দীর্ঘ ২৫ বছর পর মিয়ানমারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, ওই নির্বাচনে অং সান
সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের
পরও মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। মিয়ানমার একটি
পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে- এটা বিবেচনায় আনাও ঠিক হবে না।
কেননা সেনাবাহিনী এখনো সেখানে একটি 'রাজনৈতিক শক্তি'। একসময় ইন্দোনেশিয়ায়
সাবেক প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর জমানায় (১৯৬৬-৯৮) সেনাবাহিনী সেখানে এক ধরনের
'রাজনৈতিক ক্ষমতা' ভোগ করত, আজকের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই 'রাজনৈতিক
ক্ষমতা' ভোগ করছে। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে।
প্রশাসনে, অর্থনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব বিদ্যমান। একটি 'করপোরেট শক্তি' হিসেবে
(অনেকটা মিসরের মতো) সেনাবাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখছে। উপরন্তু মিয়ানমারে
বিভিন্ন রাজ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলন দমনে
সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডাররা স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী 'শক্তি'
হিসেবে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনএলডির সম্পর্ক
ভালো নয়। অং সান সু চির একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে, মিয়ানমারে অনেক রাজ্যেই
তাঁর দলের অবস্থান অনেক দুর্বল। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক
শক্তিশালী। ফলে অং সান সু চির দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে সত্য; কিন্তু
মিয়ানমারে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই
যাচ্ছে। সংসদের উভয় কক্ষেই সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আর এই সেনা
প্রতিনিধিত্ব, অর্থাৎ সংসদে সেনা প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেন সেনাপ্রধান। খুব
সংগত কারণেই সেনাপ্রধানের চিন্তা-চেতনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু তিনটি
মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো ভূমিকা
নেই। পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের
ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও অং সান
সু চির এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা থাকবে না। নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয়
অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল। অনেকটা 'আরব বসন্ত'-এর মতো জোয়ার এসেছে মিয়ানমারে।
কিন্তু এর ফলে মিয়ানমার একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে, এ কথাটা
নির্বাচনের আগেই প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এক টুইটার বার্তায় জানিয়ে
দিয়েছিলেন। এই প্রথমবারের মতো মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকল না সংসদে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়েও কথা থাকল। সুতরাং পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির
কারণে সেনাবাহিনী সম্ভবত ১৯৯০ সালের মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। অর্থাৎ
নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করে দেবে না। এখন এনএলডি নেতৃত্ব যদি সেনাবাহিনীর
ভূমিকা মেনে নেয়, তাহলে মিয়ানমারের 'গণতন্ত্র' একটি নয়া রূপ পাবে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি বা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এই দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনো তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশিকে বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হতে যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তাঁর বাবা ও মাকে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অনিশ্চিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৃতীয় বা দ্বিতীয় হন (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন) পরে তাঁদেরকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-৯৮) 'গোলকার' মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Represantative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জন, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আবারও প্রার্থী হবেন কি না তাও এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো। অং সান সু চির সঙ্গে তাঁর যদি সহাবস্থান হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অং সান সু চি সংসদে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সু চি যাঁকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করুন না কেন, সেনা সমর্থন না থাকলে তিনি বিজয়ী হতে পারবেন না। এ জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেনা সমর্থন নিয়েই সু চি নির্বাচন করেছেন। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সেখানে এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের ও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যদের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সু চিকে কিভাবে আনবে, তাও স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে! সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যাঁরা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তাঁরা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে এক হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শ শ রোহিঙ্গা নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তাঁর উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে 'পুশ-ইন' করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তাঁর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের 'সহাবস্থানে' গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি 'বিজয়ী' হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে শঙ্কা থাকলই।
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে সংস্কার চালু করেছিলেন, তার অংশ হিসেবেই এই নির্বাচনটি হলো। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আগ্রহ রয়েছে মিয়ানমারের ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে। দীর্ঘ ৫৩ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসনের পর মিয়ানমারের 'দুয়ার খুলে দেওয়া' হয়েছে। সু চিকে সামনে রেখেই পশ্চিমা শক্তি তাদের স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে। এ মুহূর্তে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই 'পরিবর্তন' মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যায় না। দুই. নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অং সান সু চির অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন না। যদিও তিনি আভাস দিয়েছেন, তাঁর ভূমিকা হবে 'প্রধানমন্ত্রীর ঊর্ধ্বে'। এ ব্যাপারেও কথা আছে। সংবিধানে এ ধরনের কোনো পদ নেই। একজন 'সিনিয়র মন্ত্রী' হিসেবে আপাতত তিনি প্রশাসনে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আস্থা যত দিন পাবেন তত দিন 'কোনো ঝামেলা ছাড়াই' তিনি প্রশাসনের অংশ থাকবেন। তিন. সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না। চার. জনগণই যে 'সকল ক্ষমতার উৎস'- মিয়ানমারের নির্বাচন এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। পাঁচ. এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর প্রথম টার্ম শেষ হবে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। একটি 'সমঝোতার' আলোকে তিনি দ্বিতীয় টার্মের জন্যও মনোনীত হতে পারেন। মিয়ানমারে দীর্ঘ ২৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো বটে; কিন্তু তাতে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই নির্বাচন মিয়ানমারে একটি 'আধা গণতন্ত্র' অথবা 'মিশ্র গণতান্ত্রিক' সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। Daily Kalerkontho 11.11.15
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি বা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এই দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনো তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশিকে বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হতে যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তাঁর বাবা ও মাকে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অনিশ্চিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৃতীয় বা দ্বিতীয় হন (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন) পরে তাঁদেরকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-৯৮) 'গোলকার' মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Represantative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জন, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আবারও প্রার্থী হবেন কি না তাও এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো। অং সান সু চির সঙ্গে তাঁর যদি সহাবস্থান হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অং সান সু চি সংসদে তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সু চি যাঁকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করুন না কেন, সেনা সমর্থন না থাকলে তিনি বিজয়ী হতে পারবেন না। এ জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেনা সমর্থন নিয়েই সু চি নির্বাচন করেছেন। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সেখানে এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এখানে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর সমর্থনের ও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিম্নকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যদের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রযন্ত্রে সু চিকে কিভাবে আনবে, তাও স্পষ্ট নয়। ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে! সু চি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যাঁরা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করেছেন, তাঁরা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে এক হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শ শ রোহিঙ্গা নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এই প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তাঁর উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে 'পুশ-ইন' করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তাঁর কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের 'সহাবস্থানে' গেছেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছেন। এতে করে তিনি 'বিজয়ী' হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে শঙ্কা থাকলই।
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে সংস্কার চালু করেছিলেন, তার অংশ হিসেবেই এই নির্বাচনটি হলো। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আগ্রহ রয়েছে মিয়ানমারের ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছেন। মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে। দীর্ঘ ৫৩ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনা শাসনের পর মিয়ানমারের 'দুয়ার খুলে দেওয়া' হয়েছে। সু চিকে সামনে রেখেই পশ্চিমা শক্তি তাদের স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে। এ মুহূর্তে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই 'পরিবর্তন' মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যায় না। দুই. নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অং সান সু চির অবস্থান কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারবেন না। যদিও তিনি আভাস দিয়েছেন, তাঁর ভূমিকা হবে 'প্রধানমন্ত্রীর ঊর্ধ্বে'। এ ব্যাপারেও কথা আছে। সংবিধানে এ ধরনের কোনো পদ নেই। একজন 'সিনিয়র মন্ত্রী' হিসেবে আপাতত তিনি প্রশাসনে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আস্থা যত দিন পাবেন তত দিন 'কোনো ঝামেলা ছাড়াই' তিনি প্রশাসনের অংশ থাকবেন। তিন. সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। কিন্তু সেনাবাহিনী এই উদ্যোগকে সমর্থন করবে- এটা মনে হয় না। চার. জনগণই যে 'সকল ক্ষমতার উৎস'- মিয়ানমারের নির্বাচন এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। এই নির্বাচন পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করবে। পাঁচ. এই প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব থাকল না। ফলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ আরো দানা বাঁধবে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলিম নিধন ও উৎখাতে আরো উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর প্রথম টার্ম শেষ হবে ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ। একটি 'সমঝোতার' আলোকে তিনি দ্বিতীয় টার্মের জন্যও মনোনীত হতে পারেন। মিয়ানমারে দীর্ঘ ২৫ বছর পর একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো বটে; কিন্তু তাতে 'গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই নির্বাচন মিয়ানমারে একটি 'আধা গণতন্ত্র' অথবা 'মিশ্র গণতান্ত্রিক' সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। Daily Kalerkontho 11.11.15
0 comments:
Post a Comment