মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিজয় এবং ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং থøাইং কর্তৃক এই রায় মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসল তা হচ্ছে মিয়ানমারে কি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পরও এমন একটি সম্ভাবনার জš§ হয়েছিল। ওই নির্বাচনেও অং সান সুচির দল বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী ওই নির্বাচন মেনে নেয়নি। বরং নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে অং সান সুচিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আজ ২৫ বছর পর এমন একটি সম্ভাবনার জš§ হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও, আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আরো বেশি ‘কমিটেড।’ ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকায় এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে সংশয় যে নেই, তাও বলা যাবে না। সংশয়, উদ্যোগ এবং নানা প্রশ্নও আছে। অং সান সুচি বলেছেন ‘তার ভূমিকা হবে প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বে।’ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। সংবিধান তিনি পরিবর্তনও করতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, সংবিধান তাকে মানতে হবে এবং সংবিধান মানলে তাকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে (২০১৬, মার্চ) মানতে হবে। ফলে সুচি যদি ‘জোর করে’ কিছু করতে চান, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে এবং তাতে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে যাবেন, যা মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য কোন ভালো খবর বয়ে আনবে না। তাহলে তার ভূমিকা কি হবে? তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কেননা সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি অবলুপ্ত করা হয়েছে। সঙ্গতকারণেই প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এনএলডিকে নিয়েই সরকার গঠন করবেন। সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ও ক্যাবিনেটে সভাপতিত্ব করবেন। মন্ত্রিসভায় এনএলডির মন্ত্রী থাকলেও মূল ব্যক্তি হবেন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন, অং সান সুচি নন। এ ক্ষেত্রে সুচির জন্য প্রশাসনিক আদেশে প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় একটি পদ সৃষ্টি করা হতে পারে! অথবা সুচি মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়েও পর্দার অন্তরালে (অনেকটা ভারতে সোনিয়া গান্ধীর মতো) থেকে মন্ত্রিসভা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে সুচিকে যেভাবে মানুষ দেখেছে, নির্বাচনের পর মানুষ দেখছে ভিন্নভাবে। তিনি বিদেশি গণমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিয়ে যেভাবে নিজের মনোভাবকে তুলে ধরছেন, তা তার কর্তৃত্ববাদী মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। যেখানে তার উচিত ছিল একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা, ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া, এটা না করে তিনি এক ধরনের ‘হুমকির সুরে’ সরকার পরিচালনার কথা বলছেন। গণতন্ত্রের নামে এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা কোনো কোনো দেশে লক্ষ্য করি। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীন জোট গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের জš§ দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে একদলীয় (পিপলস অ্যাকশন পার্টি) শাসন বজায় রয়েছে। যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্পুচিয়ায় সমাজতন্ত্র পরবর্তী কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বর্তমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তার নামেই তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। আমরা বেলারুশের কথাও বলতে পারি। এখানে নির্বাচন হচ্ছে বটে, কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নেয়া হচ্ছে। এখন অং সান সুচি কী এ পথেই যাচ্ছেন? ক্ষমতা নিতে হলে তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে এটা মনে হয় না। জনগণই যে ‘সকল ক্ষমতার উৎস’ মিয়ানমারের নির্বাচন এই কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পরবর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। দেশটিতে এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। অর্থাৎ জানুয়ারিতে যখন সংসদ গঠিত হবে, তারপর ২০২০ সাল পর্যন্ত এই সংসদ টিকে থাকার কথা। সময়টা অনেক লম্বা। নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার আগে এখন অন্তত এক মাস সময় থাকবে হাতে। সুচি এই সময়টা কাজে লাগাবেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি ‘সমঝোতায়’ যেতে। সম্ভবত এটাই তার জন্য শেষ সময়। ২০১০ সালেও একটি নির্বাচন হয়েছিল। তার দল ঠিক সময়মতো নিবন্ধন করতে না পারায় অথবা নিবন্ধন না করায় ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন সুচি। এবারো যদি তিনি ভুল করেন, তাহলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২০ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক বেশি। সুচির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে তখন ৭৪। এরপর তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। সে কারণেই তিনি মিয়ানমারের সমাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মেনে নেবেন। আমরা তার নির্বাচন বিজয়ে স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সড়ক পথ চালু হলে এই সড়ক পথে একদিকে যেমনি আমাদের চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। অন্যদিকে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও যেতে পারব। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ, পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোট যোগ দেয়ায় এই জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদী রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্টস সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফানির্চার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফানির্চার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর যেমন রুবি, জেড, বোম আর মার্বেল সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালুএভিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপ লাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা ‘সমস্যা’ আছে বটে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কোনো সমস্যা তৈরি হবে না এটাই প্রত্যাশা করি। এ কারণেই এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। এই নির্বাচন মিয়ানমারকে কতটুকু স্থিতিশীলতা আনতে পারবে সে প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আরো ৭টি সশস্ত্র গোষ্ঠী। সুতরাং একটি প্রশ্ন থাকলই। শান্তিচুক্তিতে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে নির্বাচনের পর নয়া সরকার এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপর্ূূ। এক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় আরব বসন্তের মতো রক্তপাত ও চরম বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হতে পারে।’ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। এটা দিয়ে তিনি একটি ইঙ্গিত দিলেন। মিয়ানমার নির্বাচনের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সুচি যদি ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ না নেন, তাহলে সেনাবাহিনী এটা মেনে নেবে না। দুই. এটা সত্য, সুচি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্যতম একটি শক্তি। তিনি নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আগামী জানুয়ারিতে যখন সংসদ বসবে তখন একটি এনএলডি মন্ত্রিসভা গঠন করে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে পারেন। তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর যে কর্পোরেট ইন্টারেস্ট গড়ে উঠছে, তা সহজে ভাঙবে না। রাজনীতিতে তাদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচন তাতে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনল না।
Daily Manobkontho
14.11.15
0 comments:
Post a Comment