রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ওবামা-মোদি বৈঠকের বার্তাটি কী

সম্প্রতি ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা বৈঠকের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই আলোচনা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এটা ছিল প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। একসময় যে মোদি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ছিলেন, ওবামা প্রশাসন তাকে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মোদি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে একটা মেসেজ অন্তত দিতে চেয়েছেন যে, তিনি অতীতকে ভুলে সামনে তাকাতে চান। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই তিনি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে আগামী দিনে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কারণ এই সম্পর্কোন্নয়নের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। এক. ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে মোদি নিজে উপস্থিত থেকে চীনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি দেশজুড়েই ব্যাপক চীনা বিনিয়োগ চান। চীনা প্রেসিডেন্ট তাকে সেই আশ্বাসই দিয়ে গেছেন। এখন ভারতে চীনা স্বার্থের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দেয় কি-না, সেটা দেখার বিষয়।দুই. রাজনৈতিকভাবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব বাড়ছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে ছয়টি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এক সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, চীনকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলা। চীনে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানো মূল লক্ষ্য। চীনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতেই হবে। মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে কাজ করছে এই মানসিকতা। ফলে মোদি ওয়াশিংটনের এই পরিকল্পনায় কতটুকু সায় দেবেন, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, উভয় শক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই ব্রিকস সদস্য। ব্রিকস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট ভারত সফরের সময় মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেছেন। এই দুটি দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি সেদেশে যাননি বটে, কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এ অবস্থায় এটা বোঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না, তা নয়। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দূরত্ব কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি।তিন. আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরও বেশকিছু দিনের জন্য মার্কিন সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হবে। অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছেন ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরও বড় কোনো কর্মসূচি নেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। কাজেই ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা বৈঠক যে নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। উভয়ের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দুই দেশের মনোভাব অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর বিশাখাপত্তম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। সেই সঙ্গে ভারতের ৫০০ ছোট শহরে সোলার এনার্জি চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাস দমনেও দুই দেশের মনোভাব এক। লস্কর ই তৈয়্যেবা, জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দুই দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-এর আগ্রাসন রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছে, ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত তাতে যোগ দিক। কিন্তু ভারত রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এ শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত এতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই তা নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো, তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় ১ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। মার্কিন চাপ উপেক্ষা করে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন- আর তা হচ্ছে, আইএসের বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পৌঁছতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এ ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিন স্বার্থে সবসময় কাজ করে না, এটা আবারও প্রমাণিত হল। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্ত বাণিজ্য তথা টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারে মোদি কোনো কমিটমেন্ট করেননি। মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন- এমন অভিমত ভারতের নীতিনির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনও উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিপিতে ভাতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কারণ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তাতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সফরকে একটি নতুন ডাইমেনশন হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটা সত্য, ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল, মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচারে তেমন গুরুত্ব পায়নি। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, মনমোহন সিংয়ের জন্য ওবামা যে ডিনারের আয়োজন করেছিলেন, তাতে আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা ছিল ৩০০ আর তাতে খরচ হয়েছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অথচ মোদির সম্মানে যে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন মাত্র ২০ জন। মোদি নিজে উপস্থিত থেকে ডিনারে অংশ নেননি। তিনি তখন উপবাসে ছিলেন। হিন্দু শাস্ত্রে এই উপবাসকে বলা নয় নবরাত্রি। আরও একটি কারণে মোদির সফর কিছুটা কলংকিত হয়েছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রাক্কালে নিউইয়র্কের একটি কোর্ট ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে একটি সমন জারি করে। তাকে ২১ দিনের একটি সময়সীমা দেয়া হয় জবাব দেয়ার জন্য। কোর্টের এই সমন তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে স্থগিত করতে পারেনি সত্য, তবে তা মার্কিন সমাজে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেনি। মার্কিন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে সোচ্চার। ভবিষ্যতে কোনো মার্কিন আইনপ্রণেতা এই গণহত্যা নিয়ে যে প্রশ্ন তুলবেন না, এটা বলা যাবে না। মার্কিন বিচার বিভাগ স্বাধীন। তারা যে কোনো দেশের সরকারপ্রধানের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না এটা সত্য, তবে দেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দেয় বৈকি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারত একটি বিশাল বাজার। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০১০ সালে ওবামা যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, তখন এক বিশাল বাণিজ্য প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে ছিল। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অথবা চতুর্থ বড় অর্থনীতির দেশ। সেখানে রয়েছে বিশাল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মার্কিন ব্যবসায়ীদের জন্য তাই রয়েছে বিশাল এক সম্ভাবনা। তেল ও গ্যাস সেক্টরে সম্ভাবনা বাড়ছে। ভারতে এনার্জি চাহিদা বাড়ছে শিল্পায়নের কারণে। মোদি নিজে শিল্পায়নের পক্ষে। তিনি গুজরাট মডেলকে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চান। ফলে তার বিনিয়োগ দরকার। সুতরাং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে আগামীতে নতুন একটি মাত্রা পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করা যে খুব সহজ হবে, তা বলা যাবে না। এরই মধ্যে ভারতের দিকে চোখ পড়েছে চীনাদের। চীনারাও বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন। তাই একদিকে ভারত-চীন সম্পর্ক যেমন আলোচিত হতে থাকবে, তেমনি আলোচিত হতে থাকবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কও। এতে করে ভারত নিজে কতটুকু উপকৃত হয়, সেটাই দেখার বিষয়। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Jugantor 15.10.14

0 comments:

Post a Comment