গত ২০ অক্টোবর কানাডার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাস্টিন ট্রুডো এখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। জাস্টিনের বাবা পিয়েরে ট্রুডো ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মিয়ানমারের নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে শতকরা ৭৭ ভাগ ভোট পেয়ে অং সান সু চির নেতৃত্বে এনএলডি বিজয়ী হয়েছে। অং সান সু চি আগামী মার্চে হয়তো প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। তবে ধারণা করছি তিনিই হবেন সরকারের ‘মূল ব্যক্তি’। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে পরিবর্তন এনে তার সরকার ‘পরিচালনার’ পথ প্রশস্ত হতে পারে! সু চির বাবা অং সান ছিলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত না হলে তিনি হতেন স্বাধীনতাপরবর্তী মিয়ানমারের অন্যতম নেতা। আমাদের পাশের দেশ ভারতের বিহারের বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সংযুক্ত জনতা দল নেতা নিতিশ কুমার পঞ্চমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেও রাষ্ট্রীয় জনতা দল নেতা লালু প্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী প্রসাদ হয়েছেন বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী। ২৬ বছরের তেজস্বীর আরেক ভাই প্রতাপও সংসদ সদস্য। বিহারের ‘সুপ্রিমো’ লালু প্রসাদ তার ছেলেদের রাজনীতিতে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে ভারতের সর্বত্র যে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতির ধারা, সেই ধারাই অনুসরণ করলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এই পারিবারিক রাজনীতি বহমান। তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করলেও তিনিই বিএনপির মূল নেতা। আর বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনীতিতে অনেক আগেই নাম লিখিয়েছেন। জয় রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ার সাথে তিনি জড়িত। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি নির্বাচন পরিচালনা কর্মকা-ের সাথে জড়িত ছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি বিদেশি স্ত্রীসহ দেশে এসেছিলেন। ধারণা করছি, তিনি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত বিদেশে ও একই সাথে দেশে থাকবেন। স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনীতি দুটো পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একদিকে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিবার। অন্যদিকে রয়েছে জিয়া পরিবার। রাজনীতিতে পারিবারিক ধারা শুধু এই দুই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের ছেলে কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলেও বাবার পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছেন। তবে এটা বলতেই হবে, তাদের বাবারা যে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের শীর্ষপদটিতে আসীন হয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের সেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। একজন জিল্লুর রহমান কিংবা একজন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ একদিনে তৈরি হননি। তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের।
‘সোনার চামচ’ মুখে দিয়ে তারা মন্ত্রী হননি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে সাহায্য করেছিল।
শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভারতে নেহরু পরিবারের দৃষ্টান্ত দেই। কিন্তু ভারতের প্রতিটি রাজ্যে এই পারিবারিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কোথায় কোথাও (উড়িষ্যা, তামিলনাড়–) ব্যক্তির নামে দলের পরিচয়। পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা যে শুধু কংগ্রেসের মাঝে আছে তা নয়। বরং বিজেপি থেকে শুরু করে প্রতিটি আঞ্চলিক দলের মাঝেই আছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মাঝে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে না থাকলেও আছে। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি, আফ্রিকার অনেক দেশে এই প্রবণতা ব্যাপক। কোথাও কোথাও স্ত্রী, সন্তান, ভাই সবাই মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে আমি দেখেছি, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। তাদের সন্তানদের অনেকেই ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বীজ যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। নেহরু পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী পরিবার। নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু এক সময় (১৯২১) কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীলংকায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতাপরবর্তী শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বন্দরনায়েকে পরিবার। প্রথমে বাবা, পরে মা, তারপর নিজে কুমারা রানাতুঙ্গা শ্রীলংকার রাজনীতি পরিচালনা করে গেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে ও তার পরিবার এখনো শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। শ্রীলংকার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কেউ সেখানে হৈচৈ করে না। নেপালে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কৈরালা পরিবার শুধু নেপালের সরকার পরিচালনায়ই সম্পৃক্ত ছিল না, বরং নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্ব রয়েছে কৈরালা পরিবারের হাতে। এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচন্ড এ ধারা থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারেননি। তার মেয়ে এখন দলের তথা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও গাইয়ুমের (সাবেক প্রেসিডেন্ট) মেয়ে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরেও পরিবারতন্ত্র আছে। পাকিস্তানের কথা না হয় নাই-বা বললাম। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে আসছেন না, আসছেন তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ শরিফ। যিনি যুব মুসলিম লীগের সভাপতি।
ফিলিপাইনের দিকে তাকান। কোরাজন আকিনোর (সাবেক প্রেসিডেন্ট) ছেলে এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। বেনিগনো আকিনো সিনেট সদস্য থেকেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো না খারাপ? সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউর ছেলে লি শিয়েন লং যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতেই রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপাইনে কোরাজন আকিনোর ছেলের বেলায়Ñ একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছেÑ ঠধংঁফঁধ শঁঃঁসনরশধস. সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় 'ধষষ ঃযব টহরাবৎংব রং ধ ভধসরষু'. অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তারা শাসন করে। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশ কিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় চরণ সিং, দেবগৌড়া, সারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিন্ধিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পার্থক্য নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আলোচিত হচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্ম তার বক্তব্যে, তার আদর্শে আকৃষ্ট হচ্ছে। তিনি একুশ শতক উপযোগী নতুন এক বাংলাদেশ উপহার দিতে চাচ্ছেন।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মাঝে দোষের কিছু নেই। ভারতে এটা নিয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। তবে ভারতে পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র তথা যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি নিয়েছেন। এবং অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে রাজনীতিটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে পারিবারিক পরিচিতি তাদের নিজ নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। উত্তরপ্রদেশে ‘সুপ্রিমো’ মুলায়ম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ সিং যাদব এখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু অখিলেশ বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত একজন তরুণ রাজনীতিবিদ। এই তরুণ রাজনীতিবিদরা ভারতকে বদলে দেবেন। চিনের একটি দৃষ্টান্ত দেই। চিনকে এখন আর ধ্রুপদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে না। সেখানে সমাজতান্ত্রিক নীতিরীতি এখনো বহাল আছে। কমিউনিস্ট পার্টির একক কর্তৃত্ব এখনো আছে। তবে সুষ্ঠুভাবে দেখলে দেখা যাবে, সেখানে পরিবর্তন আসছে। পরিবারতন্ত্রের খবর আগে তেমন একটা ছিল না। কিন্তু এখন পরিবারতন্ত্রের খবর আমরা জানছি। বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান শি জিন পিংয়ের বাবা এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা ছিলেন। বাবার পথ ধরেই শি জিন পিংয়ের রাজনীতিতে আগমন। একই সাথে চিনে এখন ‘মেরিয়েট্রোক্রেসির’ বিকাশ ঘটেছে। যাদের মেধা আছে, আধুনিক মনস্ক তারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও এখন সরকারের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন। পার্টির নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে তরুণদের রিক্রুট করছেন, যা দশ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন শিক্ষকতার পেশায় থাকলেও এটাকে পেশা হিসেবে নেননি। রাজনীতিকে পেশা হিসেবেই নিয়েছিলেন। অং সন সু চি নিজে উচ্চশিক্ষিত। বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। সত্তর বছরে দাঁড়িয়েও তিনি তারুণ্যের প্রতীক। এই তারুণ্যই মিয়ানমারে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। এই তারুণ্যকে অস্বীকার করা যাবে না। এই তারুণ্যকে যারাই অবজ্ঞা করেছে তারাই হেরেছে। বিশ্বব্যাপী ট্রাডিশনাল নেতৃত্বে সর্বত্রই একটা পরিবর্তন আসছে। কেনেডি যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৬১-১৯৬৩) তখন মানুষ অবাক হয়েছে। একজন তরুণ প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকে সামলাতে পারবেন তো? তিনি পেরেছিলেন। যে কারণে আজও তাকে স্মরণ করা হয়। ওবামাও তরুণ বয়সে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একজন প্রেসিডেন্টের বয়স ৫০ বছরের কম হবে, এটা এক সময় অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু বাস্তবতা বলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সফল প্রেসিডেন্টের একজন হচ্ছেন ওবামা। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনও অনেক কম বয়সে যুক্তরাজ্যের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারুণের এই বিজয় রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনছে। এ কারণেই পারিবারিক রাজনীতির ধারায় তরুণ নেতৃত্ব যখন দেশে দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখনই মানুষ তা গ্রহণ করেছে। কানাডার ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্য ছিল, ঠিক তেমনি সত্য বলে প্রমাণিত হলো ভারতের সদ্য শেষ হওয়া বিহারের বিধানসভার নির্বাচনও।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নতুন কোনো ধারণা নয়। অতীতে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের এই ধারা উন্নয়নশীল বিশ্বে সক্রিয় থাকলেও উন্নত বিশ্বে তেমনটা লক্ষ করা যায়নি। এখন সেখানেও পরিবর্তন আসছে। জাস্টিন ট্রুডোর পাশাপাশি আমরা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে জেব বুশকেও দেখতে পারি। জেব বুশ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের (১৯৮৯-১৯৯৩) ছোট ছেলে ও দু-দুবারের প্রেসিডেন্ট বুশের (২০০০-২০০৮) ছোট ভাই। এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরও দেখা যায়। আর্জেন্টিনাসহ লাতিন আমেরিকার দেশে পারিবারিক রাজনীতির ধারাও আমরা দেখি ভিন্ন আঙ্গিকে। রাজনীতিতে এই ধারা একটি বাস্তবতাÑ পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ কথাটা প্রযোজ্য।
Daily Amader Somoy
29.11.15
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে বিশ্ব
17:28
No comments
হঠাৎ
করেই বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। প্যারিসে ইসলামিক স্টেটের
(আইএস) জঙ্গিদের হামলায় মারা গেছেন ১২৯ জন মানুষ। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে
৩টি স্থানে হামলা চালিয়ে এবং আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাধারণ
মানুষদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনার রেশ শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিম আফ্রিকার একটি
দেশ মালির রাজধানী বামাকোর একটি হোটেলে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালায়। ১৭০ জন
বিদেশিকে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠী আল মুরাবিতুম
জিম্মি করে। উদ্ধার অভিযানে মারা যান ২৭ জন নাগরিক। এদিকে চীনের জিনজিয়াংয়ে
একটি কয়লা খনিতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে একটি
বার্তা সংস্থা। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ২৮ জনকে গুলি করে হত্যা
করেছে এমন খবরও প্যারিস ও মালি ট্র্যাজেডির পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। সবাই
জানেন জিনজিয়াং মূলত উইঘুর মুসলমানদের বসবাস। উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে
বিচ্ছিন্নবাদী চিন্তা চেতনা কাজ করছে। উইঘুর মুসলমানরা কিছুদিন ধরেই এক
ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। আমরা স্মরণ করতে পারি কিছুদিন আগে
থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দিরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হয়েছিল তাতে জড়িত
ছিল উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও এই
সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের বাইরে নয়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী
কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। ইসলামিক স্টেটের
জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে এমন একটি আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে আসিয়ান
সম্মেলনের প্রাক্কালে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনে ইসলামিক জঙ্গিরা তৎপর। এদের
কর্মকাণ্ড একাধিকবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জš§ দিয়েছে। ফিলিপাইনে আবু সায়াফ
গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় জামিয়া ইসলামিয়ার হাতে
বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এই দেশ দুটি সম্পর্কে বিশ্বে একটি বাজে
ধারণার জš§ দিয়েছে। এ অঞ্চলে আইএসের নেটওয়ার্ক কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে
তা জানা না গেলেও আল কায়েদার প্রভাব আছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি
গোষ্ঠীর সঙ্গে আল কায়েদা একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের জঙ্গিরাও যে এতে করে উৎসাহিত
হবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তি জীবন তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কিংবা যায় ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরান পড়েননি। নামাজও পড়তেন না। তার চাচাতো বোন নারী বোমবাজ হাসনা বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বব্যাপী ছিলেন এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে প্যারিসে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরনের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত না বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল এখন প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’মনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরনের ‘নিরাপত্তা বলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তি জীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কনক্রিকেটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘোটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। দুই. উগ্রপন্থি তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ করে তাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে এবং তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ‘ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত’Ñ এ ধরনের একটি সেøাগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেÑএমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিন. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রার্থীরা এখনো দলীয়ভাবে মনোনীত হননি। একজন কট্টরপন্থি রিপাবলিকান প্রার্থী যাতে দলীয় মনোনয়ন পান এই ঘটনা তাতে প্রভাব ফেলবে। চার. আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ন্যূনতম ‘ঐক্যে’ উপনীত হলেও অচিরেই এতে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চস্পুডোভস্কি তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব ষেড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডধৎ : অসবৎরপধ'ং খড়হম ডধৎ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু-তে উল্লেখ করেছেন বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজ জীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন তখন ওই স্টেডিয়ামের বাইরে ৩ আত্মঘাতী বোমারু নিজেদেরকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও এর প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্ক ও টুইন টাওয়ার-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ার-এর হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের অনেক উদ্বেগজনক চিন্তার খোরাক জোগায়।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রান্সে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ চলতি সপ্তাহে মস্কো যাচ্ছেন পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। তিনি ওয়াশিংটনেও যাবেন। ওলান্দের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কিভাবে বন্ধ হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪ বছর পর প্যারিস হত্যাকাণ্ডের নতুন একটি মাত্রা পেল। এটা স্পষ্ট এসব বড় বড় ঘটনার পেছনে যদি কোনো শক্তির মদদ না থেকে থাকে তাহলে এসব ‘ঘটনা’ সংঘটিত হতে পারে না। দুর্ভাগ্য টুইন টাওয়ার-এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। আল কায়েদার কথা আমরা জেনেছি বটে। কিন্তু কারা আল কায়েদার জš§ দিল, কারা সুবিধা নিল, সেই ইতিহাস রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা আবাউদের ‘মৃত্যু’ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এবারো রয়ে যাবে পর্দার অন্তরালে। তাই প্যারিসের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে একক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী মিত্ররা দীর্ঘদিন সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় বোমা বর্ষণ করেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। তবে এই ‘যুদ্ধে’ রাশিয়ার অংশগ্রহণের ফলে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। রাশিয়ার বোমাবর্ষণ আইএসের অনেক ঘাঁটির ক্ষতি হয়েছে। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নষ্ট হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি যৌথভাবে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখে তাহলে আইএসের ঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সিরিয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আপাতত আসাদকে রেখেই আইএসকে এই মুহূর্তে ‘প্রধান শত্রু’ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আসাদকে ক্ষমতায় রেখে সেখানে সিয়া, সুন্নি ও আলাইয়টদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত, এটা বাস্তব যে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। ইরানকে আস্থায় নিয়েই সমাধানের দিকে যেতে হবে। প্যারিস ও মালির ঘটনা প্রমাণ করল বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড কমেনি বরং বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৪ বছর আগে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলেও তা কোনো বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। সুতরাং বিশ্বশক্তি যদি এই ইস্যুতে একমত না হয় তাহলে সন্ত্রাস দমন সম্ভব হবে না। Daily Manobkontho 29.11.15
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তি জীবন তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কিংবা যায় ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরান পড়েননি। নামাজও পড়তেন না। তার চাচাতো বোন নারী বোমবাজ হাসনা বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বব্যাপী ছিলেন এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে প্যারিসে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরনের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত না বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল এখন প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’মনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরনের ‘নিরাপত্তা বলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তি জীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কনক্রিকেটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘোটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। দুই. উগ্রপন্থি তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ করে তাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে এবং তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ‘ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত’Ñ এ ধরনের একটি সেøাগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেÑএমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিন. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রার্থীরা এখনো দলীয়ভাবে মনোনীত হননি। একজন কট্টরপন্থি রিপাবলিকান প্রার্থী যাতে দলীয় মনোনয়ন পান এই ঘটনা তাতে প্রভাব ফেলবে। চার. আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ন্যূনতম ‘ঐক্যে’ উপনীত হলেও অচিরেই এতে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চস্পুডোভস্কি তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব ষেড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডধৎ : অসবৎরপধ'ং খড়হম ডধৎ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু-তে উল্লেখ করেছেন বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজ জীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন তখন ওই স্টেডিয়ামের বাইরে ৩ আত্মঘাতী বোমারু নিজেদেরকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও এর প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্ক ও টুইন টাওয়ার-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ার-এর হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের অনেক উদ্বেগজনক চিন্তার খোরাক জোগায়।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রান্সে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ চলতি সপ্তাহে মস্কো যাচ্ছেন পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। তিনি ওয়াশিংটনেও যাবেন। ওলান্দের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কিভাবে বন্ধ হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪ বছর পর প্যারিস হত্যাকাণ্ডের নতুন একটি মাত্রা পেল। এটা স্পষ্ট এসব বড় বড় ঘটনার পেছনে যদি কোনো শক্তির মদদ না থেকে থাকে তাহলে এসব ‘ঘটনা’ সংঘটিত হতে পারে না। দুর্ভাগ্য টুইন টাওয়ার-এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। আল কায়েদার কথা আমরা জেনেছি বটে। কিন্তু কারা আল কায়েদার জš§ দিল, কারা সুবিধা নিল, সেই ইতিহাস রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা আবাউদের ‘মৃত্যু’ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এবারো রয়ে যাবে পর্দার অন্তরালে। তাই প্যারিসের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে একক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী মিত্ররা দীর্ঘদিন সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় বোমা বর্ষণ করেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। তবে এই ‘যুদ্ধে’ রাশিয়ার অংশগ্রহণের ফলে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। রাশিয়ার বোমাবর্ষণ আইএসের অনেক ঘাঁটির ক্ষতি হয়েছে। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নষ্ট হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি যৌথভাবে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখে তাহলে আইএসের ঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সিরিয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আপাতত আসাদকে রেখেই আইএসকে এই মুহূর্তে ‘প্রধান শত্রু’ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আসাদকে ক্ষমতায় রেখে সেখানে সিয়া, সুন্নি ও আলাইয়টদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত, এটা বাস্তব যে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। ইরানকে আস্থায় নিয়েই সমাধানের দিকে যেতে হবে। প্যারিস ও মালির ঘটনা প্রমাণ করল বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড কমেনি বরং বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৪ বছর আগে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলেও তা কোনো বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। সুতরাং বিশ্বশক্তি যদি এই ইস্যুতে একমত না হয় তাহলে সন্ত্রাস দমন সম্ভব হবে না। Daily Manobkontho 29.11.15
বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের সেই একই মনোভাব!
15:17
No comments
বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক
সম্পর্ক এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে চূড়ান্ত
বিচারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ
মুজাহিদের দণ্ড কার্যকর করা নিয়ে পাকিস্তান সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে,
তা নতুন করে দুদেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পাকিস্তান সরকারের
প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। ওয়েবসাইটে পাকিস্তান সরকার দুজন মানবতাবিরোধীর
ফাঁসির দণ্ডাদেশকে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এবং এ ঘটনায় তারা
যে উদ্বিগ্ন ও বেদনাগ্রস্ত এবং সেই সঙ্গে বিরক্ত, সে কথাটা জানাতেও তারা
ভোলেনি। ওয়েবসাইটে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে
স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা উল্লেখ করে ১৯৭১ সালের বিষয়াদি ভুলে সামনের দিকে
তাকানোর নীতি গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খানের একটি বিবৃতিও
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিবৃতিতে জনাব খান বলেছেন, বাংলাদেশের একটি
গোষ্ঠী পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক
পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা। প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের কোনো বক্তব্য দিতে পারেন কিনা। বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তান
কেন, কোনো রাষ্ট্রেরই বলা বা মন্তব্য করার কিছু নেই। এ ধরনের মন্তব্য
অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য। দুর্ভাগ্যজনক, উদ্বিগ্ন, বিরক্ত ইত্যাদি যেসব
শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং তা বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল।দুটি
দেশের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে জাতিসংঘের সনদ। ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন
সানফ্রান্সিসকো শহরে জাতিসংঘ সনদটি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৪৫ সালের ২৪
অক্টোবর তা কার্যকর হয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সনদের
মূলনীতির ১নং ও ৭নং ধারাটি উল্লেখ করতে চাই। ১নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে,
সব সদস্যের সার্বভৌমত্ব ও সমতার মূলনীতির ওপর এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত। আর
৭নং ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনো রাষ্ট্রের
নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের
নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না। এই ধারাটি
যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে দেখা যাবে পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
জাতিসংঘ সনদের মূলনীতির ৭নং ধারাকে কনট্রাডিক্ট করে। এই ধারা অনুযায়ী
বাংলাদেশের কোনো অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য বা সমালোচনা করার কোনো অধিকার
পাকিস্তানের নেই। ফলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বক্তব্যটি
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা করা
হয়েছে। ঢাকাস্থ পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে কড়া
প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।এখানে উল্লেখ
করা প্রয়োজন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত
নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ তখনও
এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল পাকিস্তান। আসলে
১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আজ
অবধি দুদেশের সম্পর্কের যে ৪১ বছরের ইতিহাস, তা সব সময় আস্থা ও বিশ্বাসের
নিরিখে পরিচালিত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। এই সম্পর্ক উজ্জ্বল ছিল, এটাও বলা
যাবে না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা ছিল, তার সমাধান
হয়নি এতদিনেও। ফলে দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ছিলই।পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছিল এবং বাংলাদেশ
নামক রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের
সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পাকিস্তান
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কখনোই সম্মান জানায়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার জন্য ক্ষমাও চায়নি
কোনোদিন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলেও
পাকিস্তানের নেতারা তা চায়নি। এমনকি পাকিস্তানের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল
সমাজের প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানালেও
পাকিস্তানে অতীতে কোনো সরকারই এ কাজটি করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে
এসব পুরনো কথা উল্লেখ করে এসব ভুলে সামনের দিকে তাকাতে বলা হয়েছে। কী
ঔদ্ধত্য! ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা পাকিস্তান ভুলে যেতে বলছে! আসলে
পাকিস্তানি নেতাদের মধ্যে বরাবরই সেই উপনিবেশিক মানসিকতা রয়ে গেছে-
বাংলাদেশকে তারা সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে চায় না।দীর্ঘ
২৪ বছরের অখণ্ড পাকিস্তানের সময়টিতে দেশটির সামরিক ও সামন্ততান্ত্রিক
নেতৃত্ব বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। সেই মানসিকতা থেকে
তারা আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। তবে বাংলাদেশ কখনও পাকিস্তানকে অমর্যাদা
করেনি এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। স্বাধীনতার
পর বাংলাদেশ হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা অফিসারের
বিচারের দাবি করলে তা পাকিস্তানে বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং তৎকালীন
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো অভ্যন্তরীণভাবে চাপের
সম্মুখীন হন। ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ বাঙালি পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন।
তাদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের
মাটিতে আত্মসমর্পণকারী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে নিয়েও ভুট্টো বিপদে
পড়েছিলেন। বাংলাদেশ ওই সময় দাবি করেছিল পাকিস্তানের স্বীকৃতির। অন্যদিকে
পাকিস্তান দাবি করেছিল ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার সেনাসদস্যের নিঃশর্ত
মুক্তির। ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারের দাবি
প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে
জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব ব্যক্তি
মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার করা যাবে না- এ ধরনের
কোনো কথা ওই চুক্তিতে ছিল না। এবং পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল যে
চুক্তির কথা উল্লেখ করেছে, তাতেও মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা জড়িত ছিল তাদের
বিচার করা যাবে না- এমন সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ করা ছিল না। এখানে বলা
ভালো, ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি লাহোরে দ্বিতীয় ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু
যোগদানের শর্ত হিসেবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত ২২
ফেব্র“য়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধু লাহোর সম্মেলনে
যোগ দিয়েছিলেন।১৯৭৪ থেকে ২০১৫ সময়টা
অনেক দীর্ঘ। এত দীর্ঘ সময়েও দুদেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পূর্ণ
সমাধান হয়েছে, তা বলা যাবে না। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদ ফেরত,
বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন,
বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন হয়নি। পাকিস্তানের
কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি একাধিকবার বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও
এক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ১৯৭৪ সালে প্লানিং কমিশন ২ হাজার ৪৪৬ কোটি
টাকা পাওনা দাবি করে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের অখণ্ড
পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে ওই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা
হয়েছিল। গত ৪০ বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ বিভিন্ন
সময়ে ওই দাবি উত্থাপন করলেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি। তবে
বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ পাকিস্তান বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরনো টাইপের
বোয়িং বিমান দিয়েছিল, যা অখণ্ড পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় কিছুই নয়। ১৯৮৯
সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় পাকিস্তান
নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একটি কাউন্সিল গঠন করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এ
ব্যাপারেও পরে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের
পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এই আটকে পড়া
পাকিস্তানি নাগরিকরা বিহারি হিসেবে পরিচিত। এসব পাকিস্তানি নাগরিক এখনও
পাকিস্তানে যেতে চান। এটা সত্য, কিছু আটকে পড়া পাকিস্তানি ইতিমধ্যে
পাকিস্তানে চলে গেছেন। তবে প্রায় ২ লাখ পাকিস্তানি এখনও ঢাকাসহ দেশের
বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট
জিয়াউল হক এদের নিতে রাজি থাকলেও পরে বেনজির ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে এ
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়। ভুট্টো এদের পাকিস্তানি বলতেও রাজি ছিলেন
না। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে তেমন কিছু শোনা যায় না।ব্যবসা-বাণিজ্যের
ক্ষেত্রে যতটা অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা-ও হয়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়,
বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানির পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ২৭ দশমিক ৬ ভাগ হারে।
অথচ বাংলাদেশ থেকে আমদানি বেড়েছে মাত্র ৯ দশমিক ২ ভাগ হারে। দুদেশের
মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণও কমতির দিকে। ২০১০-১১ সময়সীমায় বাণিজ্যের পরিমাণ
যেখানে ছিল ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪০ মিলিয়ন
ডলারে। পাকিস্তানি নাগরিক, এমনকি ঢাকাস্থ দূতাবাসের কর্মচারীরা ইতিমধ্যে
নানা অপকর্মে নিজেদের জড়িত করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা
যায়, বেশকিছু পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে ভারতীয় জাল নোটের অবৈধ ব্যবসা
তথা পাচারের সঙ্গে জড়িত। বেশ কজন ইতিমধ্যে গ্রেফতারও হয়েছেন। চলতি বছরের
ফেব্র“য়ারি মাসে জনৈক মাজহার খান (যিনি ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত
ছিলেন) অকূটনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ
তাকে বহিষ্কার করে। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বিস্তারে কোনো কোনো পাকিস্তানি
জড়িত- এমন অভিযোগও আছে।বাংলাদেশ ও
পাকিস্তান সার্ক, কমনওয়েলথ, ডি-৮, ওআইসিসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার
সদস্য। এক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় থাকার কথা থাকলেও তা হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পাকিস্তান যখন হস্তক্ষেপ করে,
তখন দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও অবনতি হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ
করে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানিদের নেতিবাচক প্রচারণাকে সহ্য
করবে না। এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব আরও
শক্তিশালী হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি সামাজিক সূচকে
পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। আর্থিক ভিত্তি, নারীশিক্ষা, বৈদেশিক রিজার্ভ,
মুদ্রামান, স্বাস্থ্যসেবা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, রেমিটেন্স ইত্যাদি প্রায়
প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। পাকিস্তান
আমাদের জন্য কোনো ক্ষেত্রেই কোনো মডেল নয়। সার্কে উভয় দেশই আছে বটে,
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা যায়, পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার
সম্পর্ককে যতটুকু গুরুত্ব দেয়, সার্কের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে এখন আর তত
গুরুত্ব দেয় না।এ প্রেক্ষাপটে
পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে তার মানসিকতায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে
দুদেশের সম্পর্কের অবনতি হতে বাধ্য। পাকিস্তান তার মানসিকতায় পরিবর্তন আনবে
এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলাবে না, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
Daily Jugantor
27.11.15
সন্ত্রাসের নতুন মাত্রা
17:23
No comments
গত ১৩ নভেম্বর রাতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যে ঘটনা ঘটেছিল তাতে সন্ত্রাসের নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। এই ঘটনার রেশ ধরে গত ১৯ নভেম্বর মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে ‘নিহত’ হয়েছেন সত্য, কিন্তু প্যারিসের ঘটনাবলি রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজজীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ যখন স্টেডিয়ামে একটি ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন, ওই স্টেডিয়ামের বাইরে তখন তিন আত্মঘাতী বোমারু নিজেদের বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেননি। চিন্তা করা যায়, সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে মানুষ হত্যা করেছিল। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন দাবিক-এ (উধনরয়) ফেব্রুয়ারি মাসে সপ্তম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন, পুরো ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে দাবিক-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও তা প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারের ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ারের হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকা- আমাদের অনেক চিন্তার খোরাক জোগায়।
কাকতালীয়ভাবে ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে প্যারিসে সংঘটিত হত্যাকা-ের অনেক মিল আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও টুইন টাওয়ার হত্যাকা-ের প্রকৃত রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। কেন টুইন টাওয়ার হামলায় একজন ইহুদিও মারা গেল না, কারা অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, এর পেছনে কাদের আর্থিক স্বার্থ বেশি ছিল, একটা ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব তৈরি করে কারা লাভবান হয়েছে, কেন সৌদি আরব রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা নেই। আমি ইতোমধ্যে আমাদের সময়ে ৯/১১ নিয়ে একাধিক লেখা প্রকাশ করেছি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, ৯/১১-এর ঘটনাবলি ছিল একটি বড় ধরনের ‘ষড়যন্ত্রেরই’ ফল। আজ যখন ভিন্ন আঙ্গিকে প্যারিস ট্র্যাজেডি সংঘটিত হতে দেখি, তখন স্পষ্টতই আবারও সেই ‘ষড়যন্ত্র’-এর কথাই মনে পড়ে যায়। আল কায়েদার চ্যাপ্টার এখন ‘শেষ’। ওবামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। রাজনীতির মঞ্চে এখন আছেন বাগদাদি আর ইসলামিক স্টেট। কে এই বাগদাদি, কারা আইএস তৈরি করলÑ এ নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা গবেষণা করেন, তারাই বলেন এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সৃষ্টি। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ গরপযবষ ঈযড়ংংঁফড়াংশু তো স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছেন, প্যারিস ট্র্যাজেডি হচ্ছে ৯/১১ ফ্রেন্স স্ট্রাইল (খব ১১ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ধ ষধ ভৎধহপধষংব) যারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই এৎবধঃবৎ সরফফষব ঊধংঃ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি কার্ক সাতটি দেশের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। এই সাতটি দেশ হচ্ছেÑ ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাক। ইতোমধ্যে লিবিয়া ও ইরাকে পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া পরিবর্তনের পথে। ২০২০-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে মানচিত্র আঁকতে হবে। সৌদি আরব ভেঙে যাওয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইরাক একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়াÑ এসবই এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আজ সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এর থেকে উপকৃত হচ্ছে একমাত্র ইসরায়েল। আজ তাই কোনো কোনো পক্ষের কাছে যেমনি প্রয়োজন ছিল ৯/১১-এর জন্ম দেওয়ার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছিল প্যারিস ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করার! আরও একটা কারণে তাদের কাছে প্যারিস ট্র্যাজেডির প্রয়োজন ছিল। সামনে অর্থাৎ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। একজন কনজারভেটিভ, কট্টর, ইমিগ্রেশনবিরোধী রোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট সেখানে দরকার। হিলারির জনপ্রিয়তায় ধস নামানো প্রয়োজন! তাই প্যারিস ট্র্যাজেডি নিয়ে অনেক ‘প্রশ্ন’ ও অনেক ‘জিজ্ঞাসা’ থাকবেই। ৯/১১-এর ঘটনার রোগ এখন স্তিমিত হয়ে আসছে। তাই প্যারিস ট্র্যাজেডির প্রয়োজন ছিল। এর রেশ সারা বিশ্বকে টানতে হবে। নতুন করে ‘মুসলমানবিরোধী’ একটা জনমত আবার ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কী শেষ? যেভাবে প্যারিসে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরনের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত নাবাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানো হচ্ছে। এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা করছি। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল, আজ প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরনের ‘নিরাপত্তা বলয়ের’ ভেতর। তাদের সব কর্মকা- ‘মনিটর’ করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তি’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কংক্রিকেটর বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো, অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘোটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। দুই. উগ্রপন্থীরা তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবেন। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। তারা নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে। এবং তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত- এ ধরনের একটি সেøাগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ বেশ কটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিন. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রার্থীরা এখনো দলীয়ভাবে মনোনীত হননি। একজন কট্টরপন্থী রিপাবলিকান প্রার্থী যাতে দলীয় মনোনয়ন পান, এই ঘটনা তাতে প্রভাব ফেলবে। চার. আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ন্যূনতম ‘ঐক্যে’ উপনীত হলেও অচিরেই এতে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে, তাতে লাভ ইসলামিক স্ট্রেট জঙ্গিদের। ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ গরপযবষ ঈযড়ংংঁফড়াংশু তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব এষড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ধিৎ : অসবৎরপধ'ং ষড়হম ধিৎ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু-তে উল্লেখ করেছেন বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা। দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে। অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরয়া)। মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের উত্থানের আগেই মার্কিনিদের কাছে আসাদ ছিলেন পরবর্তী টার্গেট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সিরিয়ায় সাধারণ মানুষ হত্যার, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার। তাই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আসাদকে উৎখাতের। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় ঢ়ৎড়ঃবপঃ তত্ত্ব। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। ফলে এই তত্ত্ব কোনো আন্তর্জাতিক আইন হিসেবেও গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণত কোনো দেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা সিরিয়ার ক্ষেত্রে (২০১১) এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে জন্ম হয়েছিল ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর, যারা এখন সিরিয়া ও ইরাকের একটি বিশাল অংশ দখল করে একটি তথাকথিত জিহাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় আসাদবিরোধী ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভ্যুলেশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস’ গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল প্রধান একটি গণতান্ত্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠার। কিন্তু দেখা গেল ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল কাউন্সিলের ভূমিকা সীমিত হয়ে গেছে। রাজনীতির দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় ইসলামিক স্টেটের জাঙ্গিরা। তাদের নৃশংস কর্মকা- সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধির মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে কারা ইসলামিক স্টেটকে সংগঠিত করেছে?
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামিক স্টেটের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এই এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। প্যারিস হত্যাকা-ের পর ফ্রান্সে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ চলতি সপ্তাহে মস্কো যাচ্ছেন। পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। তিনি ওয়াশিংটনেও যাবেন। ওলাঁদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু নির্মম সন্ত্রাসবাদ কীভাবে বন্ধ হবে? সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪ বছর পর প্যারিস হত্যাকা- এর নতুন একটি মাত্রা পেল। এটা স্পষ্ট এসব বড় ঘটনার পেছনে যদি কোনো শক্তির মদদ না থেকে থাকে তাহলে এসব ‘ঘটনা’ সংঘটিত হতে পারে না। দুর্ভাগ্য আমাদেরÑ টুইন টাওয়ারে হত্যাকা-ের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। আল কায়েদার কথা আমরা জেনেছি বটে। কিন্তু কারা আল কায়েদার জন্ম দিল, কারা সুবিধা নিল, সে ‘ইতিহাস’ রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে। আজ প্যারিস হত্যাকা-ের মূল হোতা আবাউদের ‘মৃত্যু’ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এবারও রয়ে যাবে পর্দার অন্তরালে। তাই প্যারিসের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
Daily Amader Somoy
22.11.15
প্যারিস ট্রাজেডি ও ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতি
17:14
No comments
গত ১৩ নভেম্বর প্যারিসে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের হাতে ১২৯ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বিশ্ব মিডিয়ায় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি নয়া যুদ্ধ শুরু করেছেন। এ যুদ্ধ বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে? মধ্যপ্রাচ্য কি আগামীতে চতুর্থ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে? সারা বিশ্বের মিডিয়ায় এখন নানা প্রশ্ন, নানা জল্পনা-কল্পনা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা। সারা বিশ্বের মানুষ সেদিন টিভির পর্দায় দেখেছিল কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল টুইন টাওয়ার। সন্ত্রাসীরা সেদিন ৪টি বিমান হাইজ্যাক করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে বিধ্বস্ত করিয়েছিল। ওই ঘটনার পরের ইতিহাস সবার জানা। আল কায়দা ও এর নেতা ওসামা বিন লাদেন টুইন টাওয়ার ধ্বংসের এবং কয়েক হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী- এ অভিযোগ তুলে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিমানবহর হামলা চালাল আফগানিস্তানে এবং দেশটি দখল করে নিল। দীর্ঘ ১৩ বছর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ছিল। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সরকারিভাবে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও সেখানে এখনও কিছু মার্কিন সেনা রয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, তাদের কাজ শুধু প্রশিক্ষণ দেয়া।
এরপর ২০০৩ সালের মার্চ। ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে- এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নিল। প্রিয়েমটিভ স্ট্রাইকের তত্ত্বটি ব্যবহার করা হয়েছিল ইরাক আক্রমণের ক্ষেত্রে। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, শত্র“ আঘাত হানার আগেই তাকে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছে, ইরাকের কাছে কোনো মারণাস্ত্র ছিল না। ওই সময়ের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, ইরাক হামলা ভুল ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক আক্রমণের আগে ইরাকি জনগণকে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দিলেও পুরো ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরাকি জ্বালানি তেলের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল মার্কিনিদের। আর ওই তেল বিক্রি করেই ইরাক পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল মার্কিন কোম্পানিগুলো।
এর পরের টার্গেট ছিল লিবিয়ার গাদ্দাফি। ২০১১ সালে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হল। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ইরাকি তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়নি। স্থলবাহিনীও সেখানে পাঠানো হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছিল হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশন তত্ত্ব, অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ তত্ত্ব। গাদ্দাফির শাসনামলে সেখানে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে, এ অভিযোগ তুলে মার্কিন ও ফরাসি বিমান লিবিয়ায় হামলা চালাল এবং গাদ্দাফিকে হত্যা করা হল। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেছে। লিবিয়া কার্যত এখন একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো সরকার নেই। মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে প্রতিদিন। লিবিয়া এখন সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে লিবিয়ার রাজনীতি।
এরপর এলো রেসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব! সিরিয়ার ক্ষেত্রে এ তত্ত্বটি ব্যবহৃত হয়েছে। সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের আগেই প্রেসিডেন্ট আসাদ ছিলেন মার্কিনিদের পরবর্তী টার্গেট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সাধারণ মানুষ হত্যার, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার। তাই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আসাদকে উৎখাতের। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল রেসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট তত্ত্ব। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। ফলে এ তত্ত্ব কোনো আন্তর্জাতিক আইন হিসেবেও গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণত কোনো দেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা সিরিয়ার ক্ষেত্রে (২০১১) এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে জন্ম হয় আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর, যারা এখন সিরিয়া ও ইরাকের একটা বিশাল অংশ দখল করে একটি তথাকথিত জিহাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আসাদবিরোধী ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভ্যুলেশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল স্বাধীন একটি গণতান্ত্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠার। কিন্তু দেখা গেল, আইএসের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল কাউন্সিলের ভূমিকা সীমিত হয়ে গেছে। রাজনীতির দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় আইএসের জঙ্গিরা। তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধির মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কারা আইএসকে সংগঠিত করেছে?
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিরিয়ায় আইএসের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এ এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা এ নামটি গ্রহণ করেছিল। পরে তারা নামটি পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে এরা আল কায়দা ইন ইরাক নাম ধারণ করে। এ সংগঠনটি মূলত সুন্নি প্রভাবাধীন ও সুন্নি সম্প্রদায়নির্ভর। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শূরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। তবে আল কায়দার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন থেকে আইএসের সঙ্গে আল কায়দার কোনো সম্পর্ক নেই। আল কায়দার রাজনৈতিক দর্শন ও আইএসের রাজনীতির মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটি সংগঠনই মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল কায়দা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনও। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন; কিন্তু আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেননি। বুগদাদি নিজেকে পুরো মুসলিম বিশ্বের নেতা বা খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দাবি করেছেন, সব মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে এ খেলাফতের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা। তিনি মুসলমানপ্রধান দেশগুলোকে নিয়ে এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। অপরদিকে আল কায়দার স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা। আল কায়দা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অপারেট করে। কিন্তু আইএস তা করে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আল কায়দা ও আইএস- উভয় সংগঠনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার জন্ম দেয়া।
পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। এখানে তার স্বার্থ অনেক। স্বার্থ রয়েছে ফ্রান্সেরও। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমিরাত ও সাইপ্রাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সস্তায় তেল পাওয়া যায়। এ তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। লিবিয়ার তেলের ওপর ৩টি পশ্চিমা দেশের নির্ভরশীলতা ইতিমধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইতালির প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ২৯ ভাগ আসে লিবিয়া থেকে। ফ্রান্স ও স্পেনের এ নির্ভরশীলতার হার যথাক্রমে ১৪ ও ১০ ভাগ। তারা চাইবে সস্তায় তেল নিতে। সিরিয়ায় খুব বেশি তেলসম্পদ নেই। কিন্তু এ তেলই এখন আইএসের জঙ্গিদের আয়ের অন্যতম উৎস। আইএস প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ২৬ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কালোবাজারে তা বিক্রি করে। এর মূল্য দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। আর প্রতিদিনের তেল বিক্রির অর্থ জমা হচ্ছে আইএসের ফান্ডে। এ ফান্ড ব্যবহৃত হয় জঙ্গিদের মাসিক বেতন (৪৩০ থেকে ১ হাজার ডলার) এবং সেই সঙ্গে বিদেশে জঙ্গি তৎপরতার কাজে। যেমন, প্যারিসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।
কাকতালীয়ভাবে ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে প্যারিসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও টুইন টাওয়ার হামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। কেন টুইন টাওয়ার হামলায় একজন ইহুদিও মারা গেল না, কারা অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, এর পেছনে কাদের আর্থিক স্বার্থ বেশি ছিল, একটা মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করে কারা লাভবান হয়েছে- এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা নেই। আমি যুগান্তরে ৯/১১ নিয়ে একাধিক লেখা লিখেছি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, ৯/১১-এর ঘটনাবলী ছিল এটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্রেরই ফল। আজ যখন ভিন্ন আঙ্গিকে প্যারিস ট্রাজেডি সংঘটিত হতে দেখি, তখন স্পষ্টতই আবারও সেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাই মনে পড়ে যায়। আল কায়দার চ্যাপ্টার এখন শেষ। ওসামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। রাজনীতির মঞ্চে এখন বুগদাদি আর ইসলামিক স্টেট। কে এই বুগদাদি, কারা আইএস তৈরি করল- এ নিয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা গবেষণা করেন তারাই বলেন, এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সৃষ্টি। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মিশেল চসুদোভস্কি তো স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছেন, প্যারিস ট্রাজেডি হচ্ছে ৯/১১-এর ফরাসি স্ট্রাইল (Le ll September a la Francaise)।
যারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই গ্রেটার মিডলইস্ট পলিসি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ৭টি দেশের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। ওই ৭টি দেশ হচ্ছে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাক। ইতিমধ্যে লিবিয়া ও ইরাকে পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া পরিবর্তনের পথে। ২০২০-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে মানচিত্র আঁকতে হবে। সৌদি আরবের ভেঙে যাওয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইরাক একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া- এসবই এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আর সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এ থেকে উপকৃত হচ্ছে একমাত্র ইসরাইল। এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের যেমন প্রয়োজন ছিল ৯/১১-এর জন্ম দেয়ার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছিল প্যারিস ট্রাজেডি সৃষ্টি করার! আরও একটা কারণে প্যারিস ট্রাজেডির প্রয়োজন ছিল। সামনে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। একজন কনজারভেটিভ, কট্টর, ইমিগ্রেশনবিরোধী রোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট সেখানে দরকার! হিলারির জনপ্রিয়তায় ধস নামানো প্রয়োজন! তাই প্যারিস ট্রাজেডি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও অনেক জিজ্ঞাসা থাকবেই। ৯/১১-এর ঘটনার রেশ এখন স্তিমিত হয়ে আসছে। তাই প্যারিস ট্রাজেডির প্রয়োজন ছিল। এর জের সারা বিশ্বকে টানতে হবে। নতুন করে মুসলমানবিরোধী একটা জনমত আবার ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এখন বড় পরিবর্তন আসবে। এ মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সিরিয়া থেকে আসা অভিবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্র ১০ হাজার সিরীয় অভিবাসী গ্রহণে রাজি হয়েছিল। এখন তাতে প্রতিবন্ধকতা আসবে। ইতিমধ্যে ১৪টি রাজ্য (যুক্তরাষ্ট্রের) সিরীয় শরণার্থী গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের এখন এক ধরনের বস্তির জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে।
সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছলেও চূড়ান্ত বিচারে এ ঐকমত্য কতদিন টিকে থাকবে- এটা একটা প্রশ্ন। এই ঐক্য সাময়িক। আসাদকে সিরিয়ায় ক্ষমতায় রাখার প্রশ্নে খুব শিগগিরই এ ঐক্যে ভাঙন ধরবে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি ইরানকে এ অঞ্চলের ব্যাপারে একটা ভূমিকা রাখতে উৎসাহ জুগিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমঝোতা আদৌ ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত করবে কি-না?
সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ইউরোপের মতো সুরক্ষিত দেশ ফ্রান্সে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটল। এর আগে লন্ডন, মাদ্রিদেও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। আমাদের মতো দেশ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমাদের দেশে আইএস নেই বলে আমরা যেন আÍতুষ্টিতে না ভুগি। আইএস সমর্থকরা এ দেশে সক্রিয় হচ্ছে। প্যারিসের ঘটনা তাদের উৎসাহ জোগাতে পারে। তাই গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ লোকদের সমন্বয়ে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্স গঠন করা জরুরি। সর্বক্ষেত্রে মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। অনেক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সবার বিচারও হয়নি।
প্যারিস ট্রাজেডি আবার নতুন করে ইউরোপে ইসলাম ফোবিয়ার জন্ম দেবে। কিন্তু এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মূল হোতাদের খুঁজে বের করা যাবে- এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। তবে নিঃসন্দেহে প্যারিস ট্রাজেডি থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
Daily Jugantor
22.11.15
মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি
02:51
No comments
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিজয় এবং ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং থøাইং কর্তৃক এই রায় মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসল তা হচ্ছে মিয়ানমারে কি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পরও এমন একটি সম্ভাবনার জš§ হয়েছিল। ওই নির্বাচনেও অং সান সুচির দল বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী ওই নির্বাচন মেনে নেয়নি। বরং নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে অং সান সুচিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আজ ২৫ বছর পর এমন একটি সম্ভাবনার জš§ হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও, আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আরো বেশি ‘কমিটেড।’ ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকায় এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে সংশয় যে নেই, তাও বলা যাবে না। সংশয়, উদ্যোগ এবং নানা প্রশ্নও আছে। অং সান সুচি বলেছেন ‘তার ভূমিকা হবে প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে।’ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। সংবিধান তিনি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, সংবিধান তাকে মানতে হবে এবং সংবিধান মানলে তাকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে (২০১৬, মার্চ) মানতে হবে। ফলে সুচি যদি ‘জোর করে’ কিছু করতে চান, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে এবং তাতে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে যাবেন, যা মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোন ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাহলে তার ভূমিকা কি হবে? তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কেননা সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি অবলুপ্ত করা হয়েছে। সঙ্গতকারণেই প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এনএলডিকে নিয়েই সরকার গঠন করবেন। সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্যাবিনেটে সভাপতিত্ব করবেন। মন্ত্রিসভায় এনএলডির মন্ত্রী থাকলেও মূল ব্যক্তি হবেন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন, অং সান সুচি নন। এ ক্ষেত্রে সুচির জন্য প্রশাসনিক আদেশে প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় একটি পদ সৃষ্টি করা হতে পারে! অথবা সুচি মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়েও পর্দার অন্তরালে (অনেকটা ভারতে সোনিয়া গান্ধীর মতো) থেকে মন্ত্রিসভা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে সুচিকে যেভাবে মানুষ দেখেছে, নির্বাচনের পর মানুষ দেখছে ভিন্নভাবে। তিনি বিদেশি গণমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিয়ে যেভাবে নিজের মনোভাবকে তুলে ধরছেন, তা তার কর্তৃত্ববাদী মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। যেখানে তার উচিত ছিল একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া, এটা না করে তিনি এক ধরনের ‘হুমকির সুরে’ সরকার পরিচালনার কথা বলছেন। গণতন্ত্রের নামে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা কোনো কোনো দেশে লক্ষ্য করি। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন জোট গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জš§ দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে একদলীয় (পিপলস অ্যাকশন পার্টি) শাসন বজায় রয়েছে। যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্পুচিয়ায় সমাজতন্ত্র পরবর্তী কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বর্তমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তার নামেই তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। আমরা বেলারুশের কথাও বলতে পারি। এখানে নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হচ্ছে। এখন অং সান সুচি কী এ পথেই যাচ্ছেন? ক্ষমতা নিতে হলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে এটা মনে হয় না। জনগণই যে ‘সকল ক্ষমতার উৎস’ মিয়ানমারের নির্বাচন এই কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পরবর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। দেশটিতে এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। অর্থাৎ জানুয়ারিতে যখন সংসদ গঠিত হবে, তারপর ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার আগে এখন অন্তত এক মাস সময় থাকবে হাতে। সুচি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে। সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন সুচি। এবারো যদি তিনি ভুল করেন, তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২০ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। সুচির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে তখন ৭৪। এরপর তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার নির্বাচন বিজয়ে স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়ক পথ চালু হলে এই সড়ক পথে একদিকে যেমনি আমাদের চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ, পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোট যোগ দেয়ায় এই জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদী রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্টস সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফানির্চার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফানির্চার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর যেমন রুবি, জেড, বোম আর মার্বেল সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালুএভিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপ লাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা ‘সমস্যা’ আছে বটে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কোনো সমস্যা তৈরি হবে না এটাই প্রত্যাশা করি। এ কারণেই এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। এই নির্বাচন মিয়ানমারকে কতটুকু স্থিতিশীলতা আনতে পারবে সে প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আরো ৭টি সশস্ত্র গোষ্ঠী। সুতরাং একটি প্রশ্ন থাকলই। শান্তিচুক্তিতে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে নির্বাচনের পর নয়া সরকার এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপর্ূূ। এক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় আরব বসন্তের মতো রক্তপাত ও চরম বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হতে পারে।’ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। এটা দিয়ে তিনি একটি ইঙ্গিত দিলেন। মিয়ানমার নির্বাচনের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সুচি যদি ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ না নেন, তাহলে সেনাবাহিনী এটা মেনে নেবে না। দুই. এটা সত্য, সুচি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্যতম একটি শক্তি। তিনি নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আগামী জানুয়ারিতে যখন সংসদ বসবে তখন একটি এনএলডি মন্ত্রিসভা গঠন করে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে পারেন। তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর যে কর্পোরেট ইন্টারেস্ট গড়ে উঠছে, তা সহজে ভাঙবে না। রাজনীতিতে তাদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচন তাতে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনল না।
Daily Manobkontho
14.11.15
কোন পথে মিয়ানমার
16:40
No comments
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন মিয়ানমার? অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন
ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে বলে
ধারণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সুচি সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা, তা
স্পষ্ট নয়। এই নির্বাচন নিয়ে অনেক ‘কিন্তু’ এবং অনেক ‘প্রশ্ন’ আছে।
জানুয়ারির আগে আর সংসদ অধিবেশন বসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর একটি
মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে, তারও পরে। কেননা সংবিধান অনুযায়ী যিনি প্রেসিডেন্ট,
তিনি একদিকে রাষ্ট্রেরও প্রধান আবার মন্ত্রিপরিষদেরও প্রধান। অর্থাৎ
রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। যদিও মিয়ানমারের
সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ নেই। তাহলে অং সান সুচির অবস্থান কী হবে?
সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কেননা তিনি একজন বিদেশিকে
বিয়ে করেছিলেন এবং তার দুই সন্তানের বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে। এটা সুচি
জানেন এবং বোঝেন। সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থেই সংবিধানে এই পরিবর্তনটা
এনেছে। এখন সু চি চাইলেও সংবিধান পরিবর্তনের কাজটি খুব সহজ হবে না। সংসদের
উভয় পক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন এতে প্রয়োজন। উচ্চকক্ষের আসন
সংখ্যা ২২৪, যেখানে ৫৬ জন সেনাসদস্য রয়েছেন, যারা সেনাপ্রধান কর্তৃক
মনোনীত। তবে উচ্চকক্ষের ১৬৮ জন (প্রতিটি রাজ্য থেকে ১২ জন করে) নির্বাচিত।
ঠিক তেমনি নিম্নকক্ষের ৪৪০ জন সদস্যের মধ্যে ১১৬ জন সেনাসদস্য মনোনীত। বাকি
৩৩০ জন (প্রতিটি টাউনশিপ থেকে একজন করে) নির্বাচিত। মোট ৬৬৪ জনের মধ্যে ৭৫
শতাংশ নির্বাচিত। আর ২৫ শতাংশ মনোনীত, যারা সেনাসদস্য। এ ক্ষেত্রে ৪৪২ জন
সংসদ সদস্যের প্রয়োজন রয়েছে সংবিধানের এই ধারাগুলো পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু
এ সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে। এক সংবিধানের এই ধারা
মেনে নিয়ে সুচির সেনাবাহিনী ও প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে একটি
‘সমঝোতা’য় যাওয়া। সমঝোতার অংশ হিসেবে অং সান সুচিকে প্রধানমন্ত্রীর
মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া। সেনাবাহিনী সংবিধান পরিবর্তনে তাদের
সমর্থন দেবে না। অং সান সুচি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে পেসিডেন্ট থেইন
সেইনকে দ্বিতীয় টার্মের জন্য সমর্থন করবেন। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের প্রথম
পাঁচ বছরে টার্ম শেষ হবে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। দুই. শেষ পর্যন্ত সুচি যদি
সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন তাহলে এক পর্যায়ে নির্বাচনটি বাতিল
হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৯০ সালের
পরিস্থিতি আর ২০১৫ সালের পরিস্থিতি এক নয়। বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক
রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং নির্বাচনটি বাতিল করার ঝুঁকি হয়তো
সেনাবাহিনী নেবে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো সুচি বাস্তবতা মেনে নেবেন। কিন্তু
শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সু চি গণতন্ত্রের কথা বলছেন বটে। কিন্তু
মিয়ানমারের সমাজ ও সংস্কৃতি একটু ভিন্ন ধরনের। সংবিধান সংশোধনের (১৯৮৮) পরও
সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে
রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে
সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন
হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন
হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনাসদস্যের সমর্থন এ
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সুচিকে কীভাবে আনবে তাও
স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি
হতে পারে। সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে
যেতে। যারা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তারা
দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা
কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর
পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র
বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচ-
মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা
(অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে
সংগঠিত হয়েছে। তাদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার
৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও
কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী
দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু
রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে
থাকবেন ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং
শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য
নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার
সরকার মনে করে রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর
ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমানের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন।
উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু
চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন
মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে
বাংলাদেশে ‘পুস ইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের
ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে
স্ট্র্যাটেজি বহন করছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন
নৈত্রী তিনি, এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনের আগে
একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থান’-এ গেছেন, অন্যদিকে
মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে উগ্র বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন এটা
সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু
প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের পর এখন
অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে সংস্কার চালু
করেছিলেন, এর অংশ হিসেবেই ওই নির্বাচনটি হলো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না
পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আগ্রহ রয়েছে মিয়ানমারের
ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। মার্কিন
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে।
দীর্ঘ ৫৩ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসনের পর মিয়ানমারের ‘দুয়ার খুলে
দেওয়া’ হয়েছে। সু চিকে সামনে রেখেই পশ্চিমা শক্তি তাদের স্ট্র্যাটেজি রচনা
করছে। এই মুহূর্তে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই ‘পরিবর্তন’ মেনে নিলেও
ভবিষ্যতে কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা যায় না। নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অং
সান সুচির অবস্থান কী হবে, তাও স্পষ্ট নয়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ
বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারছেন না। যদিও তিনি আভাস দিয়েছেন
তার ভূমিকা হবে ‘প্রধানমন্ত্রীর ঊর্ধ্বে’। এ ব্যাপারেও কথা আছে। সংবিধানে এ
ধরনের কোনো পদ নেই। একজন ‘সিনিয়র মন্ত্রী’ অথবা এক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি
প্রশাসনে থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আস্থা তিনি যতদিন পাবেন,
ততদিন ‘কোনো ঝামেলা ছাড়াই’ প্রশাসনের অংশ থাকবেন। সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ
তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবেÑ এটা মনে হয়
না। জনগণই যে ‘সকল ক্ষমতার উৎস’Ñ মিয়ানমারের নির্বাচন এ কথাটা আবার প্রমাণ
করল। এই নির্বাচন পার্শ¦বর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে
উৎসাহিত করবে। এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না।
ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরও দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা
মুসলিম নিধন ও উৎখাতে এতে আরও উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরও
বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। অর্থাৎ
আগামী জানুয়ারিতে সংসদ গঠন হওয়ার পর ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার
কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার আগে অন্তত এক মাস সময় থাকবে
হাতে। সু চি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনী সঙ্গে একটি ‘সমঝোতা’য় যেতে।
সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল
ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় পাঁচ বছর পিছিয়ে
গিয়েছিলেন সু চি। এবারও যদি তিনি ভুল করেন তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে
২০২০ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। সু চির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে তখন ৭৪-এ।
এরপর তার পক্ষে আর রজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি
মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার নির্বাচন
বিজয়ে স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্র নীতির কারণে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়কপথ চালু হলে তা একদিকে যেমন আমাদের চিনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়ও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেওয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি আনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদি পশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদি পশুর খামারও গড়ে তুলতে পারেন। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচারশিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারে মূল্যবান পাথর যেমনÑ রুবি, জেড আর মারবেলসমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারিশিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমার। এখন সেনাবাহিনী ও অং সান সু চিÑ উভয়পক্ষই যদি কিছু ‘ছাড়’ না দেয়, তাহলে তা মিয়ানমারের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। সেনা জেনারেলদের বুঝতে হবে মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আশার কথা, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং সেনাপ্রধান মিন অং হাইং সু চিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অন্যদিকে সু চিকেও বুঝতে হবে নির্বাচনে বিজয় মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। বাস্তবতা তাকে মেনে নিতে হবে। তাই সেনাবাহিনী ও নির্বাচনে বিজয়ী এনএলডির মধ্যে একটি ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠিত হোক- এটাই সবার কাম্য।
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্র নীতির কারণে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়কপথ চালু হলে তা একদিকে যেমন আমাদের চিনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে, অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়ও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেওয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি আনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদি পশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদি পশুর খামারও গড়ে তুলতে পারেন। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচারশিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারে মূল্যবান পাথর যেমনÑ রুবি, জেড আর মারবেলসমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারিশিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমার। এখন সেনাবাহিনী ও অং সান সু চিÑ উভয়পক্ষই যদি কিছু ‘ছাড়’ না দেয়, তাহলে তা মিয়ানমারের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। সেনা জেনারেলদের বুঝতে হবে মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আশার কথা, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং সেনাপ্রধান মিন অং হাইং সু চিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অন্যদিকে সু চিকেও বুঝতে হবে নির্বাচনে বিজয় মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। বাস্তবতা তাকে মেনে নিতে হবে। তাই সেনাবাহিনী ও নির্বাচনে বিজয়ী এনএলডির মধ্যে একটি ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠিত হোক- এটাই সবার কাম্য।
Daily Amader Somoy
15.11.15
যে নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জবাব দেয় না
16:46
No comments
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন দীর্ঘ
২৫ বছর পর একটি বড় প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে দেশটির জনগণের মধ্যে। ১৯৯০ সালে
অনুষ্ঠিত আরেকটি নির্বাচন এমন প্রত্যাশা সৃষ্টি করলেও অচিরেই
মিয়ানমারবাসীর সেই আশা ভঙ্গ হয়েছিল। সামরিক বাহিনী ওই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা
করেছিল। এরপর ২০১০ সালে একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে; কিন্তু তার কোনো
গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। প্রথমদিকে দল নিবন্ধন করতে না পারায় অং সান সুচির দল
ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। পরে অবশ্য
সুচি উপনির্বাচনে ৪০টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০১০ সালের নির্বাচনের
ধারাবাহিকতায়ই ৯ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল এবং যা প্রত্যাশা করা
হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে সুচির দল বিজয়ী হয়েছে বলে
মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু এ নির্বাচন অনেক প্রশ্নেরই কোনো জবাব দেয় না। প্রথমত,
জনগণের ভোটে সুচি বিজয়ী হলেও তিনি মিয়ানমার রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী
অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। সংবিধানে
প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার
কারণে তিনি প্রেসিডেন্টও হতে পারবেন না। কারণ তিনি একজন বিদেশীকে বিয়ে
করেছিলেন এবং তার দুই সন্তান বিদেশী নাগরিক। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী
মিয়ানমারের সমাজ ব্যবস্থায় অন্যতম একটি শক্তি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি
নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। ১৯৬২ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই
সেখানে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর স্বার্থে
আঘাত করলে তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেনাবাহিনী তাদের কর্পোরেট স্বার্থ
বিসর্জন দেবে, এটা মনে হয় না। অবশ্য সর্বশেষ খবর অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ও
সেনাপ্রধান উভয়েই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় সুচিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তৃতীয়ত, মিয়ানমারে সাম্প্রতিককালে একটি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির
জন্ম হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ উগ্র জাতীয়তাবাদী
রাজনীতিকে প্রমোট করছে। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা মা বা থা অথবা
অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন নামক একটি সংগঠনের
ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। একজন বার্মিজ বিন লাদেন ভিরাথুর কথাও ছাপা হয়েছিল
বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ২০১৩ সালের ১ জুলাই। ভিরাথু মিয়ানমার থেকে সব
মুসলমানের উচ্ছেদ চান। অং সান সুচি বরাবরই এদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজনীতি
করে গেছেন। এখন দেখতে হবে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে
উন্নীত হয়। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নির্বাচনের আগে ৮টি
বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু আরও ৭টি
সংগঠন রয়ে গেছে। এখন দেখতে হবে সুচির ব্যাপারে এদের দৃষ্টিভঙ্গি কী।
পঞ্চমত, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় সমস্যা রয়েই গেছে। সুচি কখনও রোহিঙ্গাদের
মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে বড় করে দেখেননি। এমনকি সেনাবাহিনী বলে থাকে
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় এবং সুচি এ বক্তব্যের কখনও সমালোচনা
করেননি।রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সেই সঙ্গে
সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক এখন নানা
জটিলতায় আটকে আছে। অতীতে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক নাফ নদীতে বাঁধ নির্মাণের
উদ্যোগের কারণ দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণকে
কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে, ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, উভয় দেশের
সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছিল। অনেকের স্মরণ
থাকার কথা, ২০০১ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৩৫ হাজার এবং
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০ হাজার সৈন্য নিজ নিজ সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল।
এরপর অবশ্য দুপক্ষের মাঝে একটি সমঝোতা হয়েছিল এবং মিয়ানমার বাঁধ নির্মাণ
কর্মসূচি স্থগিত রেখেছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় (২০০৬-২০০৮)
বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করায় (একটি কোরীয় কোম্পানি
কর্তৃক) মিয়ানমার সেখানে যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। নিরাপত্তার
স্বার্থে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও সেখানে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। বাংলাদেশ
বারবার মিয়ানমারকে আস্থায় নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সেই আস্থার কোনো মর্যাদা
দেয়নি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।রোহিঙ্গা
নিয়ে যে সমস্যা, তার শুরু মূলত ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় মিয়ানমারের
সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত Operation Dragon-এর শিকার হয়ে আরাকানের
মুসলমানরা (রোহিঙ্গা) দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ছিলেন আকিয়াব (সিটিওয়ে), পালেটবা, মিনবিয়া, মায়োহং,
মাইবন, মংডু ও রাথেডং অঞ্চলের অধিবাসী। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে
বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে
মিয়ানমার ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেয়ার
ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবং ১৯৭৮ সালের ৩১
আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আগত ১ লাখ ৮৭ হাজার
২৫০ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। এদের সবার কাছেই মিয়ানমার সরকার
কর্তৃক ইস্যুকৃত 'National Registration Card' (NRC) ছিল। এরপর ১৯৯১ সালের
মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকানে অপারেশন পিয়েথায়া নামে আরেকটি
অভিযান পরিচালনা করলে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে
প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেন। এরপর থেকে দুপক্ষের মাঝে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
নিয়ে আলোচনা হলেও কার্যত তা খুব একটা ফল দেয়নি।ধারণা
করা হচ্ছে, বর্তমানে প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা বৃহত্তর কক্সবাজার
এলাকায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত
রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৫। তারা টেকনাফের কতুপালং ও নোয়াপাড়া
শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমারের
নাগরিক শুমারি ২০১৫ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি
টাকা। এ উদ্যোগটি ভালো। রোহিঙ্গাদের এই দুটো ক্যাম্প থেকে নিঝুম দ্বীপে
সরিয়ে নেয়ার চিন্তাও করছে সরকার। এই উদ্যোগটিও ভালো। বাংলাদেশ সরকারকে এখন
রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।দ্বিতীয়ত,
মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণে মাদক ইয়াবা আসছে। বাংলাদেশ ইয়াবার চালানের
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় বিজিবি সদস্য রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনাটি
ঘটেছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ইয়াবার প্রশ্নটিও তার অপহরণের সঙ্গে জড়িত।
গত সাত বছরে ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ। এই হিসাব মাদকদ্রব্য
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। ঢাকায় ইয়াবা বিক্রির রয়েছে ৫ শতাধিক স্পট (আমাদের
সময়, ২৪ জুন)। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায়
অন্তত ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে চোরাই পথে প্রতি মাসে সীমান্ত
দিয়ে শত কোটি টাকার ইয়াবা চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদফতরের হিসাবে বাংলাদেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার মাদকের বাজার রয়েছে।
এর অর্ধেক দখল করে রেখেছে ইয়াবা (সকালের খবর, ২৪ জুন)। দুঃখজনক হলেও সত্য,
ইয়াবা পাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা জড়িত।
বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর অনেক সদস্যও এ কাজে জড়িয়ে গেছেন বলে খবর
রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে অং সান সুচির দল ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা
করেও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীর স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে
পরিস্থিতির অগ্রগতি হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই।তবে
এ নির্বাচন প্রমাণ করল মানুষ সেখানে পরিবর্তন চায়। তাই পরিবর্তনটি এসেছে।
জনগণই সব ক্ষমতার উৎস- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই স্বতঃসিদ্ধ বাক্যটির সত্যতা
মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আবারও প্রমাণিত হল। সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখার
চেষ্টা করলেও জনগণের সম্মতি তাতে ছিল না। জনগণ চেয়েছিল একটি সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটি প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নিশ্চিত করেছেন। এজন্য
নিঃসন্দেহে তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ১৯৯০ সালের মতো নির্বাচন বাতিল করার
কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। কেননা তিনি জানেন, নির্বাচন বাতিল করা হলে তা
পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে
না। আসিয়ানের নেতৃবৃন্দও এটা মানবেন না। ফলে একটি বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই
জেনারেল থেইন সেইন এ নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন। সারা বিশ্বই এখন
সাংবিধানিক পথে যাচ্ছে, নির্বাচনের পথে যাচ্ছে। একসময় যে ইন্দোনেশিয়ায়
সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল রাজনীতি, প্রশাসন সর্বত্র, সুহার্তো-পরবর্তী সেই
ইন্দোনেশিয়া এখন ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও ধীরে ধীরে নিজেদের বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর
প্রথম প্রকাশ হিসেবেই তারা সাধারণ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। তবে ধারণা করছি,
অং সান সুচির সঙ্গে তাদের পরোক্ষ একটা সমঝোতা হয়েছে। সুচি বর্তমান
সংবিধানকে মেনে নেবেন। এ মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ তিনি নেবেন
না। এমনকি মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে কোনো জেনারেলকে তিনি বিচারের
মুখোমুখিও দাঁড় করাবেন না। এক ধরনের স্ট্যাটাস কো তিনি মেনে নেবেন। তবে
একটা প্রশ্ন থাকছেই- নতুন সরকারে তার ভূমিকা কী হবে? প্রধানমন্ত্রীর পদ না
থাকায় এ পদটি আপাতত তিনি গ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে একজন সিনিয়র মন্ত্রীর
পদ সৃষ্টি করে অথবা প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদার পদ সৃষ্টি করে তিনি নয়া
সরকারে দায়িত্ব নিতে পারেন। সমঝোতার ফলে জেনারেল থেইন সেইনকে তিনি
দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে সমর্থন করতে পারেন। অথবা দলের সমর্থক
একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিতে পারেন। বর্তমান
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৬ সালের মার্চে।সুচি
মিয়ানমারকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও এ মুহূর্তে তা
পারবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই তিনি বিবিসির
সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা একটা শংকারও জন্ম দিয়েছে।
তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ২৫ শতাংশ আসন প্রথা বিলুপ্ত হবেই।
তিনি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর
জন্য আসন থাকা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। কথাটা তিনি মিথ্যা
বলেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মিয়ানমার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়।
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এই কোটা পদ্ধতি বাতিল করার এখনই উদ্যোগ নেন,
তাহলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন, যা পুনরায় সামরিক
অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি রিয়েল
পলিটিক্সের পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন
তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা ও শান্তিচুক্তি
বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো-পরবর্তী মডেল তিনি অনুসরণ
করতে পারেন, যেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কমিটেড। একই সঙ্গে
সুচি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি নিয়মতান্ত্রিক পদে পরিণত করতে চান।
সাংবিধানিকভাবে এটাও এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর
সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন
ধরে যে লিখিত সুবিধা ভোগ করে আসছে, তা রাতারাতি ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না।মিয়ানমারে
একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও
মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস-টেকজোটের সদস্য। বাংলাদেশের
পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এ দুটো জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও
মিয়ানমারে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায় দুদেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রফতানি করে
আমদানি করে তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৫
দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৬৭
মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে
এর পরিমাণ ছিল ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার বাংলাদেশের
জ্বালানি সুবিধার অন্যতম উৎস হতে পারে। বস্তুত একটি গণতান্ত্রিক সরকার
সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।প্রেসিডেন্ট
থেইন সেইন নির্বাচনে এনএলডির বিজয়কে স্বাগত জানালেও সুচির একটি বক্তব্য
একটি আশংকারও জন্ম দিয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল এশিয়ার সঙ্গে এক
সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রেসিডেন্ট নন।
তিনি একথাও বলেছেন, সংবিধান যদি তাকে সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাধা সৃষ্টি
করে, তাহলে একটি পথ বের করতেই হবে যাতে তিনি সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন।
সমস্যাটা এখানেই তৈরি হবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে
রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রিসভার প্রধান। সংবিধান পরিবর্তন না করে সুচির পক্ষে
মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। আর সংবিধান সংশোধনের কাজটিও সুচির জন্য
সহজ হবে না। সংসদের উভয় কক্ষে (আসন ৬৬৪) সেনাসদস্য রয়েছেন ১৬৬ জন। প্রয়োজন
তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন। কাজটি সুচির জন্য সত্যিই কঠিন। সুতরাং মিয়ানমারের
নির্বাচন থেকে এখনই সব প্রশ্নের জবাব মিলছে না।
Daily Jugantor
13 .11.15
মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্কা
16:27
No comments
দীর্ঘ ২৫ বছর পর মিয়ানমারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, ওই নির্বাচনে অং সান
সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের
পরও মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। মিয়ানমার একটি
পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে- এটা বিবেচনায় আনাও ঠিক হবে না।
কেননা সেনাবাহিনী এখনো সেখানে একটি 'রাজনৈতিক শক্তি'। একসময় ইন্দোনেশিয়ায়
সাবেক প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর জমানায় (১৯৬৬-৯৮) সেনাবাহিনী সেখানে এক ধরনের
'রাজনৈতিক ক্ষমতা' ভোগ করত, আজকের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই 'রাজনৈতিক
ক্ষমতা' ভোগ করছে। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে।
প্রশাসনে, অর্থনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব বিদ্যমান। একটি 'করপোরেট শক্তি' হিসেবে
(অনেকটা মিসরের মতো) সেনাবাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখছে। উপরন্তু মিয়ানমারে
বিভিন্ন রাজ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলন দমনে
সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডাররা স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী 'শক্তি'
হিসেবে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনএলডির সম্পর্ক
ভালো নয়। অং সান সু চির একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে, মিয়ানমারে অনেক রাজ্যেই
তাঁর দলের অবস্থান অনেক দুর্বল। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক
শক্তিশালী। ফলে অং সান সু চির দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে সত্য; কিন্তু
মিয়ানমারে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই
যাচ্ছে। সংসদের উভয় কক্ষেই সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আর এই সেনা
প্রতিনিধিত্ব, অর্থাৎ সংসদে সেনা প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেন সেনাপ্রধান। খুব
সংগত কারণেই সেনাপ্রধানের চিন্তা-চেতনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু তিনটি
মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো ভূমিকা
নেই। পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের
ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও অং সান
সু চির এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা থাকবে না। নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয়
অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল। অনেকটা 'আরব বসন্ত'-এর মতো জোয়ার এসেছে মিয়ানমারে।
কিন্তু এর ফলে মিয়ানমার একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে, এ কথাটা
নির্বাচনের আগেই প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এক টুইটার বার্তায় জানিয়ে
দিয়েছিলেন। এই প্রথমবারের মতো মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকল না সংসদে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়েও কথা থাকল। সুতরাং পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির
কারণে সেনাবাহিনী সম্ভবত ১৯৯০ সালের মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। অর্থাৎ
নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করে দেবে না। এখন এনএলডি নেতৃত্ব যদি সেনাবাহিনীর
ভূমিকা মেনে নেয়, তাহলে মিয়ানমারের 'গণতন্ত্র' একটি নয়া রূপ পাবে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি বা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এই দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনো তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশিকে বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হতে যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তাঁর বাবা ও মাকে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অনিশ্চিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৃতীয় বা দ্বিতীয় হন (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন) পরে তাঁদেরকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-৯৮) 'গোলকার' মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Represantative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জন, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আবারও প্রার্থী হবেন কি না তাও এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো। অং সান সু চির সঙ্গে তাঁর যদি সহাবস্থান হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অং সান সু চি সংসদে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সু চি যাঁকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করুন না কেন, সেনা সমর্থন না থাকলে তিনি বিজয়ী হতে পারবেন না। এ জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেনা সমর্থন নিয়েই সু চি নির্বাচন করেছেন। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সেখানে এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের ও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যদের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সু চিকে কিভাবে আনবে, তাও স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে! সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যাঁরা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তাঁরা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে এক হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শ শ রোহিঙ্গা নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তাঁর উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে 'পুশ-ইন' করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তাঁর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের 'সহাবস্থানে' গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি 'বিজয়ী' হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে শঙ্কা থাকলই।
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে সংস্কার চালু করেছিলেন, তার অংশ হিসেবেই এই নির্বাচনটি হলো। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আগ্রহ রয়েছে মিয়ানমারের ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে। দীর্ঘ ৫৩ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসনের পর মিয়ানমারের 'দুয়ার খুলে দেওয়া' হয়েছে। সু চিকে সামনে রেখেই পশ্চিমা শক্তি তাদের স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে। এ মুহূর্তে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই 'পরিবর্তন' মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যায় না। দুই. নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অং সান সু চির অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন না। যদিও তিনি আভাস দিয়েছেন, তাঁর ভূমিকা হবে 'প্রধানমন্ত্রীর ঊর্ধ্বে'। এ ব্যাপারেও কথা আছে। সংবিধানে এ ধরনের কোনো পদ নেই। একজন 'সিনিয়র মন্ত্রী' হিসেবে আপাতত তিনি প্রশাসনে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আস্থা যত দিন পাবেন তত দিন 'কোনো ঝামেলা ছাড়াই' তিনি প্রশাসনের অংশ থাকবেন। তিন. সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না। চার. জনগণই যে 'সকল ক্ষমতার উৎস'- মিয়ানমারের নির্বাচন এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। পাঁচ. এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর প্রথম টার্ম শেষ হবে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। একটি 'সমঝোতার' আলোকে তিনি দ্বিতীয় টার্মের জন্যও মনোনীত হতে পারেন। মিয়ানমারে দীর্ঘ ২৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো বটে; কিন্তু তাতে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই নির্বাচন মিয়ানমারে একটি 'আধা গণতন্ত্র' অথবা 'মিশ্র গণতান্ত্রিক' সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। Daily Kalerkontho 11.11.15
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি বা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এই দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনো তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশিকে বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হতে যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তাঁর বাবা ও মাকে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অনিশ্চিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৃতীয় বা দ্বিতীয় হন (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন) পরে তাঁদেরকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-৯৮) 'গোলকার' মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Represantative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জন, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আবারও প্রার্থী হবেন কি না তাও এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো। অং সান সু চির সঙ্গে তাঁর যদি সহাবস্থান হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অং সান সু চি সংসদে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সু চি যাঁকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করুন না কেন, সেনা সমর্থন না থাকলে তিনি বিজয়ী হতে পারবেন না। এ জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেনা সমর্থন নিয়েই সু চি নির্বাচন করেছেন। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সেখানে এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের ও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যদের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সু চিকে কিভাবে আনবে, তাও স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে! সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যাঁরা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তাঁরা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে এক হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শ শ রোহিঙ্গা নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তাঁর উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে 'পুশ-ইন' করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তাঁর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের 'সহাবস্থানে' গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি 'বিজয়ী' হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে শঙ্কা থাকলই।
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে সংস্কার চালু করেছিলেন, তার অংশ হিসেবেই এই নির্বাচনটি হলো। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আগ্রহ রয়েছে মিয়ানমারের ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে। দীর্ঘ ৫৩ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসনের পর মিয়ানমারের 'দুয়ার খুলে দেওয়া' হয়েছে। সু চিকে সামনে রেখেই পশ্চিমা শক্তি তাদের স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে। এ মুহূর্তে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই 'পরিবর্তন' মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যায় না। দুই. নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অং সান সু চির অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন না। যদিও তিনি আভাস দিয়েছেন, তাঁর ভূমিকা হবে 'প্রধানমন্ত্রীর ঊর্ধ্বে'। এ ব্যাপারেও কথা আছে। সংবিধানে এ ধরনের কোনো পদ নেই। একজন 'সিনিয়র মন্ত্রী' হিসেবে আপাতত তিনি প্রশাসনে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আস্থা যত দিন পাবেন তত দিন 'কোনো ঝামেলা ছাড়াই' তিনি প্রশাসনের অংশ থাকবেন। তিন. সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না। চার. জনগণই যে 'সকল ক্ষমতার উৎস'- মিয়ানমারের নির্বাচন এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। পাঁচ. এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর প্রথম টার্ম শেষ হবে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। একটি 'সমঝোতার' আলোকে তিনি দ্বিতীয় টার্মের জন্যও মনোনীত হতে পারেন। মিয়ানমারে দীর্ঘ ২৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো বটে; কিন্তু তাতে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই নির্বাচন মিয়ানমারে একটি 'আধা গণতন্ত্র' অথবা 'মিশ্র গণতান্ত্রিক' সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। Daily Kalerkontho 11.11.15
এরপর কী
17:18
No comments
জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে হত্যা প্রচেষ্টার পর যে প্রশ্নটি এখন অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এরপর কী? আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে, বাংলাদেশে পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে কবি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অভিনেতা! এটাও তো এক ধরনের আতঙ্কের খবর। এই সংবাদটিকে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দেব? হঠাৎ করেই যেন রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে গেল। দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যা, সর্বশেষ আশুলিয়ায় কনস্টেবলসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা, শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল শুরুর প্রাক্কালে গ্রেনেড হামলা, অতঃপর দীপনকে হত্যাÑ প্রতিটি বিষয়ের একটির সঙ্গে অন্যটির কোথায় যেন যোগসূত্র আছে! এতদিন বাংলাদেশে ব্লগার হত্যাকা-ের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর নাম আমরা জেনে এসেছি। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত এই নামটির কথাই বলা হচ্ছিল। যদিও ‘সাইট’ পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে এবার ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে একটি সংগঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট নয় যে, এ দুটি আলাদা সংগঠন, নাকি একই সংগঠন। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় আমাদের জন্য উদ্বেগের, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে প্রকাশক হত্যাকা-ের সঙ্গে আল কায়দার উপমহাদেশ শাখার জড়িত হওয়ার সংবাদটা। এতদিন আমরা জেনে এসেছি ‘ইসলামিক স্টেট’-এর খবর। এখন জানলাম আল কায়দার উপমহাদেশ শাখার কথা। এই যখন পরিস্থিতি তখন ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বললেন, ‘বিদেশে বসে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছেন খালেদা।’ আর তথ্যমন্ত্রী ৩ নভেম্বর আমাদের জানালেন, ‘লন্ডনে বসে খালেদা জিয়া-তারেক বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেনÑ এ তথ্য সরকারের কাছে আছে।’ সংবাদ দুটি আমাদের জন্যও উদ্বেগের। বাংলাদেশের কোনো শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন- এটা চিন্তাও করা যায় না! ফলে সামগ্রিকভাবেই জঙ্গিবাদের বিষয়টি এখন সামনে চলে আসছে। সর্বশেষ খবরে আশুলিয়ায় যে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হলো সেই হত্যাকা-ের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা জড়িত বলে সাইটের ওয়েবসাইটে আবারও উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে বারবার বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপতার সঙ্গে আইএসের জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। যদিও পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা আইএসের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। আর তাতে চাপা পড়ে যাচ্ছে চলমান রাজনীতির চালচিত্র। চাপা পড়ে যাচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিটিও। এই জঙ্গি কানেকশন, গুপ্তহত্যা, আইএস, আল কায়দা ইত্যাদি বিষয় এখন সামনে চলে এসেছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যখন প্রশ্নের মুখে তখন আমাদের দূতাবাস কর্মকর্তাদের এক ধরনের উদাসী ভূমিকা লক্ষণীয়। সরকারপ্রধান যেখানে বলছেন বাংলাদেশে আইএস নেই, সেখানে দূতাবাসগুলো এটা প্রচারে নিষ্ক্রিয়। সাইট তাদের পর্যবেক্ষণে বারবার বলছে এসব জঙ্গি সংগঠন অপতৎপরতার কথা। তাদের কর্মকা-ে আমাদের দেশের ‘সহনশীল ইসলাম’-এর ভাবমূর্তি যতটুকু নষ্ট হয়েছে, তা উদ্ধারে দূতাবাসের কর্মকর্তারা নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। তাই দূতাবাসগুলো পরিচালনায় নয়া নীতি প্রণয়ন করাও জরুরি।
পরপর দুই বিদেশি হত্যাকা-কে আমি যতটা না গুরুত্ব দিই (এমন একটা ঘটনা অতি সম্প্রতি ফিলিপাইনেও ঘটেছে), তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই মুক্তমনা এক প্রকাশককে হত্যা ও অপর একজনকে আহত করার ঘটনাকে। এই ঘটনা প্রমাণ করল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কত তৎপর আমাদের দেশে। আইএস আছে কী নেই, এ নিয়ে আমরা তর্ক করতেই পারি; কিন্তু তাতে করে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর অপতৎপরতা আমরা বন্ধ করতে পারব না। আজ দরকার শুভবুদ্ধির মানুষের মধ্যে ঐক্য। আমাদের মধ্যে যদি বিভক্তি থাকে, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে আমরা যদি সব সময় কোণঠাসা অবস্থায় রাখি, তাহলে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ থেকে সুবিধা নেবে। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া প্রতিটি হত্যাকা-ের বিচার হোক। দীপনের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে আমরা যেন তাভেল্লা হত্যাকা-কে ভুলে না যাই। আমাদের স্বার্থেই প্রতিটি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। বিশেষ করে দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের হৃদয়ছোঁয়া সেই বক্তব্য- ‘আমি বিচার চাই না’ কিংবা একই সুরে অভিজিতের স্ত্রী বন্যা যখন জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে কথা বলেন, তখন নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়ে বৈকি! ইতোমধ্যে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে, ব্লগার হত্যায় বিদেশ থেকে অর্থ দিচ্ছেন ১০ বাংলাদেশি! এই সংবাদটাও আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের। আমরা বারবার বলে আসছি, জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে অর্থের একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং এই অর্থ বিভিন্ন চ্যানেলে বিদেশ থেকে আসছে। এখন গোয়েন্দারা যদি এই নেটওয়ার্কটি চিহ্নিত করতে পারেন- এটা আমাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। যে ১০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের স্থানীয় এজেন্টদেরও চিহ্নিত করা হোক। এদের চিহ্নিত করে এই নেটওয়ার্কটি যদি ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে জঙ্গি তৎপরতা অনকাংশে কমে যেতে পারে। পাঠকদের এখানে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাইÑ ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দুটি এনজিওকে চিহ্নিত করেছিল, যারা বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় অর্থায়ন করে। এই দুটি সংগঠন হচ্ছে এষড়নধষ জবষরবভ ঋড়ঁহফধঃরড়হ ও অষ-ঐধৎসধরহ। এ দুটি সংগঠনের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছেÑ এই অভিযোগ তুলে এদের কর্মকা-ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। ধারণা করছি বাংলাদেশে বর্তমানে এই দুটি সংগঠনের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। তবে এরা ভিন্ন নামে আবির্ভূত হতে পারেÑ এটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একটি বিতর্কিত সংগঠন। ব্লগারদের হত্যাকা-ের সঙ্গে এই সংগঠনের জড়িত থাকার কথা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ। তারপরও তাদের অপতৎপরতা বাড়ছে। লালমাটিয়া একটি সম্ভ্রান্ত এলাকা। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির এখানে বসবাস। সেখানে যদি জঙ্গিরা এক প্রকাশককে কুপিয়ে আহত করে, তাহলে আমাদের নিরাপত্তার জায়গাটা আর থাকল কই? ঠিক একই কথা প্রযোজ্য আজিজ সুপার মার্কেটের ক্ষেত্রে। প্রচুর লোকজন এখানে থাকেন সব সময়। উপরন্তু ওই এলাকায় সিসি ক্যামেরা ছিল বলে মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে। তাহলে ওখানে জঙ্গিরা পার পেয়ে যায় কীভাবে? তাহলে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার যা বলেছেন সেটিই কি সত্য? তার অভিযোগÑ ‘সরকারের ভেতরের একটা অংশের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে এই জঙ্গি হামলায়!’ এর পেছনে সত্যতা হয়তো নেই। কিন্তু ইমরান এইচ সরকার যখন এ ধরনের অভিযোগ করেন তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমে কিছুটা শৈথিল্য এসেছে। তারা মূল কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজে নিজেরা বেশি জড়িয়ে পড়েছেন। আজ নিরাপত্তাহীন সবাই। খোদ আমাদের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমিও বিপদমুক্ত নই!’ এ কথা বলে তিনি কী মেসেজ দিয়েছেন, তা আমি বুঝতে অক্ষম। তবে যে কজন মন্ত্রী জঙ্গিবাদ নিয়ে সব সময় কথা বলেন, তার মধ্যে আমাদের তথ্যমন্ত্রী অন্যতম। জঙ্গিবাদের সঙ্গে তিনি প্রধান বিরোধী দলের ‘সম্পর্ক’ সব সময় খুঁজে পান! তার প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা থাকে। তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন, একই সঙ্গে আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা জঙ্গিবাদ নিয়ে এমন সব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যে দিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশে ‘কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ফোর্স’কে আরও শক্তিশালী করা, দক্ষ তরুণ অফিসারদের এখানে নিয়োগ দেওয়া, তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। গোয়েন্দা কার্যক্রমে শৈথিল্য রয়েছে- বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছুদিন থাকল। তারপর তৎপরতা থেমে গেল- এমনটি যেন না হয়। যদি আইএস বা আল কায়দা থেকে থাকে, তা স্পষ্ট করা হোক। জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানারকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
হয়তো তারা প্রস্তুত হচ্ছে; পরবর্তী টার্গেট ঠিক করছে! আর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে পরবর্তী টার্গেট হবেন মুক্তচিন্তার যে কোনো বুদ্ধিজীবী। জঙ্গি কার্যক্রম পুলিশি তৎপরতার কারণে থেমে থাকবে- এটা আমার মনে হয় না। এই দানবের হাত থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। তাই প্রয়োজন জনসচেতনতার। প্রয়োজন সন্ত্রাস প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য। এ ক্ষেত্রে ‘ব্লেমগেম’-এর রাজনীতি জঙ্গিদের হাতকে আরও শক্তিশালী করবে মাত্র। কোনো বড় দল যদি সত্যি সত্যিই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে, আমরা চাইব ওই দলগুলো নিষিদ্ধ করা হোক। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মে কোনো জঙ্গিবাদের সুযোগ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সেখানে তিনি সুরা আন আমের ১৫১নং আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে- ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না।’ ফলে উগ্রপন্থীরা ইসলামের নামে ‘গলা কেটে’ যাদের হত্যা করছে, এ ধরনের হত্যাকা-কে ইসলাম সমর্থন করে না। যারা এ ধরনের কাজ করছে তারা বিভ্রান্ত। তারা দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। এই বিষয়গুলো আজ ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। দীপন হত্যার পর এক সপ্তাহ ধরে টিভি চ্যালেনগুলো এটা নিয়ে অনেক টক শো করেছে। শুধু একটি চ্যানেলে (সময় টিভি) আমি দেখলাম ইসলামিক চিন্তাবিদদের এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ ধরনের অনুষ্ঠান আরও হওয়া উচিত, যাতে করে যারা বিভ্রান্ত তারা মূল ধারায় ফিরে আসতে পারে। জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ একটা ফ্যাক্টর। আমার ধারণা জঙ্গিদের কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে। এটা বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আমরা নিশ্চিত হতে চাই যারা শিক্ষকতা করি, সংবাদপত্রের কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী বা কেউ অভিনয় করি; আমরা কেউই জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেটে পরিণত হব না। ইসলাম মানবতার ধর্ম, শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম পালনে, বিশ্বাসে আততায়ীর গুলি আমাকে যেন নিবৃত্ত না রাখে। বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি আমরা সবাই চাই। রাষ্ট্র আমাদের এটুকু নিশ্চয়তা দেবে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
Daily Amader Somoy
08.11.15
নির্বাচন মিয়ানমারকে কোথায় নিয়ে যাবে?
17:07
No comments
আজ ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ
নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে প্রত্যাশা অনেক
বেশি। অভ্যন্তরীণভাবে মনে করা হচ্ছে, দীর্ঘ ২৫ বছর পর গণতান্ত্রিকভাবে যে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে করে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ
প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মনে করছে, এ
নির্বাচনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন
ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিজয়ী হবে এবং সু চি সরকার গঠন করতে
সক্ষম হবেন। বলা ভালো, এর আগে ২০১০ সালে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ওই নির্বাচনের
আগে দল নিবন্ধন না করায় এনএলডি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। পরে অবশ্য
উপনির্বাচনে দল নিবন্ধন সম্পন্ন করে সু চির দল সংসদে ফিরে এসেছিল এবং সু চি
নিজেও সংসদে ছিলেন। তবে ১৯৯০ সালে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ওই
নির্বাচনই গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া সর্বশেষ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে
এনএলডি ৮০ দশমিক ৮০ ভাগ ভোট ও ৩৯২টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু এনএলডিকে
সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। বরং নির্বাচনটি বাতিল ঘোষিত হয়েছিল।
১৯৯০ সালের নির্বাচনের একটা প্রেক্ষাপট আছে। ১৯৮৮ সালে
দেশব্যাপী গণতন্ত্রকামী মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী
১৮ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। তবে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী কর্তৃক
ক্ষমতা দখলের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন প্রথমবারের মতো
সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি গঠন করেছিলেন বার্মিজ
সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি)। বিএসপিপি মিয়ানমারে সমাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে Burmese Way to Socialism নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা
করেছিল। ১৯৬৪ সালে সেখানে বিএসপিপি বাদে অন্যসব দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।
কিন্তু গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ১৯৮৮ সালে
সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং গঠন করে State Law and Order
Restoration Council (SLORC)। মজার ব্যাপার হল, অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের
মাথায় ১৯৮৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সু চি এনএলডি গঠন করেন। এর আগে
গণঅভ্যুত্থান যখন সংঘটিত হচ্ছে, তখন অসুস্থ মাকে দেখার নাম করে সু চি দীর্ঘ
প্রবাস জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায়
তিনি রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।স্বাধীনতা-পরবর্তী
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই
সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই
প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা
হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল
ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন
সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
এখনও তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু
চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের
লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের
আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশীকে
বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হওয়ার
যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তার বাবা ও মাকে মিয়ানমারে
জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করতে পারছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী
হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করে সংসদ।
এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় হন (তিনজন
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন), পরে তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে
সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো
জমানার (১৯৬৬-১৯৯৮) গোলকার মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট
দুকক্ষবিশিষ্ট-House of Representative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও
House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিুকক্ষের সদস্য
সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জনের। তাদের নিয়োগ দেন
সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর।
এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে
ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু।
কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭
থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১
সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২
সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন।২০১০
সালে গঠিত সংসদের উভয়কক্ষে সেনাবাহিনী সমর্থিত ও থেইন সেইনের নেতৃত্বাধীন
এসপিডিসির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। নিুকক্ষে এ দলের আসন ছিল ২১৯, আর
উচ্চকক্ষে ১২৪। এর ওপরে ছিল সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন। সে ক্ষেত্রে
উপনির্বাচনে নিুকক্ষে (২০১২) সু চির দলের ৪৩ আসন কোনো বড় ধরনের বিরোধী দলের
ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কিন্তু এবার কি দৃশ্যপট পাল্টে যাবে?
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এবার এনএলডিপির জন্য একটি বড় ধরনের গণজোয়ারের
সৃষ্টি হয়েছে। এই গণজোয়ার কি সু চিকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে? এখানে অনেক
প্রশ্ন আছে। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা
বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল
ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। সে ক্ষেত্রে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হলেও
ক্ষমতার ভারসাম্যে কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তার
সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিুকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট
সেনা সদস্যের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী চাইবে বিকল্প
একজন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো
পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। তবে সু চি অনেকদিন ধরেই চাচ্ছেন সেনাবাহিনীর
সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যারা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য
অনুসরণ করছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি।
কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়।মিয়ানমারের
রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর।
সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা
বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের
ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১
হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয়কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল)
একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী
দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন রাজ্যে সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু
রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে
থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা এবং শত শত
রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই।
মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার
মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই
রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী
বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছে। সু চি এ
প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের
হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে পুশইন
করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো
সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।প্রতিবেশী
মিয়ানমারের এ নির্বাচন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
দেশটিতে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার আমাদের কাম্য। মিয়ানমারকে আমাদের আস্থায়
নিতে হবে। এবং সেটা করতে হবে আমাদের স্বার্থেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে
মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও
উত্তরে ভারত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। বলাই
বাহুল্য, মিয়ানমারের এ ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তাতে করে
বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয়, বরং মিয়ানমার
সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে।
(বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে)। ঘুমধুম-মুসে হাইওয়ে চালু হলে
সড়কপথেই চীনে যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশী
এলাকা। আর মুসে হচ্ছে চীনের সীমান্ত শহর।বাংলাদেশ-মিয়ানমার
সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC,
পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) ও বিসিআইএম জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত বিসিআইএম
জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ
জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এ জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার,
শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা।
মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক
ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে
বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম
এলাকায় বেশকিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে
পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও
চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে
সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে।
মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে
দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ে অঞ্চলে প্রচুর তুলা উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা
মিয়ানমারের এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও
রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে।
মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা
মেটাতে পারে এ সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে
আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর,
যেমন- রুবি, জেড, মার্বেল ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের
জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে
সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে
বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর
সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এ গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের
আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে
সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি
করা সম্ভব হবে।বলার অপেক্ষা রাখে না,
বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি
গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক
গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা সমস্যা আছে বটে; কিন্তু দ্বিপাক্ষিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা কোনো সমস্যা তৈরি হবে না, এটাই প্রত্যাশা করি। এ
কারণেই এ নির্বাচনের গুরুত্ব আমাদের জন্যও বেশি। তবে এ নির্বাচন মিয়ানমারকে
কতটুকু স্থিতিশীলতায় আনতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের আগে
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তি
চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আরও ৭টি সশস্ত্র গোষ্ঠী।
সুতরাং এ নিয়েও একটি প্রশ্ন থেকে যাবে। শান্তি চুক্তিতে একটি ফেডারেল
রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে নির্বাচনের পর নয়া
সরকার এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়।নির্বাচনকে
কেন্দ্র করে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ- এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আশংকা
প্রকাশ করেছেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় আরব বসন্তের মতো
রক্তপাত ও চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এ
ধরনের আশংকা ব্যক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি একটি ইঙ্গিত দিলেন।
মিয়ানমার নির্বাচনের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে
চায়। সু চি যদি এ প্রক্রিয়ার অংশ না হন, তাহলে সেনাবাহিনী এটা মেনে নেবে
না। দুই. এটা সত্য, সু চি এ মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্যতম একটি শক্তি।
নির্বাচনে তিনি যদি বিজয়ী হন, তাহলে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা অ্যালায়েন্স
গড়ে তুলতে পারেন। তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মিয়ানমারে
সেনাবাহিনীর যে কর্পোরেট ইন্টারেস্ট গড়ে উঠছে, তা সহজে ভাঙবে না।
রাজনীতিতে তাদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচন তাতে কোনো
পরিবর্তন ডেকে আনবে না।
Daily Jugantor
08.11.15
Subscribe to:
Posts (Atom)