হঠাৎ
করেই বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। প্যারিসে ইসলামিক স্টেটের
(আইএস) জঙ্গিদের হামলায় মারা গেছেন ১২৯ জন মানুষ। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে
৩টি স্থানে হামলা চালিয়ে এবং আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সাধারণ
মানুষদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনার রেশ শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিম আফ্রিকার একটি
দেশ মালির রাজধানী বামাকোর একটি হোটেলে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালায়। ১৭০ জন
বিদেশিকে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠী আল মুরাবিতুম
জিম্মি করে। উদ্ধার অভিযানে মারা যান ২৭ জন নাগরিক। এদিকে চীনের জিনজিয়াংয়ে
একটি কয়লা খনিতে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে একটি
বার্তা সংস্থা। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ২৮ জনকে গুলি করে হত্যা
করেছে এমন খবরও প্যারিস ও মালি ট্র্যাজেডির পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। সবাই
জানেন জিনজিয়াং মূলত উইঘুর মুসলমানদের বসবাস। উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে
বিচ্ছিন্নবাদী চিন্তা চেতনা কাজ করছে। উইঘুর মুসলমানরা কিছুদিন ধরেই এক
ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। আমরা স্মরণ করতে পারি কিছুদিন আগে
থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দিরে যে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হয়েছিল তাতে জড়িত
ছিল উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও এই
সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের বাইরে নয়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী
কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। ইসলামিক স্টেটের
জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে এমন একটি আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে আসিয়ান
সম্মেলনের প্রাক্কালে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনে ইসলামিক জঙ্গিরা তৎপর। এদের
কর্মকাণ্ড একাধিকবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জš§ দিয়েছে। ফিলিপাইনে আবু সায়াফ
গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় জামিয়া ইসলামিয়ার হাতে
বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এই দেশ দুটি সম্পর্কে বিশ্বে একটি বাজে
ধারণার জš§ দিয়েছে। এ অঞ্চলে আইএসের নেটওয়ার্ক কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে
তা জানা না গেলেও আল কায়েদার প্রভাব আছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি
গোষ্ঠীর সঙ্গে আল কায়েদা একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের জঙ্গিরাও যে এতে করে উৎসাহিত
হবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তি জীবন তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কিংবা যায় ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরান পড়েননি। নামাজও পড়তেন না। তার চাচাতো বোন নারী বোমবাজ হাসনা বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বব্যাপী ছিলেন এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে প্যারিসে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরনের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত না বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল এখন প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’মনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরনের ‘নিরাপত্তা বলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তি জীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কনক্রিকেটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘোটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। দুই. উগ্রপন্থি তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ করে তাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে এবং তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ‘ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত’Ñ এ ধরনের একটি সেøাগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেÑএমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিন. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রার্থীরা এখনো দলীয়ভাবে মনোনীত হননি। একজন কট্টরপন্থি রিপাবলিকান প্রার্থী যাতে দলীয় মনোনয়ন পান এই ঘটনা তাতে প্রভাব ফেলবে। চার. আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ন্যূনতম ‘ঐক্যে’ উপনীত হলেও অচিরেই এতে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চস্পুডোভস্কি তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব ষেড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডধৎ : অসবৎরপধ'ং খড়হম ডধৎ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু-তে উল্লেখ করেছেন বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজ জীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন তখন ওই স্টেডিয়ামের বাইরে ৩ আত্মঘাতী বোমারু নিজেদেরকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও এর প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্ক ও টুইন টাওয়ার-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ার-এর হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের অনেক উদ্বেগজনক চিন্তার খোরাক জোগায়।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রান্সে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ চলতি সপ্তাহে মস্কো যাচ্ছেন পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। তিনি ওয়াশিংটনেও যাবেন। ওলান্দের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কিভাবে বন্ধ হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪ বছর পর প্যারিস হত্যাকাণ্ডের নতুন একটি মাত্রা পেল। এটা স্পষ্ট এসব বড় বড় ঘটনার পেছনে যদি কোনো শক্তির মদদ না থেকে থাকে তাহলে এসব ‘ঘটনা’ সংঘটিত হতে পারে না। দুর্ভাগ্য টুইন টাওয়ার-এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। আল কায়েদার কথা আমরা জেনেছি বটে। কিন্তু কারা আল কায়েদার জš§ দিল, কারা সুবিধা নিল, সেই ইতিহাস রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা আবাউদের ‘মৃত্যু’ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এবারো রয়ে যাবে পর্দার অন্তরালে। তাই প্যারিসের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে একক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী মিত্ররা দীর্ঘদিন সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় বোমা বর্ষণ করেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। তবে এই ‘যুদ্ধে’ রাশিয়ার অংশগ্রহণের ফলে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। রাশিয়ার বোমাবর্ষণ আইএসের অনেক ঘাঁটির ক্ষতি হয়েছে। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নষ্ট হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি যৌথভাবে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখে তাহলে আইএসের ঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সিরিয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আপাতত আসাদকে রেখেই আইএসকে এই মুহূর্তে ‘প্রধান শত্রু’ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আসাদকে ক্ষমতায় রেখে সেখানে সিয়া, সুন্নি ও আলাইয়টদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত, এটা বাস্তব যে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। ইরানকে আস্থায় নিয়েই সমাধানের দিকে যেতে হবে। প্যারিস ও মালির ঘটনা প্রমাণ করল বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড কমেনি বরং বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৪ বছর আগে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলেও তা কোনো বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। সুতরাং বিশ্বশক্তি যদি এই ইস্যুতে একমত না হয় তাহলে সন্ত্রাস দমন সম্ভব হবে না। Daily Manobkontho 29.11.15
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তি জীবন তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কিংবা যায় ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরান পড়েননি। নামাজও পড়তেন না। তার চাচাতো বোন নারী বোমবাজ হাসনা বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বব্যাপী ছিলেন এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে প্যারিসে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরনের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত না বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল এখন প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’মনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরনের ‘নিরাপত্তা বলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তি জীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কনক্রিকেটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘোটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। দুই. উগ্রপন্থি তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ করে তাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে এবং তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ‘ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত’Ñ এ ধরনের একটি সেøাগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেÑএমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিন. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রার্থীরা এখনো দলীয়ভাবে মনোনীত হননি। একজন কট্টরপন্থি রিপাবলিকান প্রার্থী যাতে দলীয় মনোনয়ন পান এই ঘটনা তাতে প্রভাব ফেলবে। চার. আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ন্যূনতম ‘ঐক্যে’ উপনীত হলেও অচিরেই এতে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চস্পুডোভস্কি তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব ষেড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডধৎ : অসবৎরপধ'ং খড়হম ডধৎ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু-তে উল্লেখ করেছেন বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজ জীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন তখন ওই স্টেডিয়ামের বাইরে ৩ আত্মঘাতী বোমারু নিজেদেরকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও এর প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্ক ও টুইন টাওয়ার-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ার-এর হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের অনেক উদ্বেগজনক চিন্তার খোরাক জোগায়।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের পর ফ্রান্সে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ চলতি সপ্তাহে মস্কো যাচ্ছেন পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য। তিনি ওয়াশিংটনেও যাবেন। ওলান্দের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কিভাবে বন্ধ হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪ বছর পর প্যারিস হত্যাকাণ্ডের নতুন একটি মাত্রা পেল। এটা স্পষ্ট এসব বড় বড় ঘটনার পেছনে যদি কোনো শক্তির মদদ না থেকে থাকে তাহলে এসব ‘ঘটনা’ সংঘটিত হতে পারে না। দুর্ভাগ্য টুইন টাওয়ার-এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি। তারা পর্দার আড়ালে থেকে গেছে। আল কায়েদার কথা আমরা জেনেছি বটে। কিন্তু কারা আল কায়েদার জš§ দিল, কারা সুবিধা নিল, সেই ইতিহাস রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে।
প্যারিস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা আবাউদের ‘মৃত্যু’ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এবারো রয়ে যাবে পর্দার অন্তরালে। তাই প্যারিসের ঘটনাবলি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে একক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী মিত্ররা দীর্ঘদিন সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় বোমা বর্ষণ করেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। তবে এই ‘যুদ্ধে’ রাশিয়ার অংশগ্রহণের ফলে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। রাশিয়ার বোমাবর্ষণ আইএসের অনেক ঘাঁটির ক্ষতি হয়েছে। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ নষ্ট হয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি যৌথভাবে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখে তাহলে আইএসের ঘাঁটি ধ্বংস করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সিরিয়ার ক্ষেত্রে একটি ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আপাতত আসাদকে রেখেই আইএসকে এই মুহূর্তে ‘প্রধান শত্রু’ ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আসাদকে ক্ষমতায় রেখে সেখানে সিয়া, সুন্নি ও আলাইয়টদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত, এটা বাস্তব যে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরান একটি ফ্যাক্টর। ইরানকে আস্থায় নিয়েই সমাধানের দিকে যেতে হবে। প্যারিস ও মালির ঘটনা প্রমাণ করল বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড কমেনি বরং বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৪ বছর আগে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করলেও তা কোনো বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। সুতরাং বিশ্বশক্তি যদি এই ইস্যুতে একমত না হয় তাহলে সন্ত্রাস দমন সম্ভব হবে না। Daily Manobkontho 29.11.15
0 comments:
Post a Comment