আজ দরকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে ঐক্য। আমাদের মধ্যে যদি বিভক্তি থাকে, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে আমরা যদি সব সময় কোণঠাসা অবস্থায় রাখি, তাহলে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ থেকে সুবিধা নেবে। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া প্রতিটি হত্যাকা-ের বিচার হোক। দীপনের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে আমরা যেন তাবেলা হত্যাকা-কে ভুলে না যাই। আমাদের স্বার্থেই প্রতিটি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।তারেক শামসুর রেহমান একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু কোনো একটা ঘটনারও কূলকিনারা আমরা করতে পারছি না। ইতালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজারের হত্যাকা-ের সঙ্গে নির্দেশদাতা হিসেবে জড়িত একাধিক বড় ভাইয়ের নাম ও পরিচয় নিয়ে যখন গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে, ঠিক তখনই কুপিয়ে হত্যা করা হলো বস্নগার ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে, আর আহত করা হলো আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে। আরো একবার আমরা লক্ষ্য করলাম ঝওঞঊ বস্নগারদের হত্যা ও আহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদার স্থানীয় শাখা আনসার আল ইসলাম জড়িত বলে উল্লেখ করেছে। প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার জড়িত হওয়ার সংবাদকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। প্রথমে একজন সাধারণ ইতালিয়ান নাগরিক, এরপর জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হলো। তারপর শিয়াদের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল শুরু করার প্রাক্কালে মিছিলে গ্রেনেড হামলা_ এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সবই একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার একটি ষড়যন্ত্র।
কাকতালীয়ভাবে এটা সত্য, বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে যখন গ্রেনেড হামলা চালানো হলো, ঠিক একই সময়ে পাকিস্তানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলা চালিয়ে সেখানে ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পাকিস্তানে শিয়া-সুনি্ন দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কিন্তু এ অঞ্চলের গত সাড়ে তিন শ' বছরের ইতিহাসে কখনো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়নি। পাকিস্তানে শিয়া ও সুনি্নদের মধ্যে বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও হামলার ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি নেই। বাংলাদেশে শিয়া ও সুনি্ন সম্প্রদায় একত্রিত হয়েই কারবালার সেই বিয়োগান্ত ইতিহাস স্মরণ করে। আমাদের এ দেশে তাজিয়া মিছিলে সুনি্নদের অংশগ্রহণও স্বতঃস্ফূর্ত। যে কিশোরটি বোমা হামলায় মারা গেল, সেও একজন সুনি্ন মতাবলম্বী, সে শিয়া সম্প্রদায়ের নয়। এ ধরনের বোমা হামলা কী ইঙ্গিত করে? কোনো পক্ষ কি চাচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে ২০০৮ সালের পর থেকে পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মাঝে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্তদের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ ভাগ। বাংলাদেশে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের মানুষ কে সুনি্ন, কে শিয়া_ এ বিভাজনটা কখনো করেনি। পাকিস্তানে নূ্যনতম চারটি জঙ্গি সুনি্ন সংগঠনের খবর পাওয়া যায়, যারা সরাসরিভাবে শিয়াদের ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী। এগুলো হচ্ছে লস্করই জানভি, সিপাহি সাহাবা, তেহরিকে তালিবান ও জুনদুল্লাহ। বাংলাদেশে এ রকমটি নেই। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শিয়া মতাবলম্বীরা আদৌ ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিনা, এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকলেও (যেমন জর্ডানের শতকরা ৪৩ জন মানুষ মনে করে শিয়ারা মুসলমান নন। তিউনিসিয়ায় এ সংখ্যা ৪১ আর মরক্কোয় ৫০) বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো বিভ্রান্তি নেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, হঠাৎ করে শিয়াদের ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিলে এ হামলা কেন হলো? তাই নিশ্চিত করেই বলা যায় এ হামলার সঙ্গে ইতালিয়ান, জাপানি ও এএসআই হত্যাকা-ের একটা যোগসূত্র আছে_ অর্থাৎ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে যখন এক ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তখন হঠাৎ করে কারা, কোন উদ্দেশ্যে এ অস্থিরতা সৃষ্টি করছে? এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশের প্রশ্নটিও সামনে চলে এলো। একটি পক্ষ তারা অভ্যন্তরীণ হতে পারে, তাদের সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগসাজশ থাকতে পারে, তারা দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে 'ফায়দা' ওঠাতে চায়। এ অভ্যন্তরীণ শক্তির সঙ্গে কি আইএসের (ইসলামিক স্টেট) কিংবা আল-কায়েদার কোনো যোগাযোগ রয়েছে? পাঠক লক্ষ্য করবেন, ঝওঞঊ পর্যবেক্ষণ সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রথম দুটি ঘটনায় শুধু আইএসের কথা বলা হয়েছে। আল-কায়েদার কোনো বক্তব্য উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার বর্তমান নেতা জাওয়াহিরির একটি টেপ বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, এ উপমহাদেশে (মিয়ানমারসহ) আল-কায়েদার একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে (আল-কায়েদা এভাবেই বিভিন্ন দেশে তাদের অপারেশন পরিচালনা করে যেমন অষ-ছধবফধ রহ অৎধনরধহ চবহরহংঁষধ, অষ-ছধবফধ রহ ওংষধসরপ গধমৎবন)। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্ক থাকতে পারে! কিন্তু আইএস এভাবে তাদের কোনো অপারেশন পরিচালনা করে না। এবং মুসলিমপ্রধান দেশে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন করেছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তাদের স্ট্র্যাটেজিতে এ ধরনের সম্পর্কের কোনো ইতিহাস নেই। তবে সমর্থক থাকতে পারে। কেনিয়া, সোমালিয়া কিংবা নাইজেরিয়ায় কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠন (যেমন বোকো হারাম, আনসারু কিংবা আল শাবাব), যারা সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে, তাদের আমরা আইএসের সমর্থক হতে দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো জঙ্গি সংগঠন নেই, যারা সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে। সুতরাং আইএস বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন করেছে, এ রকম তথ্য আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একটি বিতর্কিত সংগঠন। বস্নগারদের হত্যাকা-ের সঙ্গে এ সংগঠনের জড়িত থাকার কথা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ। তার পরও তাদের অপতৎপরতা বাড়ছে। লালমাটিয়া একটি সম্ভ্রান্ত এলাকা। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির এখানে বসবাস। সেখানে যদি জঙ্গিরা একজন প্রকাশককে কুপিয়ে আহত করে, তাহলে আমাদের নিরাপত্তার জায়গাটা আর থাকল কই? ঠিক একই কথা প্রযোজ্য আজিজ সুপার মার্কেটের ক্ষেত্রে। প্রচুর লোক এখানে থাকে সব সময়। উপরন্তু ওই এলাকায় সিসি ক্যামেরা ছিল বলে মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে। তাহলে এখানে জঙ্গিরা পার পেয়ে যায় কিভাবে? তাহলে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার যা বলেছেন, সেটাই কি সত্য? তার অভিযোগ সরকারের ভেতরের একটা অংশের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে এ জঙ্গি হামলায়। এর পেছনে সত্যতা হয়তো নেই। কিন্তু ইমরান এইচ সরকার যখন এ ধরনের অভিযোগ করেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমে শৈথিল্য এসেছে। তারা মূল কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজে নিজেদের বেশি জড়িয়ে ফেলেছে। আজ নিরাপত্তাহীন সবাই। খোদ আমাদের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'আমিও বিপদমুক্ত নই'। এ কথা বলে তিনি কী মেসেজ দিয়েছেন, আমি বুঝতে অক্ষম। তবে যে কজন মন্ত্রী জঙ্গিবাদ নিয়ে সব সময় কথা বলেন, তার মাঝে আমাদের তথ্যমন্ত্রী অন্যতম। জঙ্গিবাদের সঙ্গে তিনি প্রধান বিরোধী দলের 'সম্পর্ক' সব সময় খুঁজে পান। তার প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা থাকে। তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জঙ্গিবাদ নিয়ে এমনসব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যেদিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকটের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশে 'কাউটার ইন্টেলিজেন্স' ফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা। দক্ষ তরুণ অফিসারদের এখানে নিয়োগ দেয়া। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেয়া। গোয়েন্দা কার্যক্রমে শৈথিল্য রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছু দিন থাকল। তারপর তৎপরতা থেমে গেল_ এমনটি যেন না হয়। যদি আইএস (বা আল-কায়েদা) থেকে থাকে তা স্পষ্ট করা হোক। জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
আমরা জানি না এসব অপতৎপরতার শেষ কোথায়। একের পর এক ঘটনা ঘটছে এবং তাতে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। মানুষ যে স্বস্তিতে আছে, তা বলা যাবে না। আমরা চাই না এ ধরনের আরেকটি ঘটনার জন্ম হোক এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে থাকুক। আমি দুঃখজনকভঅবে লক্ষ্য করেছি, জঙ্গি প্রশ্নে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে যখন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তখন আমাদের দূতাবাসের (বিশেষ করে ওয়াশিংটনে ও জাতিসংঘে) কর্মকা- খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলাদেশে যে আইএস নেই, এটা প্রমাণে তাদের কর্মকা-কে আমি গুরুত্ব দিই। ঝওঞঊ-এর কর্মকা-ে আমাদের দেশের 'সহনশীল ইসলাম'-এর ভাবমূর্তি কতটুকু নষ্ট হয়েছে, তা উদ্ধারে দূতাবাসের কর্মকর্তারা নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। তাই দূতাবাসগুলো পরিচালনায় নয়া নীতি প্রণয়ন করাও জরুরি।
পরপর দুজন বিদেশি হত্যাকা-কে আমি যতটা না গুরুত্ব দিই (এমন ঘটনা অতি সম্প্রতি ফিলিপাইনেও ঘটেছে), তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই মুক্তমনা একজন প্রকাশককে হত্যা ও অন্য একজনকে আহত করার ঘটনাকে। এ ঘটনা প্রমাণ করল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কত তৎপর আমাদের দেশে। আইএস আছে কি নেই, এ নিয়ে আমরা তর্ক করতেই পারি। কিন্তু তাতে আমরা এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর অপতৎপরতা বন্ধ করতে পারব না। আজ দরকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে ঐক্য। আমাদের মধ্যে যদি বিভক্তি থাকে, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে আমরা যদি সব সময় কোণঠাসা অবস্থায় রাখি, তাহলে এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ থেকে সুবিধা নেবে। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া প্রতিটি হত্যাকা-ের বিচার হোক। দীপনের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে আমরা যেন তাবেলা হত্যাকা-কে ভুলে না যাই। আমাদের স্বার্থেই প্রতিটি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।
Daily Jai Jai Din
05.11.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment