আগামী
৪ নভেম্বর (২০১৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হবে। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মার্কিন রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বিশেষ করে ২০১৬ সালে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই
নির্বাচনের ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০১২) দুই বছর পর
কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সিনেটের তিনভাগের এক ভাগ
আসনের আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের পুরো আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিনেট
সদস্যরা ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। একই সালে বেশ কয়েকটি রাজ্যের গভর্নর,
কিছু রাজ্যের কংগ্রেসের কোনো কোনো শহরের মেয়রের নির্বাচনও একই সময় অনুষ্ঠিত
হবে। ৪ নভেম্বর ৪৭১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে হাউস অব
রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৩৫টি আসন ও সিনেটের ৩৬টি আসন। একই সালে আরো ৩৪টি গভর্নর
পদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক
দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সিনেট। ১০০ সিনেট সিটের ৫৩টি আসন রয়েছে
ডেমোক্রেটদের। রিপাবলিকানদের হাতে রয়েছে ৪৫টি আসন। দুজন রয়েছেন নিরপেক্ষ।
অন্যদিকে ৪৩৫ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রিপাবলিকানদের দখলে রয়েছে ২৩৩টি আসন।
আর ডেমোক্রেটদের রয়েছে ১৯৯টি আসন। এখন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এই আসন
বিন্যাসে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তাই দেখার বিষয়। অতীতে কংগ্রেস সদস্যদের
সঙ্গে নানা জটিলতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। গেল বছর 'শাট
ডাউন'-এর মতো ঘটনাও ঘটেছিল। বর্তমানে দুটো ইস্যুতে ওবামা বড় ধরনের সঙ্কটে
আছেন। এর একটি হচ্ছে 'ইবোলা' ইস্যু ও দ্বিতীয়টি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস
বা ইসলামিক স্টেটের উত্থান। এখন কংগ্রেসের (উভয় কক্ষ) নিয়ন্ত্রণ যদি
ডেমোক্রেটদের হাতে না থাকে, তাহলে সঙ্কট আরো গভীর হবে। আইএসের উত্থান নিয়ে
চাপের মুখে আছেন ওবামা। স্থল যুদ্ধ তিনি সিরিয়ায় শুরু করেননি বটে, কিন্তু
বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে পরোক্ষ সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ। তার ক্ষমতা
দীর্ঘায়িত হয়েছে। এর আগে মার্কিন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আসাদবিরোধী
ফোর্সকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার। কুর্দিদেরও সমর্থন করেছিল ওবামা
প্রশাসন। এখন দেখা গেল আসাদবিরোধী ওই ফোর্স আর আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত
হচ্ছে না। বরং ওই ফোর্স ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এতে সুবিধা
পাচ্ছেন আসাদ স্বয়ং। এটা ওবামা প্রশাসনের জন্য বড় ব্যর্থতাকে সিরিয়ায়
ইসলামিক জঙ্গিদের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি ওবামা
প্রশাসন। মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে ইসলামিক জঙ্গিদের যখন ওবামা প্রশাসনকে একটি
বড় ধরনের বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে ঠিক তখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস শহরে,
যেখানে আমি বর্তমানে বসবাস করি, সেখানে 'ইবোলা' রোগের বিস্তার ঘটায়, ওবামা
প্রশাসন আরো বিতর্কের মধ্যে পড়েছে। বলা হচ্ছে ওবামা প্রশাসন জনস্বাস্থ্য
রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই 'ইবোলা' রোগটির উৎপত্তি
লাইবেরিয়ায়। একজন লাইবেরিয়ান নাগরিক ডানকান এই রোগটি শরীরে বহন করে ডালাসে
আসেন। তার চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি। তিনি মারা গেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে।
তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দুজন নার্সের শরীরে, যারা ডানকানের দেখাশোনায় নিয়োজিত
ছিলেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে যে প্রায় ২০০ ব্যক্তির ওপর পুরো ডালাস ও এর
আশপাশ এলাকায় বসবাস করেন, তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ
আতঙ্কে থাকে 'ইবোলা' আরো ছড়িয়ে পড়ল কিনা, তা জানার জন্য। শুধু তাই নয়_ এ
ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেও ডালাসের নার্স অ্যাসোসিয়েশন
তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলেছে। আরো খারাপ
খবর হচ্ছে স্পেন থেকেও 'ইবোলা' আক্রান্ত একজন নার্সের সংবাদ এসেছে। ওই
নার্সও লাইবেরিয়া থেকে এসেছিলেন। সতর্কতা জারি করা হয়েছে ইউরোপের প্রায়
প্রতিটি বড় বড় শহরে। হাসপাতালগুলো বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। টিভি
সংবাদে দেখা যায় কীভাবে সেবিকারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরে হাসপাতালে কাজ
করছেন। 'ইবোলা' নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃৃপক্ষ যখন
হিমসিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের তাদের উদ্বেগের কথা
জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে আগামী ২ মাসে ১০ হাজার 'ইবোলা'
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায় বিশেষ করে
লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন। এসব দেশে এই রোগে মারা গেছেন ৯ হাজার ব্যক্তি। এই
সংখ্যা হয়তো আরো বেশি হতে পারে। পুরো তথ্য সেখান থেকে আসছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'ইবোলা' নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। গত পত্রিকায় নানা
সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে দুটো সংবাদ বেশ স্পর্শকাতর। প্রথমটিতে
নাভারো নামের একটি কলেজে, যা ডালাসে অবস্থিত, সেখানে দুজন নাইজেরিয়ার
ছাত্রের ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই দুই ছাত্রকে চিঠি দিয়ে
জানিয়েছে যে 'ইবোলা' আক্রান্ত কোনো দেশের ছাত্রকে ভর্তি করবে না নাভারো
কলেজ। দ্বিতীয় সংবাদটি আরো স্পর্শকাতর। মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে ব্যাপকভাবে
'ইবোলা' সংবাদ প্রকাশ করার উদ্দেশ্য একটিই_ আর তা হচ্ছে আফ্রিকা থেকে আসা
অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমন ও বসবাসের ব্যাপারে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ
করা। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ওই অভিবাসীদের বিষয়টি অনেকটা
সহজ এবং হাজার হাজার আফ্রিকার অভিবাসী প্রতিবছরই এখানে স্থায়ী হচ্ছেন, তাই
আইন প্রণেতাদের ওপর একটা 'চাপ' ও জনমত সৃষ্টির উদ্দেশেই 'ইবোলা'র বিষয়টিকে
সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে জানি না। তবে কট্টরপন্থী
কনজারভেটিভরা যে অভিবাসী আফ্রিকা ও এশিয়াদের বিরুদ্ধে, তার প্রমাণ আমরা
একাধিকবার পেয়েছি। আফ্রো-আমেরিকান অর্থাৎ যাদের পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে
এখানে দাস হিসেবে এসেছিলেন (মিসেস ওবামার পরিবারও দাস ছিল), তারা প্রায়ই
শ্বেতাঙ্গদের টার্গেট হচ্ছেন। ক'দিন আগে ফার্গুসন শহরে এক কিশোর
আফ্রো-আমেরিকান নাগরিককে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বড় ধরনের আলোড়ন তুললেও,
এই প্রবণতা যে থেমে গেছে তা বলা যাবে না। তাই 'ইবোলা' সংক্রমণের সঙ্গে এ
ধরনের কোনো মানসিকতা কাজ করছে কিনা, তা হুট করে বলা যাবে না। ৯/১১ পরবর্তী
ঘটনাবলিতে মুসলমানরা যেভাবে একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন, এখন 'ইবোলা'র ঘটনা
'আবিষ্কৃত' হওয়ার পর আফ্রিকার নাগরিকরা একটা আতঙ্কে থাকবেন এটা বলাই যায়।
আগামী দিনগুলোয় নাভারো কলেজের মতো অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে আফ্রিকা
থেকে আবেদন করা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করতে অস্বীকার করার কথা আমরা জানতে
পারব।
এই ঘটনায় আবারো প্রমাণিত হলো_ অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে গুরুত্বের সঙ্গে
বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এই
অপ্রচলিত নিরাপত্তা ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। পানি, জলবায়ু
পরিবর্তন, ব্যাপক নগরায়ণ, ইত্যাদির পাশাপাশি যোগ হয়েছে ছোঁয়াচে রোগের
বিস্তার। কিছু অসাধু ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে এ ধরনের জীবাণু ল্যাবরেটরিতে
তৈরি করতে পারেন এবং যার দ্বারা হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে
দেয়া সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের কাছে এ ধরনের জীবাণু
অস্ত্র থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আল-কায়েদার সঙ্গে কাজ করেন এমন কিছু বিশেষজ্ঞ
বা বিজ্ঞানী প্রবাসে রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। আইটিতে তারা একটি শক্তিশালী
নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন এবং সফলভাবে তা প্রয়োগও করছেন। ফলে ইসলামিক জঙ্গিরা
যে জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না, তা বলা যায় না। অনেকের স্মরণ থাকার
কথা_ ৯/১১-এর ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বুশ সম্ভাব্য একটি জীবাণু অস্ত্রের
আক্রমণ ঠেকাতে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছিলেন। যদিও পরে এ ধরনের কোনো আক্রমণ
হয়নি।
এখন ডালাসে 'ইবোলা' আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর মিডিয়ায় নানা 'স্পেসেকুলেশন'
করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্কুলে কোনো
বাচ্চার সামান্য জ্বর হলেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আফ্রিকান
নাগরিকদের 'অন্য দৃষ্টিতে' দেখা হচ্ছে। এগুলো সবই সাম্প্রতিক ঘটনা। তবে
এখানে গবেষণা হয়। এরা গবেষণা করে। সেই সুযোগ আছে। শীর্ষপর্যায় থেকে গুরুত্ব
দেয়া হয়। ফান্ডও আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণা করার
সম্ভাবনা কম। আমাদের আর্থিক ভিত্তিও দুর্বল। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ
ধরনের সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটলে সরকার হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়, আবার
কার্যক্রমে স্থবিরতা এসে যায় কিছুদিন পর। 'ইবোলা'র বিস্তারের হুমকির মুখে
সরকার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্যানিংয়ের
ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই আমার ধারণা।
এখন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা যদি ভালো করে, তাহলে
নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে প্রশাসনে। ওবামা প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে
পারবেন না। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ (উভয় কক্ষ) যদি রিপাবলিকানদের হাতে চলে
যায়, তাহলে রিপাবলিকানরা একের পর এক বিল পাস করবেন। যাতে ওবামা তার গৃহীত
নীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন না।
আইএস জঙ্গিদের ক্ষেত্রে মার্কিনি ভূমিকায় পরিবর্তন আসতে পারে। সিরিয়া ও
ইরাকে স্থল যুদ্ধের সূচনা করতে পারে কংগ্রেস। কেননা সংবিধান অনুযায়ী
একমাত্র কংগ্রেসই যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। প্রেসিডেন্ট পারেন না। 'ইবোলা'
রোগ নিয়ে মার্কিনিদের যে সংশয়, সে ব্যাপারেও কঠোর হতে পারে কংগ্রেস। পশ্চিম
আফ্রিকা থেকে অভিবাসী আগমন সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষিত হতে পারে। ইতোমধ্যে
তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিমানবন্দর ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে দেখতে
হবে এই নির্বাচন কী ফল বয়ে আনে। এর মধ্যদিয়ে মার্কিন নীতিতে যদি পরিবর্তন
আসে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
Daily Jai Jai Din
29.10.14
0 comments:
Post a Comment