নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি ভালো হলেও, ২৮ ডিসেম্বর
দেশজুড়ে জেলা পরিষদের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা ভালো হয়নি। জেলা
পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া এবং সেই
প্রতিক্রিয়ার জবাবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে যে ‘জবাব’ দেয়া হয়েছে, তাতে করে
‘আস্থার সম্পর্ক’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছে। ২০১৬ সালে যত নির্বাচন
হয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনই বিতর্কিত ছিল নানা কারণে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ভোট কারচুপি
হয়নি। এমনকি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ছুটে গিয়েছিলেন
হেরে যাওয়া প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায়। সাংবাদিকদের
তিনি জানিয়েছিলেন, সাখাওয়াতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তিনি নারায়ণগঞ্জের
উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। পর্যবেক্ষকরা তখন বলেছিলেন,
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি মডেল হতে পারে! বলেছিলেন,
এভাবে যদি ‘আস্থার রাজনীতি’ বজায় থাকে, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতির স্পিরিট
আবার দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচন সেই সম্ভাবনাকে আবার
পেছনে ঠেলে দিল। যদিও জেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল পরোক্ষ নির্বাচন। জনগণ
এখানে ভোট দেয়নি। স্থানীয় পরিষদে যারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে এর আগে বিজয়ী
হয়েছিলেন, তারাই ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অন্যদের ‘নির্বাচিত’
করেছেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।
এমনকি আওয়ামী লীগের ‘মিত্র’ জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের ময়দানে ছিল না।
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিল বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের
প্রার্থীরাই। এখানে অন্য কোনো দলের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ ছিল না।
তরপরও দেখা গেছে, জেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দলগুলো নিজেদের
মাঝে বিতর্কে জড়িয়ে গেছে। জেলা পরিষদের নির্বাচনী ফলে দেখা গেছে, সারা
দেশের ৫৯টি জেলায় ভোট হলেও, চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে ৩৮টিতে। এর মাঝে
আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ২৫টিতে জয়ী হয়েছেন। আর বাকি ১৩টির মাঝে ১২টিতে আওয়ামী
লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। গাইবান্ধার চেয়ারম্যান পদে
বিজয়ীর কোনো দলীয় পরিচয় নেই। এর আগে ২১ জেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনী মাঠে
বিএনপি না থাকায় বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয়নি। তবে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত
সংঘর্ষ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জেলা পরিষদের এ নির্বাচন চলতি ২০১৭ সালের
রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, জেলা পরিষদের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান আমলের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ মডেলের নির্বাচনের মতো, যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ জনগণ ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচিত করেননি। এটা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। এর আগে একাধিক সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই উঠুক না কেন, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সুযোগটি ছিল না জেলা পরিষদ নির্বাচনে। ফলে গণতন্ত্র ও সংবিধান পরিপন্থী বলাটা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’ জেলা পরিষদের নির্বাচন ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’ হয়নি। উপরন্তু সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে।’ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১১ নং অনুচ্ছেদ বর্ণিত সেই ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর কখনোই জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এবার হয়েছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, আমরা একটা নির্বাচন পেয়েছি। হয়তো আমাদের প্রত্যাশা তাতে পূরণ হয়নি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করার যে মনোবৃত্তি এবং মানসিকতা, সেই মানসিকতা থেকে এখনও তারা বের হয়ে আসতে পারছেন না। বিরোধী পক্ষ থেকে যখন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একজন সাবেক মন্ত্রী বললেন, ‘বিএনপি জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।’ সরকারের অনেক সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীর মুখে বিএনপির সমালোচনা শুনছি। ফলে ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড় ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য যে খুব ভালো সংবাদ বয়ে আনবেÑ এটা আশা করতে পারছি না।
গেল বছর দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় কাউন্সিল করেছে। কিন্তু কাউন্সিলের মাধ্যমে নয়া নেতৃত্ব বেরিয়ে আসেনি। আওয়ামী লীগের মূল কা-ারি এখনও শেখ হাসিনা। তবে নেতৃত্বে এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৭০ বছরে পা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৫ বছর তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যদিও একাধিকবার তিনি বলেছেন, তিনি খুশি হতেন, যদি তিনি অবসরে যেতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ছাড়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার এ মুহূর্তে কেউ নেই। ফলে সংগতকারণেই তিনি নেতৃত্বে থেকে যাচ্ছেন এবং তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির ৩৫ বছরই, অর্থাৎ অর্ধেক সময়েরও বেশি সময় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বোধ করি এটা একটা রেকর্ড, যা হয়তো ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বয়স প্রায় ৩৯ বছর। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ দলটির ১৯৮৩ সাল থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আছেন খালেদা জিয়া। সেই অর্থে ৩৩ বছর তিনি দলটির চেয়ারপারসন। দলটি ২০১৬ সালে কাউন্সিল করেছে। কিন্তু ওই কাউন্সিলে নয়া নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। বলা যেতে পারে, দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও ‘পুরনো নেতৃত্বের’ প্রতি আস্থাশীল। আওয়ামী লীগ অবিশ্যি কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপদেষ্টাম-লীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। নিয়ম রক্ষার্থে দল দুইটি কাউন্সিল করেছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই।
বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে সামনের দিকে। ২০৫০ সালকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে ২০৫০ সালে কেমন দেখতে চাইÑ এমন পরিকল্পনা থাকা উচিত দুইটি বড় দলের। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একটি পরিকল্পনা থাকলেও বড় দল হিসেবে বিএনপির সেই পরিকল্পনা নেই। বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কও অকার্যকর। তাদের আদৌ ব্যবহার করা হয় বলে মনে হয় না। কিংবা এরা আদৌ সংগঠিতও নয়।
ফলে পরিকল্পনাহীনভাবেই বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দলটির সমর্থকদের সংখ্যা অনেক। এখনও আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। ফলে মানুষের আগ্রহ থাকবে বিএনপির দিকে চলতি বছরও।
গেল বছরের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ শুরু করেছিলেন, তা চলতি বছরের প্রথমদিকেও অব্যাহত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছর আমরা নতুন একটি নির্বাচন কমিশন পাব। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে আইন প্রণয়ন করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (১১৮-১) দীর্ঘ ৪৫ বছরে কোনো সরকারই এ আইনটি প্রণয়ন করেনি। ডিসেম্বরে (২০১৬) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে আসে। একই সঙ্গে একটি ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ নির্বাচন কমিশনের দাবিও ওঠে। রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক অধিকার বলে (১১৮-১ ও ৪৮) সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। কিন্তু তা সব ‘পক্ষ’কে কতটুকু খুশি করতে পারবে, সে প্রশ্ন রইলই। কেননা সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা থাকলেও ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুইটি ক্ষেত্র ব্যতীত (প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ) অন্য সব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ নিতে বাধ্য। ফলে রাষ্ট্রপতি যাদেরই নিয়োগ দেন না কেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ’ এর বাধ্যবাধকতা একটি ‘সূক্ষ্ম অসন্তোষ’ সৃষ্টি করতে বাধ্য। এ নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অনেক। কেননা তাদের ঘাড়ে বর্তাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। সে ক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ এ একটি নির্বাচন আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করেছি। কিন্তু একটা বড় ‘ব্যর্থতার’ জায়গা হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। এ ‘আস্থার অভাব’ এর কারণে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমরা একটি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখেছি। ফলে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে, চলতি বছরটি তাদের জন্য হবে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’, অর্থাৎ পরীক্ষার সময়। তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই হবে মূল আলোচিত বিষয়। সংবিধানের ১১৮-৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দীনের কমিশন সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘স্বাধীনভাবে নির্বাচন’ পরিচালনা করতে পারেননি। সরকারের ‘চাপ’ তারা অস্বীকার করতে পারেননি। ফলে একটা শঙ্কা থেকেই গেল, যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে তার ‘ভূমিকা’ নিয়ে। একটি সার্চ কমিটি সব সমস্যার সমাধান এনে দেবে না। এজন্য প্রয়োজন ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ বা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিরোধী দলের উচিত, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারকে সমালোচনা করার নামই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিএনপিকে উপেক্ষা করে, ওই দলটিকে একপাশে সরিয়ে রেখে, একতরফাভাবে নির্বাচন করলে, তাতে যেমনি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হবে না, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে না। বারবার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। সে ক্ষেত্রে বিএনপিসহ সব দলকে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনা না যায়, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এজন্যই ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Daily Alokito Bangladesh
01.01.2017
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বলতে দ্বিধা নেই, জেলা পরিষদের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান আমলের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ মডেলের নির্বাচনের মতো, যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ জনগণ ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচিত করেননি। এটা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। এর আগে একাধিক সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই উঠুক না কেন, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সুযোগটি ছিল না জেলা পরিষদ নির্বাচনে। ফলে গণতন্ত্র ও সংবিধান পরিপন্থী বলাটা একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।’ জেলা পরিষদের নির্বাচন ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’ হয়নি। উপরন্তু সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে।’ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। কিন্তু জেলা পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১১ নং অনুচ্ছেদ বর্ণিত সেই ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর কখনোই জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এবার হয়েছে। ভালো হোক, মন্দ হোক, আমরা একটা নির্বাচন পেয়েছি। হয়তো আমাদের প্রত্যাশা তাতে পূরণ হয়নি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করার যে মনোবৃত্তি এবং মানসিকতা, সেই মানসিকতা থেকে এখনও তারা বের হয়ে আসতে পারছেন না। বিরোধী পক্ষ থেকে যখন নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একজন সাবেক মন্ত্রী বললেন, ‘বিএনপি জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।’ সরকারের অনেক সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীর মুখে বিএনপির সমালোচনা শুনছি। ফলে ‘আস্থার সম্পর্ক’ গড় ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল, তা এখন ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য যে খুব ভালো সংবাদ বয়ে আনবেÑ এটা আশা করতে পারছি না।
গেল বছর দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জাতীয় কাউন্সিল করেছে। কিন্তু কাউন্সিলের মাধ্যমে নয়া নেতৃত্ব বেরিয়ে আসেনি। আওয়ামী লীগের মূল কা-ারি এখনও শেখ হাসিনা। তবে নেতৃত্বে এবং তাকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৭০ বছরে পা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৫ বছর তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। যদিও একাধিকবার তিনি বলেছেন, তিনি খুশি হতেন, যদি তিনি অবসরে যেতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ছাড়া দলের নেতৃত্ব দেয়ার এ মুহূর্তে কেউ নেই। ফলে সংগতকারণেই তিনি নেতৃত্বে থেকে যাচ্ছেন এবং তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতির ৩৫ বছরই, অর্থাৎ অর্ধেক সময়েরও বেশি সময় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। বোধ করি এটা একটা রেকর্ড, যা হয়তো ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বয়স প্রায় ৩৯ বছর। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ দলটির ১৯৮৩ সাল থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আছেন খালেদা জিয়া। সেই অর্থে ৩৩ বছর তিনি দলটির চেয়ারপারসন। দলটি ২০১৬ সালে কাউন্সিল করেছে। কিন্তু ওই কাউন্সিলে নয়া নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। বলা যেতে পারে, দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও ‘পুরনো নেতৃত্বের’ প্রতি আস্থাশীল। আওয়ামী লীগ অবিশ্যি কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপদেষ্টাম-লীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। নিয়ম রক্ষার্থে দল দুইটি কাউন্সিল করেছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই।
বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে সামনের দিকে। ২০৫০ সালকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে ২০৫০ সালে কেমন দেখতে চাইÑ এমন পরিকল্পনা থাকা উচিত দুইটি বড় দলের। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একটি পরিকল্পনা থাকলেও বড় দল হিসেবে বিএনপির সেই পরিকল্পনা নেই। বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কও অকার্যকর। তাদের আদৌ ব্যবহার করা হয় বলে মনে হয় না। কিংবা এরা আদৌ সংগঠিতও নয়।
ফলে পরিকল্পনাহীনভাবেই বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দলটির সমর্থকদের সংখ্যা অনেক। এখনও আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। ফলে মানুষের আগ্রহ থাকবে বিএনপির দিকে চলতি বছরও।
গেল বছরের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ শুরু করেছিলেন, তা চলতি বছরের প্রথমদিকেও অব্যাহত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে চলতি বছর আমরা নতুন একটি নির্বাচন কমিশন পাব। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে আইন প্রণয়ন করার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (১১৮-১) দীর্ঘ ৪৫ বছরে কোনো সরকারই এ আইনটি প্রণয়ন করেনি। ডিসেম্বরে (২০১৬) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে আসে। একই সঙ্গে একটি ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ নির্বাচন কমিশনের দাবিও ওঠে। রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক অধিকার বলে (১১৮-১ ও ৪৮) সিইসি ও কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। কিন্তু তা সব ‘পক্ষ’কে কতটুকু খুশি করতে পারবে, সে প্রশ্ন রইলই। কেননা সিইসিসহ কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা থাকলেও ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুইটি ক্ষেত্র ব্যতীত (প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ) অন্য সব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ নিতে বাধ্য। ফলে রাষ্ট্রপতি যাদেরই নিয়োগ দেন না কেন ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ’ এর বাধ্যবাধকতা একটি ‘সূক্ষ্ম অসন্তোষ’ সৃষ্টি করতে বাধ্য। এ নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অনেক। কেননা তাদের ঘাড়ে বর্তাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। সে ক্ষেত্রে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ এ একটি নির্বাচন আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার করেছি। কিন্তু একটা বড় ‘ব্যর্থতার’ জায়গা হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। এ ‘আস্থার অভাব’ এর কারণে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমরা একটি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখেছি। ফলে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে, চলতি বছরটি তাদের জন্য হবে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’, অর্থাৎ পরীক্ষার সময়। তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই হবে মূল আলোচিত বিষয়। সংবিধানের ১১৮-৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দীনের কমিশন সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে ‘স্বাধীনভাবে নির্বাচন’ পরিচালনা করতে পারেননি। সরকারের ‘চাপ’ তারা অস্বীকার করতে পারেননি। ফলে একটা শঙ্কা থেকেই গেল, যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে তার ‘ভূমিকা’ নিয়ে। একটি সার্চ কমিটি সব সমস্যার সমাধান এনে দেবে না। এজন্য প্রয়োজন ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স’ বা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিরোধী দলের উচিত, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারকে সমালোচনা করার নামই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিএনপিকে উপেক্ষা করে, ওই দলটিকে একপাশে সরিয়ে রেখে, একতরফাভাবে নির্বাচন করলে, তাতে যেমনি ‘আস্থার সম্পর্ক’ তৈরি হবে না, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে না। বারবার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। সে ক্ষেত্রে বিএনপিসহ সব দলকে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আনা না যায়, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এজন্যই ২০১৭ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Daily Alokito Bangladesh
01.01.2017
0 comments:
Post a Comment