রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঐতিহাসিক ভারত সফরের পর একটি 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর যে কথা তিনি বলেছেন, তাতে আগামী দিনে চীনের স্বার্থের সঙ্গে ভারতীয় স্বার্থ একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কেননা মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে যে 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর'-এর কথা বলেছেন, তার সঙ্গে চীনের প্রস্তাবিত 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর কোনো অমিল নেই। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত সফরের পাশাপাশি মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেন। এসব সফরের মধ্যদিয়ে একটা মেসেজ চীনা নেতারা দিলেন যে চীন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীন এই সম্পর্ককে ভারতীয় মহাসাগরের ব্যাপারে তার স্বার্থকে এক করে দেখতে চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন একটি 'মুক্তার মালা' নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক বন্দরগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় একত্রিত করেছে। আর এটাকেই তারা বলছে মুক্তার মালা নীতি। চীনা নেতারা এটা বোঝেন যে ভারতীয় মহাসাগর তথা প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি হবে এই অঞ্চল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশাল এক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চীন এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব করতে চায়। এটাই হচ্ছে চীনের নয়া সিল্ক রুট, ম্যারিটাইম বা বাণিজ্যিক সিল্ক রুট। অন্যদিকে এ অঞ্চলের ব্যাপারে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রয়েছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ওবামার সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে তিনি একটি 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনিক করিডোর'-এর কথা বলেছেন। এর সঙ্গে বাহ্যত চীন প্রস্তাবিত 'ম্যারিটাইম সিল্ক রুট'-এর কোনো পার্থক্য নেই। চীন ও ভারত উভয়েই এশিয়ার উঠতি শক্তি। মোদি নিজে একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে তার পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করছেন। ফলে তার যুক্তরাষ্ট্র সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই তিন সরকারের (চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যকার সম্পর্ক দেখা কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মধ্যে আলোচিত হতে থাকবে। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র উভয় শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই 'ব্রিকস'-এর সদস্য। 'ব্রিকস' সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় একই সময় তিনি মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাও সফর করেছেন। এই দুটো দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি পাকিস্তানে যাননি বটে। কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এমতাবস্থায় এটা বোঝা যায় যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না, তা নয়। এ অঞ্চল তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের 'দূরত্ব' কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও, নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরো বেশ কিছুদিনের জন্য মার্কিনী সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য একটি ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হবে এটা অনেকেই জানেন যে ওবামা প্রশাসন চাচ্ছেন ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিনী স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরো বড় কোনো কর্মসূচি নেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। ফলে ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা শীর্ষ বৈঠক যে তাদের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছরমেয়াদি যে সহযোগিতা চুক্তি তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দু'দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দু'দেশের মনোভাব এক ও অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে। সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর ভিজাগাপট্টম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে, সেই সঙ্গে ভারতের ছোট ছোট ৫০০ শহরে 'সোলার অ্যানার্জি' চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি খাতে এখানে বিনিয়োগ বাড়বে। সন্ত্রাস দমনেও দু'দেশের মনোভাব এক। লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশই মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দু'দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দু'দেশে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'-এর অগ্রসর রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক একটি এলায়েন্স গঠিত হয়েছে। ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত সেই এলায়েন্সে যোগ দিক। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল-কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এই শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নী জঙ্গিগোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'-এর উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত এতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই নানার প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। সম্ভবত মার্কিনী চাপ উপেক্ষা করে যে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন_ আর তা হচ্ছে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পেঁৗছে যেতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি 'নিরপেক্ষ' অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এই ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিনী স্বার্থে সব সময় কাজ করে না, এটা আবারো প্রমাণিত হলো। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হয়। শুধু জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি, একটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারেও মোদি কোনো 'কমিটমেন্ট' করেননি। মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন_ এমন অভিমত ভারতের নীতিনির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনো উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিপিতে ভারতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কেননা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সফরকে একটি 'নতুন ডাইমেনশন' হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, এটা সত্য ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল, মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচার কম গুরুত্ব পেয়েছে। তবে মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওবামা এই মেসেজেটি দিতে চেয়েছেন যে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে চান। অন্যদিকে হংকংয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চীনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা ঘটল এমন এক সময় যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন এক নাম্বার শক্তি। চীনের অর্থনীতি এখন ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। এই অর্থনীতি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এটা সবাই স্বীকার করেন। ভারতের অর্থনীতিও কম শক্তিশালী নয়। বিশ্বের চারটি বড় অর্থনীতির একটি হচ্ছে ভারত। ভারত বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব রাখছে। ওবামা নিজে ২০১০ সালে তার ভারত সফরের সময় ভারতকে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হিসেবে দেখার প্রস্তাব করেছিলেন। ফলে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে। আগামী দিনের যে বিশ্বব্যবস্থা, তাতে অর্থনীতি একটা বড় ফ্যাক্টর। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়লেও বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবেই। আপাতত এই দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে না বটে। কিন্তু আগামীতে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাবে। তাই শি জিন পিং যখন 'সিল্ক রুট'-এর কথা বলেন, কিংবা মোদি যখন 'ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোর'-এর প্রস্তাব করেন, তখন আমাদের বুঝতে হবে উভয়ের স্বার্থ অভিন্ন। বাজার দখল নিয়ে অচিরেই এই দুই শক্তি একটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো 'যুদ্ধ' হয়তো হবে না। কিন্তু এক ধরনের 'স্নায়ুগত প্রতিযোগিতা' থেকে যাবে। আর এই 'প্রতিযোগিতা'কে যুক্তরাষ্ট্র নিজের কাজে কতটুকু লাগাবে সেটাই এখন দেখার বিষয় । Daily Jai Jai Din 15.10.14

0 comments:

Post a Comment