয়। এটা বুঝেই মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। আর এরশাদ সাহেব বারবার বলছেন, তারা এককভাবে নির্বাচন করবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান মোটামুটি ভালো। এখন এই জনসমর্থনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্যই কি তৃতীয় শক্তির কথা বলা হচ্ছে? কোন ‘মহল’ থেকে কি তৃতীয় শক্তির জš§ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?
তৃতীয়ত, আমরা যদি বিগত ৮টি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব ভোটপ্রাপ্তি তথা আসনপ্রাপ্তির দিক থেকে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও জামায়াতে ইসলামী যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এই দুটি দলের পক্ষ থেকে যদি তৃতীয় শক্তির ডাক দেয়া হতো, তার পেছনে যুক্তি থাকত। কিন্তু এই দল দুটি তা করেনি। এদের বাইরে গিয়ে যারা তৃতীয় শক্তির ডাক দিলেন, রাজনীতিতে ভোটের ইতিহাসে তাদের অবস্থান ‘শূন্য’।
তৃতীয় শক্তির কথা বলা আসলে ভাঁওতাবাজি। সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ, তাকে অন্যদিকে ধাবিত করার একটি ব্যর্থ উদ্যোগ এটি। আরও একটি কথা এখানে লক্ষ্য করার বিষয়। আর তা হচ্ছে দাতাগোষ্ঠী, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। পাকিস্তানে তথাকথিত দুর্নীতির কথা বলে সেখানে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানকে মার্কিনি ও ইহুদি ‘লবি’ তুলে এনেছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকে পাকিস্তানে নির্বাচন হবে এবং সবকিছু ঠিকমতো চললে ইমরান খান হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী(?)। ভারতে আন্না হাজারেকে দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এখন বাংলাদেশে ‘একজন ইমরান খানে’র খুব প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক তথা দাতাগোষ্ঠীর একটি ‘বিরোধ’ তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সরাসরি দুর্নীতির প্রশ্ন তুলেছে। এই ‘দুর্নীতি’র ইস্যুটি বিশ্বব্যাংক তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি শব্দ। এটা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বে সরকার পরিবর্তন করায়। পাকিস্তানে তারা ইমরান খানকে সামনে নিয়ে এসেছে। মিসরে ‘আরব বসন্তে’ দুর্নীতির বিষয়টি ছিল মুখ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা মিসরে আরব বসন্তকে সংঘটিত করেছিল তাদের নেতৃত্ব সারির অনেকেই ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখন মিসরে পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র বিনির্মাণে তরুণ সমাজ, সুশীল সমাজকে ‘প্রমোট’ করে। পাঠক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করুন। হিলারি ক্লিনটন তৃতীয় বা চতুর্থ রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দেখা না করলেও তরুণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এবং রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় তরুণদের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন। এখন যারা নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় তেমন একটা নেই। তারা মূলত সুশীল সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। সঙ্গত কারণেই যে আশংকা থেকে যায়, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে সুশীল সমাজকে ‘প্রমোট’ করছে, তারাই কি নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে সংগঠিত হচ্ছে?
এই তথাকথিত তৃতীয় শক্তি নিয়ে দুটি বড় দল আবার পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করেছে। গত ২২ জুন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপি তৃতীয় শক্তির উত্থান চাইছে। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর একদিন আগে বলেছেন, বিএনপি কোন তৃতীয় শক্তিকে সমর্থন করে না। তবে নাগরিক ঐক্য যদি একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আÍপ্রকাশ করে, তাহলে তারা দল হিসেবে এটাকে সমর্থন করবেন। যাকে কেন্দ্র করে এই নাগরিক ঐক্য বা তৃতীয় শক্তি, সেই মাহমুদুর রহমান মান্না সাপ্তাহিক ২০০০-এ লিখেছেন, জনগণ দুটো বড় দলের কাছে জিম্মি। জনগণের কথা শুনছে না এই দল দুটি। কিন্তু জনগণকে ওই দল দুটির কথা শুনতে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, এই দল দুটো জনগণের কথা না শুনলে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয় ঘটবেই। তিনি বড় দল দুটোর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করেছেন। একজন মান্না কি এই তৃতীয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন? জনাব মান্নার রাজনীতি স্বচ্ছ নয়। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও মূলধারার আওয়ামী লীগার নন। এক সময় জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। কিন্তু নেত্রীর কাছাকাছি যেতে পারেননি। সংস্কারবাদী হিসেবে তার একটা পরিচিতি আছে। এই পরিচয় এবং বিভিন্ন টক-শোতে স্পষ্ট বক্তব্য রাখার কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন না বলে অনেকের ধারণা। এ কারণেই তিনি নাগরিক ঐক্যের জš§ দিলেন।
নাগরিক ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন তৃতীয় ধারার সূচনা করতে পারবে না। তাদের কোন সুস্পষ্ট দিকদর্শনও নেই। তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। সুশীল সমাজকে দিয়ে রাজনীতি হয় না, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি সম্ভব নয়। সুশীল সমাজের সঙ্গে যারা আছেন, তারা যদি রাজনীতিতে অবদান রাখতে চান, সেটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। রাজনীতি করতে হলে তাদের মূলধারার রাজনীতিতে আসতে হবে। মূলধারার বাইরে গিয়ে কেউ অতীতে কোন সুবিধা করতে পারেননি। ড. ইউনূস কিংবা ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তিত্ব এখন শুধু সংবাদপত্রের পাতাতেই আছেন। অধ্যাপক ইউনূস চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। রাজনীতি একটা ভিন্ন জিনিস। রাজনীতিকরা ভুল করতে পারেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেনÑ এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণের সঙ্গে তারাই থাকেন। সাধারণ একজন মানুষ যখন কোন সমস্যায় পড়েন, তখন তিনি ছুটে যান স্থানীয় নেতৃত্বের কাছে। তারাই তাদের আশ্রয়স্থল। ড. ইউনূস সাধারণ মানুষকে নিয়ে এখন ‘সামাজিক ব্যবসার’ কথা বলেন। কিন্তু তিনি কি আদৌ সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে কোনদিন দাঁড়িয়েছেন? একজন কামাল হোসেনের কাছে কি সাধারণ মানুষ যেতে পারে? ড. কামাল হোসেনের যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা তাকে জাতীয় নেতায় পরিণত করতে পারেনি। আজ একজন মান্নার মাঝে হতাশা কাজ করে। তার নিজের নির্বাচনী এলাকা কোনটি, এটা নিয়েও সমস্যা আছে। বগুড়াতে তিনি নির্বাচন করেছিলেন বটে, কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি আর তার নির্বাচনী এলাকায় যাননি। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক একজন ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিজীবী এক কথা নয়। জনাব মান্না আজ যে কথাগুলো বলছেন, সেই কথাগুলো তিনি দলীয় ফোরামে বললে ভালো করতেন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এটা না বলে আরেকটি ‘দল’ গঠন করা, তৃতীয় শক্তির কথা বলা জনগণকে বিভ্রান্ত করার শামিল। এই তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদৌ কোন অবদান রাখতে পারবে না।
Daily JUGANTOR

14.7.12

0 comments:

Post a Comment