রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সদ্য শেষ হওয়া পরিবেশ সম্মেলনে বাংলাদেশ কী পেল

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনের আগে পরিবেশসংক্রান্ত একটি বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাংলাদেশসহ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য সহায়তা বাড়াতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি তিনি আহ্বান জানান। বান কি মুন যে সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে নেগোসিয়েশনের কোনো সুযোগ ছিল না। এখানে দেশগুলোকে বলতে হয়েছে তারা জলবায়ু মোকাবেলায় কী ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন দেশে ইতোমধ্যে ৩২ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের পাশাপাশি ১৫ লাখ পরিবেশবান্ধব চুলা বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ দুর্যোগসহনীয় শস্য উৎপাদনও করছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে একটি সাত দফা কর্মসূচিও উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ উৎকণ্ঠার পরও উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। ফলে এ ধরনের সম্মেলন আরো একবার বিতর্কিত হলো। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর টর্নেডো এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপাারে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি বড় বড় শহরও আক্রান্ত হচ্ছে। সারাবিশ্বই আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। বায়ুম-লে গ্রিন হাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ফলে সাগর, মহাসাগরে জন্ম হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, যা একসময় প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে উপকূলে। ধ্বংস করে দিচ্ছে জনপদ। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপকূলবর্তী গ্রাম, ছোট ছোট শহর। 'মহাসেন' ছিল সেরকম একটি ঘূর্ণিঝড়। এর আগে আমরা 'সিডর' ও 'আইলার' সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সমুদ্রসৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে নামকরণের সুযোগ পায় ভারত মহাসাগরভুক্ত আটটি দেশ। প্রতিটি দেশকে চারটি করে নাম পাঠাতে হয়। এর মধ্য থেকে একটি নাম বেছে নেয়া হয়। একসময়ের শ্রীলংকার রাজা মহাসেন ধ্বংস করেছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির, সে কারণে ধ্বংসাত্মক ঝড়ের নাম রাখা হয়েছিল ধ্বংসের প্রতীক সেই নাম মহাসেনের নামে। এদিকে, এ অঞ্চলে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হবে থাইল্যান্ডের দেয়া নামে। আর এর নাম হবে 'ফাইলিন'। মহাসেনের পর এখন ফাইলিনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অতিবন্যা, অসময়ে বন্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা জানেন সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা বিপুল পানির স্রোত বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে দিয়েছে। দেশের ১৭টি জেলা এ বন্যায় আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অকাল বন্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে এ জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে হিমালয়ে। সেখানে বরফ গলছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায়ও পরিবর্তন আসছে। অসময়ের বৃষ্টি প্রমাণ করে পরিবেশ কিভাবে বদলে যাচ্ছে। যে সময়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা, সে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। শীতের ব্যাপ্তি কমেছে। মনে আছে গেল শীত আসতে আসতেই চলে গেল। এর ফলে বৃষ্টিতে সমস্যা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ লড়াকু। 'সিডর' ও 'আইলার' পর তারা বুঝে গেছে এ ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গেই তাদের বসবাস করতে হবে। লোনা পানি তাদের জীবনযাত্রার মান হুমকির মুখে ঠেলে দিলেও এ লোনা পানির সঙ্গে 'যুদ্ধ' করেই তারা বেঁচে আছে। প্রকৃতিই তাদের শিখিয়েছে কিভাবে সব ধরনের প্রতিকূলতার সঙ্গে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। উপকূল এলাকার মানুষ আগের চেয়ে আজ অনেক সচেতন। সারাবিশ্ব জানে বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হবে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (ঈযৎরংঃরধহ চবহবহঃর) তার সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ পযধড়ং; ঈষরসধঃব পযধহমব ধহফ ঃযব হব িমবড়মৎধঢ়যু ড়ভ ঠরড়ষবহপব (২০১১)-এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরো উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আই পিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সেখানে। তা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পরপর দুবার বন্যা ও পরে 'সিডর'-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে 'আইলা'। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বার বার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও, সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ১৭টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি মানুষ। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকার। 'সিডর' ও 'আইলা'র পর 'মহাসেন' বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব না কোনো দিনই। 'সিডর ও 'আইলা'র আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ জলজ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ লোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির গড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর 'মহাসেন' আমাদের আবারো ক্ষতিগ্রস্ত করে গেল। আর এখন অকাল বন্যা। আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেন (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি। বলা ভালো, বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এজন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। অতিসম্প্রতি যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। কিন্তু সিডর ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল সে ক্ষতি সারাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে (কালের কণ্ঠ)। ভাবতে অবাক লাগে, যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, সাগরের আঘাত বেশি আর মানুষ 'যুদ্ধ' করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে, কিংবা নীলফামারীর তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ুসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি 'রাজনীতি' ঢুকে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। তবে উন্নত বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে আগামী বছরের শেষ দিকে প্যারিসে যে 'কপ' (কমিটি অন দ্য পার্টিজ) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে তাতে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। Daily JAI JAI DIN 30 September 2014

0 comments:

Post a Comment