রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নির্বাচন মিয়ানমারকে কোথায় নিয়ে যাবে?

আজ ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে প্রত্যাশা অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণভাবে মনে করা হচ্ছে, দীর্ঘ ২৫ বছর পর গণতান্ত্রিকভাবে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে করে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মনে করছে, এ নির্বাচনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিজয়ী হবে এবং সু চি সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন। বলা ভালো, এর আগে ২০১০ সালে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ওই নির্বাচনের আগে দল নিবন্ধন না করায় এনএলডি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। পরে অবশ্য উপনির্বাচনে দল নিবন্ধন সম্পন্ন করে সু চির দল সংসদে ফিরে এসেছিল এবং সু চি নিজেও সংসদে ছিলেন। তবে ১৯৯০ সালে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ওই নির্বাচনই গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া সর্বশেষ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে এনএলডি ৮০ দশমিক ৮০ ভাগ ভোট ও ৩৯২টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু এনএলডিকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। বরং নির্বাচনটি বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের নির্বাচনের একটা প্রেক্ষাপট আছে। ১৯৮৮ সালে দেশব্যাপী গণতন্ত্রকামী মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ১৮ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। তবে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন প্রথমবারের মতো সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি গঠন করেছিলেন বার্মিজ সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি)। বিএসপিপি মিয়ানমারে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে Burmese Way to Socialism নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ১৯৬৪ সালে সেখানে বিএসপিপি বাদে অন্যসব দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং গঠন করে State Law and Order Restoration Council (SLORC)। মজার ব্যাপার হল, অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের মাথায় ১৯৮৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সু চি এনএলডি গঠন করেন। এর আগে গণঅভ্যুত্থান যখন সংঘটিত হচ্ছে, তখন অসুস্থ মাকে দেখার নাম করে সু চি দীর্ঘ প্রবাস জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায় তিনি রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনও তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশীকে বিয়ে করতে পারবেন না। একনাগাড়ে ২০ বছরের ওপরে বিদেশে থাকলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তার বাবা ও মাকে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন না। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করে সংসদ। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় হন (তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন), পরে তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে, অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-১৯৯৮) গোলকার মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুকক্ষবিশিষ্ট-House of Representative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিুকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জনের। তাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মধ্যে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন।২০১০ সালে গঠিত সংসদের উভয়কক্ষে সেনাবাহিনী সমর্থিত ও থেইন সেইনের নেতৃত্বাধীন এসপিডিসির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। নিুকক্ষে এ দলের আসন ছিল ২১৯, আর উচ্চকক্ষে ১২৪। এর ওপরে ছিল সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন। সে ক্ষেত্রে উপনির্বাচনে নিুকক্ষে (২০১২) সু চির দলের ৪৩ আসন কোনো বড় ধরনের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কিন্তু এবার কি দৃশ্যপট পাল্টে যাবে? সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এবার এনএলডিপির জন্য একটি বড় ধরনের গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। এই গণজোয়ার কি সু চিকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে? এখানে অনেক প্রশ্ন আছে। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতিই এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। সে ক্ষেত্রে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ক্ষমতার ভারসাম্যে কোনো পরিবর্তন হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী হতে হলেও তার সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন হবে। নিদেনপক্ষে নিুকক্ষে ১১০ সদস্যবিশিষ্ট সেনা সদস্যের সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনী চাইবে বিকল্প একজন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি ১৯৯০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। তবে সু চি অনেকদিন ধরেই চাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে। যারা সু চির গত এক বছরের ভূমিকা ও বক্তব্য অনুসরণ করছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনা আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়।মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মা বা থা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১টি আসনের (সংসদের উভয়কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন রাজ্যে সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে পুশইন করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।প্রতিবেশী মিয়ানমারের এ নির্বাচন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার আমাদের কাম্য। মিয়ানমারকে আমাদের আস্থায় নিতে হবে। এবং সেটা করতে হবে আমাদের স্বার্থেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। বলাই বাহুল্য, মিয়ানমারের এ ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তাতে করে বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয়, বরং মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে। (বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে)। ঘুমধুম-মুসে হাইওয়ে চালু হলে সড়কপথেই চীনে যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশী এলাকা। আর মুসে হচ্ছে চীনের সীমান্ত শহর।বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) ও বিসিআইএম জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোটটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এ জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশী সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশকিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ে অঞ্চলে প্রচুর তুলা উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশীরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এ সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর, যেমন- রুবি, জেড, মার্বেল ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এ গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা সমস্যা আছে বটে; কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা কোনো সমস্যা তৈরি হবে না, এটাই প্রত্যাশা করি। এ কারণেই এ নির্বাচনের গুরুত্ব আমাদের জন্যও বেশি। তবে এ নির্বাচন মিয়ানমারকে কতটুকু স্থিতিশীলতায় আনতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী ৮টি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আরও ৭টি সশস্ত্র গোষ্ঠী। সুতরাং এ নিয়েও একটি প্রশ্ন থেকে যাবে। শান্তি চুক্তিতে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে নির্বাচনের পর নয়া সরকার এ ব্যাপারে কী উদ্যোগ নেয়।নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ- এক. প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আশংকা প্রকাশ করেছেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় আরব বসন্তের মতো রক্তপাত ও চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এ ধরনের আশংকা ব্যক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি একটি ইঙ্গিত দিলেন। মিয়ানমার নির্বাচনের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সু চি যদি এ প্রক্রিয়ার অংশ না হন, তাহলে সেনাবাহিনী এটা মেনে নেবে না। দুই. এটা সত্য, সু চি এ মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্যতম একটি শক্তি। নির্বাচনে তিনি যদি বিজয়ী হন, তাহলে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে পারেন। তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর যে কর্পোরেট ইন্টারেস্ট গড়ে উঠছে, তা সহজে ভাঙবে না। রাজনীতিতে তাদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে। ৮ নভেম্বরের নির্বাচন তাতে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে না। Daily Jugantor 08.11.15

0 comments:

Post a Comment