রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীনের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

হংকংয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে, ঠিক তখনই চীনের অর্থনীতি সম্পর্কে একটি ভালো খবর দিয়েছে আইএমএফ। আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অতিক্রম করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে চীনের অর্থনীতির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০৫ সালে চীনের অর্থনীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির অর্ধেকের সমান। মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অতিক্রম করল। আইএমএফের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৯ সাল নাগাদ চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ হারে বাড়বে। নিঃসন্দেহে এই সংবাদটি চীনাভক্তদের আরও উৎসাহিত করবে। কিন্তু এতে করে চীনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবি কি কমে আসবে? আজ যখন হংকংয়ে আরও বেশি গণতন্ত্রের দাবি উঠেছে, তখন চীনেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিল কিনটন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে এসে একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জীবদ্দশায় চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা তিনি দেখে যেতে চান। চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এ ধরনের স্বপ্ন কেউ কেউ দেখেন বটে, কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। চীনের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের কোনো মিল নেই। ফলে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, পশ্চিমা সমাজের কারও কারও এই চিন্তাধারা নিয়ে প্রশ্নই থেকে যাবে শুধু। অতি সম্প্রতি হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, তখন নতুন করে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আবারও উঠল। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা অনেকেই করেন না, তা হচ্ছে হংকং আর চীন এক নয়। হংকং তার পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো নিয়েই চীনের সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল। আর চীন বিশ্ব রাজনীতিতে ১৯৪৯ সালে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ২০১৪ সালে এসে চীনকে আর পুরোপুরি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। সেখানে সমাজতন্ত্র আর বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আর পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বোধ করি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। তাই হংকংয়ের এই আন্দোলন কী আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর? গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা এতে করে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে। তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরও কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন। প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেনঝেন কিংবা ওয়াংঝেন এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না। বরং শেনঝন কিংবা ওয়াংঝেনের মতো এলাকায় নতুন অর্থনৈতিক জোন গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তাই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে প্রথম অর্থনীতি। ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরও উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি ‘মার্কিনি ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি ও তার পলিটব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধী একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন। তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্তও নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুকায়িত। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনো পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি ‘সিঙ্গাপুর মডেল’-এর জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকংয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। চীন একটি বড় দেশ। প্রায় ৫৫ জাতি, উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই চীনা রাষ্ট্রটি। ২২টি প্রদেশ, ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪টি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কার তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এই রাষ্ট্রটি ভেঙে যেতে পারে। এটা বলা যায়, একুশ শতক হচ্ছে চীনের। এই শতকে চীন অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ২০৩৫ সালে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। এর পরিমাণ হবে শতকরা ৩০ শতাংশ। ভারতের অবস্থান দাঁড়াবে তৃতীয়, শতকরা ১৪.৩ ভাগ। জাপান তার অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন যে একটি ‘হুমকি’, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তাই ‘চীনের ডানা’ কেটে ফেলতে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা যে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা বিশ্বে চীনের কর্তৃত্ব যদি বেড়ে যায়, তাহলে তা মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। আফ্রিকায় চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যেখানে জ্বালানিসম্পদ রয়েছে, সেখানে চীন বড় বিনিয়োগ করেছে (যেমন সুদান)। মধ্য এশিয়ার জ্বালানিসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোর সমন্বয়ে চীন গড়ে তুলেছে ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (এসসিও)। রাশিয়াও এসসিওর সদস্য। এই এসসিওকে অনেকে সাবেক ওয়ারশ সামরিক জোটের (১৯৮৫ সালে অবলুপ্তি) বিকল্প ভাবছে। এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প একটি ‘বিশ্বব্যাংক’-এর কথাও বলছে চীন। ফলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব যতটুকু ‘সফল’ হয়েছিল, চীনের ক্ষেত্রে ততটুকু সফল হবে বলে মনে হয় না। চীনকে ভাঙাও সহজ হবে না। চীনে দরিদ্রতা আছে, এটা সত্য। এই দরিদ্রতা ইতোমধ্যে অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করছে চীনা নেতৃবৃন্দ। আইএমএফ সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে চীন অন্যতম বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন চীনা নেতৃবৃন্দ যদি এই অর্থনৈতিক শক্তিকে চীনা জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয় করেন, তাহলে সেখানে অসন্তোষ জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে সঙ্গত কারণেই একটা কথা বলা প্রয়োজনÑ আর তা হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে সংস্কার কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে চীনে ব্যর্থ হলো না কেন? গত ২০ বছর এ প্রশ্নটি বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছে। বলে রাখা ভালো, চীনে সংস্কার কর্মসূচি শুরু হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কার কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে। দেং জিয়াও পিং তার সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষের দিকে, ১৯৭৯ সালের পর। অর্থাৎ মাও সেতুংয়ের মৃত্যু ও তথাকথিত ‘চার কুচক্র’-এর অপসারণের পর দেং জিয়াও পিং পাদপ্রদীপের আলোকে চলে আসেন এবং সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যান। অন্যদিকে ১৯৮৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে গরবাচেভ ১৯৮৭-৮৮ সালে তার সংস্কার কর্মসূচি চালু করেন। তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিও চালু করেছিলেন। ‘গ্লাসনস্ত’ আর ‘পেরেস্ত্রৈকা’ মতবাদের আলোকে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কার (ব্যক্তিগত পুঁজি, বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কমানো) ও রাজনৈতিক সংস্কারও চালু করেছিলেন (কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে অন্যান্য দলের জন্ম, নির্বাচনে অন্যান্য দলের অংশগ্রহণ, সংবিধান সংশোধন করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি)। গরবাচেভ ভুলটা এখানেই করেছিলন। কিন্তু চীনারা এই ভুলটা করেনি। চীনে শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক সংস্কার হয়নি। ফলে চীন এখনো টিকে আছে। শুধু চীন কিংবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা কেন বলি? প্রায় প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশেই সংস্কার আনা হয়েছে, আর তা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কার। ভিয়েতনামে যে সংস্কার হয়েছে, তাকে তারা নামকরণ করেছে ‘দই মই’ হিসেবে। ফলে আজ হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে চীনের সমাজব্যবস্থাকে বিচার করা যাবে না। চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও কম। চীন প্রমাণ করেছে, শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব। তবে আজকের চীনকে দিয়ে ২০৫০ সালের চীনকে বিচার করা যাবে না। চীনে কনফুসিয়াস মতবাদ (যা কমিউনিস্ট শাসনামলে নিষিদ্ধ ছিল) শক্তিশালী হচ্ছে। চীন এখন কনফুসিয়াসকে স্বীকার করে। এই কনফুসিয়াস মতবাদের মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তি তথা পারিবারিক সমৃদ্ধি। চীন এটা ধারণ করে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারটি প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। চীনে পশ্চিমা সমাজের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্র, পূর্ণ ব্যক্তিগত খাতনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে না। এখানে একদলীয় অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টিনির্ভর একটি সমাজব্যবস্থা থাকবে, যেখানে ধীরে ধীরে বিকল্প দু-একটি পার্টির জন্ম হবে। তবে সমাজে এদের কোনো প্রভাব থাকবে না। অর্থনীতি হবে মূল চালিকাশক্তি। রাষ্ট্রীয় খাতের পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাত আরও সম্প্রসারিত হবে ও তাদের প্রভাব বাড়বে। তবে অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে। এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি চীনের সমাজ তথা রাজনৈতিকব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কমিউনিস্ট পার্টির একক কর্তৃত্ব বজায় থাকবে বটে, তবে ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন। পলিটব্যুরোতে (পার্টি) স্থায়ী পদ বলে কিছু থাকবে না। শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে। মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হতে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে বেসরকারি খাত থেকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা একজন টেকনোক্রেটকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখালে আমরা অবাক হব না। স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির বাইরের লোকজনরাও আসতে পারেন। রাষ্ট্র পরিচালনা বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে। কিছু বিরোধী দলের কর্মকা-ে সরকার অনুমতি দিতে পারে। তবে তাদের কর্মকা- পরিচালিত হবে চীনের সংবিধানের আলোকে ও কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রচ্ছায়ায়। সেনাবাহিনীর ওপর পার্টির কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। অর্থাৎ পার্টির ‘পলিটিক্যাল কমিশনার’ সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবেন। একজন প্রফেশনাল সেনা কর্মকর্তা সেনা নেতৃত্বে থাকবেন বটে। কিন্তু মূল ক্ষমতা থাকবে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। এই সেনাবাহিনী শুধু চীনের রাষ্ট্রীয় অখ-তাকেই নিশ্চিত করবে না। বরং কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে। চীনে একটি শিক্ষিত, দক্ষ প্রফেশনাল শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়নি। কিন্তু অর্থনীতি তথা সমাজ উন্নয়নে তাদের ভূমিকা ব্যাপক। এই প্রফেশনাল শ্রেণি আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের সম্পর্কিত করবে। তাই হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন মূল চীনা রাজনীতিতে এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রের কথা বলে চীনের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক না গলায়, তাহলে ভালো করবে। হংকংয়ের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি খোদ চীনে আবারও ১৯৮৯ সালের ‘তিয়েন আনমেন’-এর ঘটনার (বেইজিংয়ে ছাত্র অসন্তোষ ও গণতন্ত্রের দাবি) পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়, তাহলে তা চীন-মার্কিন সম্পর্ককে নানা জটিলতার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটা কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। চীন এখন বিশ্বশক্তি। খোদ যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এ অবস্থায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি মার্কিন নীতিনির্ধারকরা অব্যাহতভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায়। আজকের চীন আর ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয়। একটি শক্তিশালী চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও মঙ্গল। হংকংয়ের ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। দীর্ঘ দুসপ্তাহের ওপরে চলা এ আন্দোলনে হংকংয়ের অর্থনীতি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে করে চীনের অর্থনীতিতে তা কতটুকু আঘাত করেছে, সেটা আমরা আগামী দিনেই যাচাই করতে পারব। তবে চীনের অর্থনীতি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটা মনে হয় না। কেননা হংকংয়ের অর্থনীতির ওপর চীনের অর্থনীতি নির্ভরশীল নয়। ধারণা করছি ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনের একটা সমাধান হবে। গত শুক্রবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হংকং কর্তৃপক্ষের আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা ‘ফল’ বের হয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। এটা ভুলে গেলে চলবে না, এর আগেও হংকংয়ে এ ধরনের আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তাতে হংকং ও চীনানীতিতে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি। চীনে একবারই তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ আন্দোলন হয়েছিল। বেইজিংয়ের ‘তিয়েন আনমেন’ (১৯৮৯) আন্দোলনও চীনে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারেনি। আজ প্রায় ২৬ বছর পর যারা আরেকটি তিয়েন আনমেনের স্বপ্ন দেখছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী চীনা জনগণের কাছে রাজনৈতিক বিষয়াদি প্রাধান্য পায়নি কখনো। আর চীনে ‘একজন গরবাচেভ’ও নেই যিনি পুরো সমাজব্যবস্থা ভেঙে পশ্চিমা ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগ নেবেন। তাই হংকংয়ের ঘটনাবলি দিয়ে চীনকে বিচার করলে ভুল করা হব Daily Amader Somoy 14.10.14

0 comments:

Post a Comment