রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদির ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অতিসম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করার মতো। এক. চীনের প্রেসিডেন্ট শিজেন পিং-এর ভারত সফর এবং দুই. প্রধানমন্ত্রী মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য দুটি ঘটনাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বটি আরো বেড়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নম্বরে অবস্থান নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে এশিয়া। এশিয়ার তিনটি দেশ চীন, ভারত ও জাপানের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ভর করবে। এমনি এক পরিস্থিতিতে খোদ চীনা প্রেসিডেন্ট ভারতে আসেন, তখন বুুঝতে হবে চীন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এখন ভারত চীনের সঙ্গে এই সম্পর্ককে কিভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে? কিংবা ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার কৌশলগত সামরিক সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে? এখানে মোদির ‘এপ্রোচ’ দেখে বোঝা যায় ভারত দুটি বড় শক্তির ব্যাপারে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ভারত চীনকে বাদ দিয়ে যেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সাইড লাইন’ এ ঠেলে দিচ্ছে না। উভয় দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের প্রশ্নে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। মোদি নিজে একটি বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি চীনের যেমনি বিনিয়োগ চান, তেমনি চান মার্কিনি বিনিয়োগও। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর ও ‘গ্রিন এনার্জি’র সম্প্রসারণের ব্যাপারে মোদির স্বার্থ অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে মোদির মতো ওবামাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি দেশের সম্পর্কের বিষয়ে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে চীনা নেতারা এক ধরনের অস্বস্তিতে আছেন। এটা এখন প্রমাণিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলনের পেছনে মদত দিচ্ছে। ফলে আগামীতে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। চীনে সরকারের পতন ঘটানো কিংবা চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিনি উদ্যোগের ব্যাপারে মোদি সরকার কতটুকু সায় দেবেন, এদিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ফলে এই তিন সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই পর্যবেক্ষণ তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মাঝে আলোচিত হতে থাকবে। উভয় শক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই ‘ব্রিকস’র সদস্য। ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় একই সময় তিনি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাও সফর করেছেন। এই দুটি দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি পাকিস্তানে যাননি বটে, কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এমতাবস্থায় এটা বোঝা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না তা নয়। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ‘দূরত্ব’ কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরো বেশ কিছুদিনের জন্য মার্কিন সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্ভাব্য একটি ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হবে। এটা অনেকেই জানেন যে, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। আফগানিস্তানের আবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যত দূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরো বড় কোনো কর্মসূচি নেন কি-না, সেটাই দেখার বিষয়।
ফলে ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা শীর্ষ বৈঠক যে অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছর মেয়াদি যে সহযোগিতা চুক্তি তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দু’দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দু’দেশের মনোভাব এক ও অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমির, আহমেদাবাদ শহর আর ভিজাগাপট্রস সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। সে সঙ্গে ভারতের ছোট ৫০০ শহরে ‘সোলার এনার্জি’ চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি খাতে এখানে বিনিয়োগ বাড়বে। সন্ত্রাস দমনেরও দু’দেশের মনোভাব এক। লস্কার-ই তৈয়্যেবা, জইস-ই মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এসব জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দু’দেশ কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারেও দু’দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’র আগ্রাসন রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক একটি এলায়েন্স গঠিত হয়েছে, ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত সেই এলায়েন্সে যোগ দিক। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ ঝুঁকির মুখে। আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এই শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’র উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত তাতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বীর এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো, তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যার অধিকাংশই মুসলমান। মার্কিনি চাপ উপেক্ষা করে যে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন আর তা হচ্ছে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পৌঁছে যেতে পারে। ভারত এ ক্ষেত্রে একটি ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এই ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিনি স্বার্থে সবসময় কাজ করে না, এটা আবারো প্রমাণিত হলো। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। শুধু জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি, একটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারেও মোদি কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করেননি। মুক্তবাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন-এমন অভিমত ভারতের নীতি-নির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনো উপনীত হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। টিপিটিতে ভারতের অংশগ্রহণ না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কেননা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, এতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। মোদি নিজে এই সময়কে একটি ‘নতুন ডাইমেনশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এটা সত্য ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরের সময় তার ওই সফর যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছিল মোদির এই সফর তুলনামূলক বিচারে কম গুরুত্ব পেয়েছে। তবে মোদিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওবামা এই মেসেজটি দিতে চেয়েছেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে চান। অন্যদিকে হংকংয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চীনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা ঘটল এমন এক সময়, যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন এক নম্বর শক্তি। চীনের অর্থনীতি এখন ১৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। এই অর্থনীতি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে, এটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু এতে চীনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবি কি কমে আসবে? আজ যখন হংকংয়ে আরো বেশি গণতন্ত্রের দাবি উঠেছে, তখন চীনেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিও জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিল ক্লিনটন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে এসে একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন জীবদ্দশায় চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা তিনি দেখে যেতে চান। চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এ ধরনের স্বপ্ন কেউ কেউ দেখেন বটে, কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। চীনের সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর সঙ্গে পশ্চিমা সমাজের কোনো মিল নেই। ফলে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, পশ্চিমা সমাজের কারো কারো এই চিন্তাধারা নিয়ে প্রশ্নই থেকে যাবে শুধু। অতিসম্প্রতি হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, তখন নতুন করে চীনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আবারো উঠল। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা অনেকেই করেন না, তা হচ্ছে হংকং আর চীন এক নয়। হংকং তার পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো নিয়েই চীনের সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল। আর চীন বিশ্ব রাজনীতিতে ১৯৪৯ সালে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ২০১৪ সালে এসে চীনকে আর পুরোপুরি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। সেখানে সমাজতন্ত্র আর বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আর পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বোধকরি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং হংকংয়ের এই আন্দোলন কি আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর? গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা এতে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে। তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরো কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন।  প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেনঝেন কিংবা গুয়াংঝো এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না; বরং শেনঝেন কিংবা গুয়াংঝোর মতো এলাকায় ‘নতুন অর্থনৈতিক জোন’ গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের একমাত্র বড় অর্থনীতি। ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি ‘মার্কিনি ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি ও তার পলিট ব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধী একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন। তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার।এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতারা উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্তও নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুক্কায়িত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনো পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি ‘সিঙ্গাপুর মডেল’র জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদি মার্কসবাদ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকংয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।মোদি সরকার এ বিষয়টি বোঝে। তাই এই সরকার চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ভারত উভয় শক্তির সঙ্গেই একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বাজায় রাখছে। এখানেই ভারতের স্বার্থ নিহিত। অদূর ভবিষ্যতে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ কোনো মার্কিনি পরিকল্পনায় ভারত কোনো অংশ হবে না এটাই কাম্য। মোদির মূল টার্গেট হচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর এ জন্য তার যেমনি প্রয়োজন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার, ঠিক তেমনি তার প্রয়োজন রয়েছে চীনা বিনিয়োগ। তাই মোদি এক ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। ১২ অক্টোবর, ২০১৪; ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Manonkontho 16 October 2014

0 comments:

Post a Comment