যুক্তরাজ্য
থেকে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্কটিশরা
স্বাধীন না হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য
ইউনিয়নের সঙ্গে রয়ে গেল বটে, কিন্তু এর রেশ গিয়ে লেগেছে পৃথিবীর অন্যত্র।
পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন জাতীয়তাবাদী নেতা সেখানেও
গণভোটের ডাক দিয়েছেন। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নতুন নয়।
সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। এ অঞ্চলের ব্যাপারে
যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। বেলুচিস্তানে অবস্থিত একটি বিমান
ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করত, যা পরে পাকিস্তান বন্ধ করে দেয়। এই
অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টদের কাছে আরও
বাড়িয়ে দিয়েছে।ঐতিহাসিকভাবেই বেলুচিস্তান বিভক্ত। এর এক অংশ
পাকিস্তানে, অপর অংশ ইরানে, যা ইরানের একটি প্রদেশ। এটি সিসতান বেলুচিস্তান
নামে ইরানে পরিচিত। বেলুচিস্তানের দক্ষিণে রয়েছে আরব সাগর, আর উত্তরে
আফগানিস্তান। বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে এবং
আফগানিস্তানের তালেবানদের আশ্রয়স্থলও রয়েছে এখানে। ইরানের পারমাণবিক
কর্মসূচি এবং ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে
বেলুচিস্তানের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। চীনেরও উপস্থিতি রয়েছে বেলুচিস্তানে।
ভারতেরও আগ্রহ রয়েছে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে। আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী
প্রত্যাহারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যখন তার পরিকল্পনার ছক কাটছে, তখন
বেলুচিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন আগ্রহ নতুন করে এ অঞ্চল ঘিরে
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সামনে নিয়ে এসেছে।বেলুচিস্তানে পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা,
বেলুচিস্তানের দুই নেতা ওয়াহিদ বালুচ ও মুনির মেঙ্গল ২০১০ সালের নভেম্বরের
প্রথম সপ্তাহে দিল্লি সফর করেছিলেন। এ দুই নেতা ফ্রান্স থেকে ভারতে
এসেছিলেন। উদ্দেশ্য, স্বাধীন বেলুচিস্তানের ব্যাপারে ভারতের সাহায্য ও
সহযোগিতা নিশ্চিত করা। তারা দিল্লিতে এসে এ কথাও বলেছিলেন, গত ৬২ বছর ধরে
পাকিস্তান বেআইনিভাবে বেলুচিস্তান জবরদখল করে রেখেছে। পাকিস্তানের
সেনাবাহিনী বেলুচিস্তানকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে- এ অভিযোগও করেছেন এ
দুই নেতা। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ঢাকার সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছিল তখন।
একটি জাতীয় দৈনিকের (২০১০) নিজস্ব প্রতিবেদক কলকাতা থেকে এ প্রতিবেদনটি
পাঠিয়েছিলেন গত ৯ নভেম্বর। ওয়াহিদ বালুচ ও মুনির মেঙ্গলকে নয়াদিল্লিতে আসতে
দেয়া এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়ায় নতুন করে তখন
পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে,
বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। ওয়াহিদ ও
মুনিরের দিল্লি সফরের পর পাকিস্তানের অভিযোগ আরও শক্ত হয়েছিল।বেলুচিস্তানের
ব্যাপারে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর আগ্রহের অন্যতম কারণ এ অঞ্চলের
গ্যাস সম্পদ। বেলুচিস্তানের সুই গ্যাস দিয়ে পাকিস্তানের জ্বালানি চাহিদা
মেটানো হয়। কিন্তু এ অঞ্চল বরাবরই অবহেলিত। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে লাগেনি।
২০০১ সালে গঠিত হয় বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। এর নেতৃত্বে আছেন বেলুচ
মারি, যিনি একসময় মস্কোতে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৫ সালে তারা সুই
গ্যাসকেন্দ্রে হামলা চালালে তাদের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে তারা
আলোচনায় আছেন। ইরানের সিসতান বেলুচিস্তানেও জুনদুল্লাহর নেতৃত্বে
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে।বেলুচিস্তানের অবস্থান আরব সাগর ঘেঁষে। এ
কারণে স্থানটির প্রতি একদিকে যেমন আগ্রহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, তেমনি
আগ্রহ রয়েছে চীনের। অন্যদিকে ভারতের আগ্রহেরও কমতি নেই। এখানে ভারত ও
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। এ অঞ্চলকে যদি
নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় অথবা যদি বিচ্ছিন্নতা উসকে দেয়া যায়, তাহলে তা থেকে
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ফায়দা লুটতে পারবে। আফগানিস্তানের একটি সীমান্ত
রয়েছে বেলুচিস্তানের সঙ্গে। আফগান তালেবানরা এই সীমান্ত অতিক্রম করে
বেলুচিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছে- এ অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের, যে কারণে
বেলুচিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রম রয়েছে। পাকিস্তানের
পরিস্থিতি ভালো নয়। পাকিস্তানি তালেবানরা এখন পাকিস্তানের ভেতরেই আত্মঘাতী
বোমা হামলা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের সেনা অভিযানের ফলে
তালেবানরা যদি সেখান থেকে উৎখাত হয়, তাহলে বেলুচিস্তান হবে
তালেবানদের-পরবর্তী অভয়ারণ্য। সেক্ষেত্রে ২০০১ সালের অক্টোবরে যেমন বোমা
হামলা চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তেমনটি আবারও ঘটতে
পারে বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রে। এ অঞ্চলে আরব সাগর ঘেঁষা গাওদার একটি
সমুদ্রবন্দর। এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। বন্দরটি তৈরি করে দিচ্ছে
চীন, যেখানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার। চীন মুক্তার মালা বা
string of pearls-এর যে নীতি গ্রহণ করেছে, সেক্ষেত্রে গাওদার একটি বড়
ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর
অতিক্রম করে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্র পথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়
চীন। কারণ এ পথ তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর।
গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিট থাকবে, যেখান থেকে ভারত মহাসাগরের
সব ধরনের নৌ-মুভমেন্ট লক্ষ্য করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও আগ্রহ রয়েছে
গাওদারের ব্যাপারে। ইরানের সীমান্ত থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে গাওদার।
আর হরমুজ প্রণালী থেকে দূরত্ব মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই
মধ্যপ্রাচ্যের তেল পশ্চিম ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করা হয়।
ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ডের সদস্যরা যে কোনো সময়ে এই হরমুজ প্রণালীতে
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভবিষ্যতে ইরানের বিরুদ্ধে যদি কোনো
নৌ-অবরোধ সৃষ্টি করতে হয়(?) তাহলে গাওদার বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করবে। চীন তার পূর্বাঞ্চলে ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার
বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। এ ব্যাপারে একটি
মহাপরিকল্পনাও তারা প্রণয়ন করছে। সুতরাং সঙ্গত কারণেই বেলুচিস্তান আগামী
দিনগুলোতে উত্তপ্ত থাকবে। এবং বৃহৎ তথা কোনো কোনো আঞ্চলিক শক্তির কাছে
স্বাধীন একটি বেলুচিস্তান রাষ্ট্র(?) আকর্ষণীয়। ২০০১ সালের জুলাইয়ে জেনস
ইনফরমেশন গ্রুপ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বেলুচিস্তানে ভারতীয়
গোয়েন্দা সংস্থা র ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যথেষ্ট তৎপর।
ইরানি প্রদেশ সিসতান বেলুচিস্তান ছিল বরাবরই শান্ত ও স্থিতিশীল। ইতিহাসের কিংবদন্তি বীর রুস্তমের জন্ম এখানে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ আলী সিসতানির জন্ম ও এখানে। সিসতান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ভাষা ও ধর্ম এক, তবে স্থানীয় ডায়ালেক্টে তারা কথা বলেন। বেলুচিস্তানের যে অংশ ইরানের সঙ্গে ছিল, তা একসময় যুক্ত ছিল ইরানের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের প্রদেশের সঙ্গে। কিন্তু রেজা শাহ ১৯৫৯ সালে সিসতানকে আলাদা প্রদেশ করেন। জুনদুল্লাহরা তাদের আন্দোলনকে বেলুচিস্তানে সম্প্রসারিত করছে। তাদের যুক্তি, বেলুচি ও পারস্ত্রীয়রা এক নন। তারা মনে করেন, পারস্ত্রীয়রা ইরানি হলেও সব ইরানি পারস্ত্রীয় নন। ইরানিদের মাঝে আজারি, বেলুচিরা রয়েছেন। সিসতানের ব্যাপারে দ্বন্দ্ব মূলত পারস্ত্রীয়দের সঙ্গে বেলুচিদের। এই দ্বন্দ্বটাকে জুনদুল্লাহ কাজে লাগাতে চায়। তারা সিসতানকে ইরান থেকে আলাদা করতে চায়। তবে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান গড়ার ডাক তারা দেয়নি। ইরানের অভিযোগ, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র জুনদুল্লাহকে প্রমোট করছে। জুনদুল্লাহর নেতা আবদুল মালেক রিগি একসময় তালেবানদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানিতে তার ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। জুনদুল্লাহরা সমর্থন পাচ্ছে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আনজুমান ই সিপাহ ই সাহাব ও লস্কর ই জানজাবি নামক দুটো সংগঠনের, যারা পাকিস্তানে শিয়া স্থাপনার ওপর একাধিকবার আক্রমণ চালিয়েছে।পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তান ও ইরানের প্রদেশ সিসতানের সমস্যা এক নয়। উভয় অঞ্চলের মানুষের মিল এক জায়গায়- তারা বেলুচি এবং উভয় অঞ্চলেই উন্নয়ন হয়নি। এ কারণে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা অর্থাৎ বেলুচিরা ক্রমেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। অন্য প্রদেশ থেকে মানুষ এসে সেখানে বসবাস করছে। অন্যদিকে সিসতানের সমস্যাটা মূলত অনুন্নয়ন। বেলুচিস্তান নিয়ে সমস্যা মূলত দুটি। এক. আফগানিস্তানের পশতুনরা আর বেলুচিস্তানের পাঠানরা এক হয়ে ভবিষ্যতে একটি পশতু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে একদিন এ অঞ্চলে জন্ম হবে তালেবানমুক্ত পশতু রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকবে এর ব্যাপারে। দুই. ইরান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান মিলে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যদি কোনো ধরনের সহাবস্থান না হয়, তাহলে এই গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। পাকিস্তানে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির কথা আগেই বলেছি। এছাড়া রয়েছে বেলুচিস্তান পিপলস ফ্রন্ট, যাদের
নেতৃত্বে গ্রেটার বেলুচিস্তান আন্দোলন শুরু হতে পারে।পাঠক, নব্বইয়ের দশকের সাবেক যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের কথা স্মরণ করতে পারেন। সার্বদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে একে একে স্বাধীন হয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া (১৯৯১), বসনিয়া-হারজেগোভিনা (১৯৯২)। এরপর স্বাধীন হয়েছে মন্টিনেগ্রো, মেসিডোনিয়া ও পূর্ণ স্বাধীনতার পথে রয়েছে কসোভো। বলকানাইজেশনের প্রক্রিয়া ইরানেও আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি আগামীতে। ইরান ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে সফট ওয়ার শুরু করেছে, তার উদ্দেশ্য একটাই- ইরানকে খণ্ডবিখণ্ড করা। বেলুচিস্তান দিয়েই(?) এ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে অভিন্ন। ভারতের যে বিপুল জ্বালানি চাহিদা, তা দেশটি মেটাবে দুটি পাইপলাইনের মাধ্যমে। এক. ইরান থেকে বেলুচিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (আসালুইয়ে-বন্দর আব্বাস-ইরানশহর-খুজদার-সুই-মুলতান-নয়াদিল্লি)। দুই. তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (দুজুলেবাদ-হেরাত-কান্দাহার-কোয়েটা-মুলতান-ফাজিলকা-নয়াদিল্লি, ঞঅচও প্রজেক্ট)। বেলুচিস্তান ভারতের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই দুটি প্রজেক্টের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।তাই বেলুচিস্তানের ঘটনাবলী যে আগামীতে বারবার আলোচিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্কটল্যান্ডের গণভোটের ঘটনা বেলুচিদের উৎসাহিত করেছে। তাদের দাবি, গণভোট হলে স্বাধীন বেলুচিস্তানের পক্ষেই ভোট দেবে বেলুচিরা। কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকে তারা দীর্ঘদিন বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে পাকিস্তানের অন্যত্র উন্নয়ন হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেলুচিস্তান রয়ে যাচ্ছে অবহেলিত। বেলুচিদের অনেকে বেলুচিস্তানের পরিস্থিতিকে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। তবে স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়েছে। কিন্তু বেলুচিস্তানে গণভোট হবে, এটা প্রত্যাশা করা যায় না। পাক সেনাবাহিনীতা কখনও চাইবে না। তবে একটি আওয়াজ তো উঠল। Daily Jugantor 03.10.14
ইরানি প্রদেশ সিসতান বেলুচিস্তান ছিল বরাবরই শান্ত ও স্থিতিশীল। ইতিহাসের কিংবদন্তি বীর রুস্তমের জন্ম এখানে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ আলী সিসতানির জন্ম ও এখানে। সিসতান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ভাষা ও ধর্ম এক, তবে স্থানীয় ডায়ালেক্টে তারা কথা বলেন। বেলুচিস্তানের যে অংশ ইরানের সঙ্গে ছিল, তা একসময় যুক্ত ছিল ইরানের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের প্রদেশের সঙ্গে। কিন্তু রেজা শাহ ১৯৫৯ সালে সিসতানকে আলাদা প্রদেশ করেন। জুনদুল্লাহরা তাদের আন্দোলনকে বেলুচিস্তানে সম্প্রসারিত করছে। তাদের যুক্তি, বেলুচি ও পারস্ত্রীয়রা এক নন। তারা মনে করেন, পারস্ত্রীয়রা ইরানি হলেও সব ইরানি পারস্ত্রীয় নন। ইরানিদের মাঝে আজারি, বেলুচিরা রয়েছেন। সিসতানের ব্যাপারে দ্বন্দ্ব মূলত পারস্ত্রীয়দের সঙ্গে বেলুচিদের। এই দ্বন্দ্বটাকে জুনদুল্লাহ কাজে লাগাতে চায়। তারা সিসতানকে ইরান থেকে আলাদা করতে চায়। তবে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান গড়ার ডাক তারা দেয়নি। ইরানের অভিযোগ, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র জুনদুল্লাহকে প্রমোট করছে। জুনদুল্লাহর নেতা আবদুল মালেক রিগি একসময় তালেবানদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানিতে তার ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। জুনদুল্লাহরা সমর্থন পাচ্ছে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আনজুমান ই সিপাহ ই সাহাব ও লস্কর ই জানজাবি নামক দুটো সংগঠনের, যারা পাকিস্তানে শিয়া স্থাপনার ওপর একাধিকবার আক্রমণ চালিয়েছে।পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তান ও ইরানের প্রদেশ সিসতানের সমস্যা এক নয়। উভয় অঞ্চলের মানুষের মিল এক জায়গায়- তারা বেলুচি এবং উভয় অঞ্চলেই উন্নয়ন হয়নি। এ কারণে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। পাকিস্তান অধ্যুষিত বেলুচিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা অর্থাৎ বেলুচিরা ক্রমেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। অন্য প্রদেশ থেকে মানুষ এসে সেখানে বসবাস করছে। অন্যদিকে সিসতানের সমস্যাটা মূলত অনুন্নয়ন। বেলুচিস্তান নিয়ে সমস্যা মূলত দুটি। এক. আফগানিস্তানের পশতুনরা আর বেলুচিস্তানের পাঠানরা এক হয়ে ভবিষ্যতে একটি পশতু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে একদিন এ অঞ্চলে জন্ম হবে তালেবানমুক্ত পশতু রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকবে এর ব্যাপারে। দুই. ইরান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান মিলে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যদি কোনো ধরনের সহাবস্থান না হয়, তাহলে এই গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। পাকিস্তানে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির কথা আগেই বলেছি। এছাড়া রয়েছে বেলুচিস্তান পিপলস ফ্রন্ট, যাদের
নেতৃত্বে গ্রেটার বেলুচিস্তান আন্দোলন শুরু হতে পারে।পাঠক, নব্বইয়ের দশকের সাবেক যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের কথা স্মরণ করতে পারেন। সার্বদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে একে একে স্বাধীন হয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া (১৯৯১), বসনিয়া-হারজেগোভিনা (১৯৯২)। এরপর স্বাধীন হয়েছে মন্টিনেগ্রো, মেসিডোনিয়া ও পূর্ণ স্বাধীনতার পথে রয়েছে কসোভো। বলকানাইজেশনের প্রক্রিয়া ইরানেও আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি আগামীতে। ইরান ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে সফট ওয়ার শুরু করেছে, তার উদ্দেশ্য একটাই- ইরানকে খণ্ডবিখণ্ড করা। বেলুচিস্তান দিয়েই(?) এ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে অভিন্ন। ভারতের যে বিপুল জ্বালানি চাহিদা, তা দেশটি মেটাবে দুটি পাইপলাইনের মাধ্যমে। এক. ইরান থেকে বেলুচিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (আসালুইয়ে-বন্দর আব্বাস-ইরানশহর-খুজদার-সুই-মুলতান-নয়াদিল্লি)। দুই. তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে নয়াদিল্লি (দুজুলেবাদ-হেরাত-কান্দাহার-কোয়েটা-মুলতান-ফাজিলকা-নয়াদিল্লি, ঞঅচও প্রজেক্ট)। বেলুচিস্তান ভারতের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই দুটি প্রজেক্টের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।তাই বেলুচিস্তানের ঘটনাবলী যে আগামীতে বারবার আলোচিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্কটল্যান্ডের গণভোটের ঘটনা বেলুচিদের উৎসাহিত করেছে। তাদের দাবি, গণভোট হলে স্বাধীন বেলুচিস্তানের পক্ষেই ভোট দেবে বেলুচিরা। কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকে তারা দীর্ঘদিন বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে পাকিস্তানের অন্যত্র উন্নয়ন হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেলুচিস্তান রয়ে যাচ্ছে অবহেলিত। বেলুচিদের অনেকে বেলুচিস্তানের পরিস্থিতিকে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। তবে স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়েছে। কিন্তু বেলুচিস্তানে গণভোট হবে, এটা প্রত্যাশা করা যায় না। পাক সেনাবাহিনীতা কখনও চাইবে না। তবে একটি আওয়াজ তো উঠল। Daily Jugantor 03.10.14
0 comments:
Post a Comment