চীনা
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি ভারত সফর শেষ করেছেন। অনেক কারণে এই সফরের
গুরুত্ব রয়েছে। এটি প্রেসিডেন্ট শি জিনের প্রথম ভারত সফর। তবে এর আগে
ব্রাজিলে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি নয়াদিল্লি
না নেমে সরাসরি গিয়ে নামলেন গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদে। মোদি তাকে নিজে
গ্রহণ করলেন। এটিও একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। তৃতীয়ত, শি জিনের ভারত সফরের
পরই ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত থেকে চীন তাদের সেনা প্রত্যাহার শুরু
করেছে। চতুর্থত, এই সফরের মধ্যে দিয়ে চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি দিক
উন্মোচিত এবং চীন যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, এটি প্রমাণিত
হলো। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন ও বোঝেন, তারা
জানেনÑ ওবামা প্রশাসন সম্প্রতি চীনবিরোধী বেশকিছু কর্মসূচি নিয়েছে। এমনকি
চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে
যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তার সামরিক তৎপরতা
সম্প্রসারিত করেছে ভারত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ
ফ্রিগেটের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হবে। পূর্ব চীন সফরভুক্ত বেশ কয়েকটি
বিতর্কিত দ্বীপ রয়েছে। সে দ্বীপগুলোর মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে জাপান ও
ফিলিপাইনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এখন এ অঞ্চলে মার্কিন নৌসেনা মোতায়েনের অর্থ
হচ্ছে, চীনের ওপর পরোক্ষভাবে ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে
চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীন এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’নীতি গ্রহণ
করেছে (বন্দর স্থাপনা, রিফুয়েলিং স্টেশন ইত্যাদি), এটিও ভালো চোখে দেখছে
না যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ খর্ব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত
অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেলের রিজার্ভের ৬০ শতাংশ এবং গ্যাস রিজার্ভের তিন
ভাগের এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। এই
দ্বন্দ্বে চীনের প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনের। ‘প্রিমরভ ডকট্রিন’
অনুযায়ী এ অঞ্চলে মস্কো, তেহরান, বেইজিং ও কলম্বোর মধ্যে যে ‘ঐক্য’ গড়ে
উঠেছেÑ সেটিকে দৃঢ় করতেই শিং জিনপিংয়ের ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। এর আগে
তিনি মস্কো গেছেন। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি যে বক্তব্য
রাখেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য
দেশের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেনÑ যা কি না
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। চীনা রাষ্ট্রপ্রধান দুই মাস আগে
ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও
চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকাও ব্রিকসের অন্যতম শক্তি। ব্রিকস বিশ্বের
অন্যতম অর্থনৈতিক জোট। ২০৫০ সাল নাগাদ ব্রিকস দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ
গিয়ে দাঁড়াবে ১২৮ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (এখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
থাকবে ৩৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে)। একই সময় ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে
আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক ৩৪০ মিলিয়ন ডলার (২০১২) থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৫০০
মিলিয়নে। প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো গিয়ে শি জিনপিং রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো
সম্পর্ককে ঝালাই করে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি
প্রমাণ করলেন, চীন নতুন অর্থনৈতিক জোটকেও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনের
প্রেসিডেন্টের জন্য ভারত সফর গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, চীনের নয়া নেতৃত্ব
ন্যূনতম ১০ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনকে বিশ্ব আসরে নেতৃত্ব দেবে।
সুতরাং চীনের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার দরকার আছে। চীন বিশ্বের
দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায়
চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২
শতাংশ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ), সেখানে বলা হচ্ছেÑ ২০১৬ সালে চচচ-এর
(চঁৎপযধংরহম, চৎরপব, চধৎরঃু) হিসাব অনুযায়ী চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের
অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদনশীল পণ্যের, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যের
দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা
উৎপাদিত হয়, এর ৩ ভাগের ২ ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সেই সঙ্গে বিশ্বে
উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০, ডিভিডির ৫৫, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০, পারসোনাল
কম্পিউটারের ৩০, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০, শিশুদের খেলনার ৭৫ শতাংশ চীন একা
উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। চীনে
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে। ‘ফরচুন’
ম্যাগাজিন বিশ্বের যে বড় ৫০০ কোম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে চীনের
রয়েছে ৩৭টি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, এর মধ্যে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত
হয় ১৬ শতাংশ। আর বিশ্ব জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ
ব্যবহার করে চীন। এ কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ হিসেবে
উল্লেখ করা হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে চীনে ক্যানসারে মৃত্যুর হার বেড়েছে
শতকরা ২৯ ভাগ। চীনে রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম। তারা আধুনিক শিক্ষায়
শিক্ষিত। প্রতি বছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হন। আর প্রতি
বছর ৩ লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যান। তারা ফিরেও আসেন।
১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল
মাত্র ২০ শতাংশ, এখন সেখানে শতভাগ শিক্ষিত। অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য চীনে
যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, এতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি
দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ ডলার আয়
হিসেবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে। অবশ্য বলা হয়, এখনো প্রায়
২০৭ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি চীনে একদিকে যেমন ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি
করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম
থেকে শহরে আসছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম
আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি
হয়েছে। তা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে
খারাপ খবর আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে
তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতি ৩ দশমিক ৫ শতংাশ কম।
আর শহরে বেকারে সংখ্যা ৪ থেকে ৬ শতাংশের নিচে। এই যে চীন, ওই চীনের
নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি জিনপিংয়ের ঘাড়ে। কোন পথে এখন
চীন? তার এজেন্ডায় রাশিয়া ও ভারত প্রাধান্য পেলেও এটি সত্য, অভ্যন্তরীণ
ইস্যুটি গুরুত্ব দিতে হবে। বেশকিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা
হচ্ছে শি জিনপিং এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর
দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২টি
প্রদেশ, ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪টি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা
নিয়ে যে চীন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে ওই রাষ্ট্রটি ভেঙেও যেতে
পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে
ভুল করেছিলেন গরভাচেভ, সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনো
পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো
তুলনামূলক বিচারে অনেক সমৃদ্ধশালী। প্রদেশে প্রদেশে যে বৈষম্য, গ্রাম আর
শহরের মধ্যে যে পার্থক্যÑ তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে শি জিনপিং
প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর বয়স্ক মানুষের পেনশন-ভাতা নিশ্চিত,
পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, অসমতা ও দরিদ্রতা দূর করা। এটি হবে প্রেসিডেন্টের
প্রধান কাজ। দুর্নীতির বিষয়টিও তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। পার্টির
সিনিয়র নেতাদের ব্যাপক দুর্নীতি এখন চীন ও পশ্চিমা বিশ্বে আলোচনার অন্যতম
বিষয়। অভিযোগ আছে, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও ২ দশমিক ৭
মিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এ সংক্রান্ত একটি
প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তা ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। অভিযোগে বলা হয়েছিল,
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে একটি কোম্পানির ১২০ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার
আছে। খোদ সাবেক প্রেসিডেন্টও অভিযুক্ত! যুক্তরাষ্ট্রের সুমবার্গ গ্রুপের
মতে, শি পরিবার ৩৭৬ মিলিয়ন ডলারের মালিক। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে এ
ধরনের অভিযোগ নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। একুশ শতকে আমরা
চীনকে দেখব অন্যতম শক্তি হিসেবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের
উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকসে চীন ও ভারত
অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার ওই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং
অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর
৩৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করলেও আগামী ৩০ বছরের মধ্যে
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এখন সাধারণ মানুষের
মাথাপিছু আয় ৯৪০ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। ২০০৭ সালে যেখানে বিশ্ব
অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতাংশ, সেখানে তখন অবদান রাখবে ১৭
শতাংশ। সুতরাং ভারতকে ফেলে দেওয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক (জনাথন
হোলসলাগ, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একটি সম্ভাব্য ঈযরহফরধ ধারণার কথা বলেছেনÑ
যেখানে চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এই ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক
সময়গুলোয় চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর
করেছেন। সীমান্ত সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের ‘স্থিতিবস্থা’ বিরাজ
করছে। ক্ষমতা গ্রহণ করে শি জিনপিং ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি। এখন
ভারত সফর করলেন। নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশি
নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। ২০১২ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি
বাংলাদেশে এসেছিলেন। বেগম জিয়াকে তিনি গত বছর বেইজিংয়ে সাক্ষাৎকার
দিয়েছিলেন। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী। আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বেইজিং সফর করেছেন। ওই সফরে চীনা
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধামন্ত্রীর সাক্ষাৎ হয়েছে এবং চীন
বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের আগ্রহের কথা আবার জানিয়েছে। ৬টি মেগাপ্রকল্পে চীন
আমাদের ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন
সফরের সময় ২০ দফা ইশতেহার প্রকাশিত এবং ৬টি দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে চায়Ñ এ ব্যাপারে চীনের
সহযোগিতা চেয়েছে এবং চীন এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে। চার দেশীয়
একটি ইকোনমিক করিডোর গড়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহকে চীন শুধু সমর্থনই
করেনি, বরং এ জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিসিআইএম নামে ওই অর্থনৈতিক জোটে ভারতের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, চীনের ইউনান প্রদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও
মিয়ানমারও রয়েছে। সুতরাং চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও
একটি ফ্যাক্টর। এ অঞ্চলের নিয়ে মার্কিনি স্বার্থের ব্যাপারে চীন পুরোপুরি
সজাগ। চীনা নেতৃত্ব ভালো করে জানে, এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থকে নিউট্রাল
করতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক উন্নত করতে হবে।
পাকিস্তান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বরাবরই চীনের বন্ধু। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
অতটা উষ্ণ ছিল না। এখন শি জিনপিংয়ের সফরের পর বরফ গলতে শুরু করেছে। চীনের
বড় ভয় যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেশ দুটি
বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যে ঞৎধহং ঢ়ধপরভরপ ঢ়ধহঃহবৎংযরঢ়-এর
কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে জটিলতা তৈরি করতে
পারে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক
(বিশেষ করে নৌবাহিনীর উপস্থিতি) উপস্থিতি বাড়িয়েছে (বাংলাদেশ এই
স্ট্র্যাটেজির আওতায়)। ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল এবং ভারত মহাসাগরে চীনের
উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলংকা, চীন, ইরান ও
রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে (প্রিমাকভ ডকট্রিন), তা
মার্কিন স্বার্থকেও আঘাত করছে। বেশ কিছুদিন আগে ওবামা বলেছিলেন, ইরান আগামী
এক দশকের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে
যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির মূল কারণ দুটিÑ একদিকে ইরাকের উলম্ফনকে
চ্যালেঞ্জ করা, অন্যদিকে ধীরে ধীরে চীন ঘিরে ফেলা। অনেকটা দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার যে নীতি
(ফনটেইনমেন্ট থিউরি) যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল, এর মতো। যুক্তরাষ্ট্রের এই
স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে শি জিনপিং অবগত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি
যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। তখন তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে
বলেছিলেন, ‘এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো কোনো ভালো
কূটনীতির পরিচয় দেয় না।’ এ বক্তব্য প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাটি
চীন ভালো চোখে দেখছে না। চীন অনেক বদলে গেছে। চীন এখন আর
মার্কসবাদী-মাওবাদী আদর্শে বিশ্বাসী রাষ্ট্র নয়। তবে মাওবাদকে তারা
পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে, তাও বলা যাবে না। জীবনযাত্রার মানের উন্নতি,
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাদের কাছে এখন প্রাধান্য। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ঘবড়
অঁঃযড়ৎর ঞধৎরধহরংস নেতৃত্ব, লাতিন আমেরিকার ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরংস এবং পশ্চিম ইউরোপের
ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু-এর সমন্বয়ে চীন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে।
এই রাজনীতি থেকে ফেরার আর পথ নেই। তাই শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে
থাকবে সারা বিশ্ব। তিনি চীনে আরও সংস্কার আনেন কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন
এখন।
Daily Amader Somoy
30.09.14
0 comments:
Post a Comment